Showing posts with label . Show all posts
Showing posts with label . Show all posts

রিপোর্ট ১৯৭১

আসাদ চৌধুরী

প্রাচ্যের গানের মতো শোকাহত, কম্পিত, চঞ্চল
বেগবতী তটিনীর মতো স্নিগ্ধ, মনোরম
আমাদের নারীদের কথা বলি, শোনো।
এ-সব রহস্যময়ী রমণীরা পুরুষের কণ্ঠস্বর শুনে
বৃক্ষের আড়ালে স’রে যায়-
বেড়ার ফোঁকড় দিয়ে নিজের রন্ধনে
তৃপ্ত অতিথির প্রসন্ন ভোজন দেখে
শুধু মুখ টিপে হাসে।
প্রথম পোয়াতী লজ্জায় অনন্ত হ’য়ে
কোঁচরে ভরেন অনুজের সংগৃহীত কাঁচা আম, পেয়ারা, চালিতা-
সূর্য্যকেও পর্দা করে এ-সব রমণী।
অথচ যোহরা ছিলো নির্মম শিকার
সকৃতজ্ঞ লম্পটেরা
সঙ্গীনের সুতীব্র চুম্বন গেঁথে গেছে-
আমি তার সুরকার- তার রক্তে স্বরলিপি লিখি।
মরিয়ম, যীশুর জননী নয় অবুঝ কিশোরী
গরীবের চৌমুহনী বেথেলহেম নয়
মগরেবের নামাজের শেষে মায়ে-ঝিয়ে
খোদার কালামে শান্তি খুঁজেছিলো,
অস্ফুট গোলাপ-কলি লহুতে রঞ্জিত হ’লে
কার কী বা আসে যায়।
বিপন্ন বিস্ময়ে কোরানের বাঁকা-বাঁকা পবিত্র হরফ
বোবা হ’য়ে চেয়ে দ্যাখে লম্পটের ক্ষুধা,
মায়ের স্নেহার্ত দেহ ঢেকে রাখে পশুদের পাপ।
পোষা বেড়ালের বাচ্চা চেয়ে-চেয়ে নিবিড় আদর
সারারাত কেঁদেছিলো তাহাদের লাশের ওপর।
এদেশে যে ঈশ্বর আছেন তিনি নাকি
অন্ধ আর বোবা
এই ব’লে তিন কোটি মহিলারা বেচারাকে গালাগালি করে।
জনাব ফ্রয়েড,
এমন কি খোয়াবেও প্রেমিকারা আসে না সহজ পায়ে চপল চরণে।
জনাব ফ্রয়েড, মহিলারা
কামুকের, প্রেমিকের, শৃঙ্গারের সংজ্ঞা ভুলে গ্যাছে।
রকেটের প্রেমে পড়ে ঝ’রে গ্যাছে
ভিক্টোরিয়া পার্কের গীর্জার ঘড়ি,
মুসল্লীর সেজদায় আনত মাথা
নিরপেক্ষ বুলেটের অন্তিম আজানে স্থবির হয়েছে।
বুদ্ধের ক্ষমার মূর্তি ভাঁড়ের মতন
ভ্যাবাচেকা খেয়ে প’ড়ে আছে, তাঁর
মাথার ওপরে
এক ডজন শকুন মৈত্রী মৈত্রী ক’রে
হয়তো বা উঠেছিলো কেঁদে।

রূপম

সুবোধ সরকার

রূপমকে একটা চাকরি দিন   এম. এ পাস, বাবা নেই
আছে প্রেমিকা সে আর দু'-এক মাস দেখবে, তারপর
নদীর এপার থেকে নদীর ওপারে গিয়ে বলবে, রূপম
আজ চলি
তোমাকে মনে থাকবে চিরদিন
রূপমকে একটা চাকরি দিন, যে কোন কাজ
পিওনের কাজ হলেও চলবে |

তমালবাবু ফোন তুললেন, ফোনের অন্য প্রান্তে
যারা কথা বলেন
তাদের যেহেতু দেখা যায় না, সুতরাং তারা দুর্জ্ঞেয় |
তমালবাবু মামাকে বললেন কূপমের একটা চাকরি দরকার
মামা বললেন কাকাকে, কাকা বললেন জ্যাঠাকে,
জ্যাঠা বললেন
বাতাসকে |
মানুষ জানলে একরকম, কিন্তু বাতাস জানলে
প্রথমেই ছুটে যাবে দক্ষিণে, সে বলবে দক্ষিণের অরণ্যকে
অরণ্য বলবে আগুনকে, আগুন গেল আলিমুদ্দিন স্ট্রিটে
আলিমুদ্দিন ছুটল নদীকে বলার জন্য
নদী এসে আছড়ে পড়ল
উপকূলে, আসমুদ্র হিমাচল বলে উঠল
রূপমকে একটা চাকরি দাও, এম. এ. পাশ করে বসে আছে ছেলেটা |

কয়েক মাস বাদের ঘটনা, আমি বাড়িফিরছিলাম সন্ধেবেলায়
গলির মোড়ে সাত-আটজনের জটলা দেখে থমকে দাঁড়ালাম
জল থেকে সদ্য তুলে আনা রূপমের ডেডবডি
সারা গায়ে ঘাস, খরকুটো, হাতের মুঠোয়
ধরে থাকা একটা এক টাকার কয়েন |
পাবলিক বুথ থেকে কাউকে ফোন করতে চেয়েছিল, রূপম?
ভারত সরকারের এক টাকা কয়েনের দিকে আমার চোখ |

সারা গায়ে সবুজ ঘাস, ঘাস নয়, অক্ষর
এম. এ. পাস করতে একটা ছেলেকে যত অক্ষর পড়তে হয়
সেই সমস্ত ব্যর্থ অক্ষর ওর গায়ে লেগে আছে |

একটা ছেলেকে কেন আপনারা এম. এ. পড়ান, কোন আহ্লাদে আটখানা
বিশ্ববিদ্যালয় বানিয়েছেন? তুলে দিন
এই কথাগুলো বলব বলে ফোন তুললাম পবিত্র সরকারের
ফোন বেজে উঠল, ফোন বেজে চলল, ফোন বেজেই চলল
২০ বছর ধরে ওই ফোন বেজে চলেছে, আরো কুড়ি বছর বাজবে |

বাতাস বলছে অরণ্যকে, অরণ্য চলেছে নদীর দিকে
নদী উপকূল থেকে আছড়ে পড়ে বলল :
রূপমকে একটা চাকরি দিন |
কে রূপম?
রূপম আচার্য, বয়স ২৬, এম. এ. পাস
বাঁ দিকের গালে একটা কাটা দাগ আছে |

রজনী

কৃষ্ণচন্দ্র মজুমদার

যে কালে রজনী, নিদ্রা স্বজনীর সনে,
আবির্ভূতা হয় আসি অবনী-ভবনে;
যে কালে সমুন্দ গতি করিয়া ধারণ
জুড়ায় জগৎ-প্রাণ জগৎ-জীবন;
যে কালেতে সীমাশূণ্য আকাশমণ্ডল
অসংখ্য তারকাজালে হয় সমুজ্জ্বল;
যে কালে বিরল ক্ষুদ্র, জলধর দলে
অনতিবেগেতে ধায় গগন-মণ্ডলে;
যে কালে যামিনীনাথ সুধাময় করে
ধরণীর তপ্ত তনু সুশীতল করে;
যে কালে নিরখি স্বীয় প্রিয় প্রাণেশ্বরে
কুমুদিনী প্রফুল্লিত হয় সরোবরে;
যে কালে অমৃকপায়ী চকোর-নিকরে
সুধা পিয়ে প্রিয়গুণ গায় কলস্বরে,
যে কালে রজনী পরি চন্দ্রিকা-বসন,
স্বকান্তের সনে করে প্রিয় সম্ভাষণ;
যে কালে প্রকৃতি করি ধীরতা ধারণ
ভাবুকের ভাবপুঞ্জ করে উদ্দীপন;
যে কালে কোবিদকুল কল্পনার সনে
রত হয় নব নব সদ্ভাব-চিন্তনে;
ধিক ধিক বৃথা কার মানব জনম
এ কালে অলীকামোদে মত্ত যার মন।
ভবের ভাবের ভাবুক যে বা নয়,
নিদ্রায় বিমুগ্ধ সেই রহে এ সময়।
এ সময় ভক্তি-রস-প্রবণ অন্তরে,
ধন্য সে, যে স্মরে অখিল ঈশ্বরে।
বিবেক-আসনে হয়ে সমাসীন মন!
এ সময় স্মর না সে সংসার-শরণ?

রবীন্দ্রনাথ

অচিন্ত্যকুমার সেনগুপ্ত

আমি তো ছিলাম ঘুমে,
তুমি মোর শির চুমে
গুঞ্জরিলে কী উদাত্ত মহামন্ত্র মোর কানে-কানে !
চলো রে অলস কবি
ডেকেছে মধ্যাহ্ন-রবি
হেথা নয়, হেথা নয়, অন্য কোথা, অন্য কোনখানে |

চমকি উঠিনু জাগি’
ওগো মৃত্যু-অনুরাগী
উন্মুখ ডানায় কোন অভিসারে দূর-পানে ধাও,
আমারো বুকের কাছে
সহসা যে পাখা নাচে------
ঝড়ের ঝাপট লগে হয়েছে সে উন্মত্ত উধাও |

দেখি চন্দ্র-সূর্য-তারা
মত্ত নৃত্যে দিশাহারা,
দামাল যে তৃণশিশু, নীহারিকা হয়েছে বিবাগী,
তোমার দূরের সুরে
সকলি চলেছে উড়ে
অনির্ণীত অনিশ্চিত অপ্রেমেয় অসীমের লাগি’ |

আমারে জাগায়ে দিলে,
চেয়ে দেখি এ-নিখিলে
সন্ধ্যা, ঊষা, বিভাবরী, বসুন্ধরা-বধূ বৈরাগিণী ;
জলে স্থলে নভতলে
গতির আগুন জ্বলে
কূল হ’তে নিলো মোরে সর্বনাশা গতির তটিনী |

তুমি ছাড়া কে পরিতো
নিয়ে যেতে অবারিত
মরণের মহাকাশে মহেন্দ্রের মন্দির-সন্ধানে ;
তুমি ছাড়া আর কার
এ-উদাত্ত হাহাকার-----
হেথা নয়, হেথা নয়, অন্য কোথা, অন্য কোনখানে |

রোগ শয্যায়

অচিন্ত্যকুমার সেনগুপ্ত

মলিন দিনের মাধুরী হেরিয়া মধুর হয়েছে মন
রোগ শয্যায় একা শুয়ে আছি একান্ত অকারণ |
তবু সবি লাগে ভালো,
বিদায় বেলায় গোধূলির চোখে মৃদু মুমূর্ষ আলো |
পাশের ছাতের আলিসা হইতে কাপড়টি নিতে আসা,
পথে যেতে যেতে দু’টি বন্ধুর দরদী দরাজ হাসা
তৃণের ডগায় ছোট আলোটুকু, একটি তারকা ফোটে,
শুক্ নো পাতাটি নীড়ে ফিরে-যাওয়া ভীরু শালিকের ঠোঁটে !
শুয়ে রোগ শয্যায়
আকাশের চোখে ক্লান্ত কাকুতি মোর চোখে পৌঁচায় |
কোমল করিয়া ডাকেনিক’ কেহ, জ্বালেনিক’ দীপ-শিখা,
আজিকে আঁধারে তারাটীর সনে মোর মুখ-চন্দ্রিকা !
সন্ধ্যা কোমল কায়া
ছোট বোনটির মতো পাশে বসে’ নয়নে করুণ মায়া !
তুনি কি এখন চঞ্চলপদে গৃহ আচরণে রত,
তোমার চোখে কি সন্ধ্যা নেমেছে আমার স্নেহের মত ?
শুয়ে আছি চুপচাপ,
কান পেতে শুনি রাতের পাখায় বাজে আজি কি বিলাপ |

রৌদ্রের গান

এখানে সূর্য ছড়ায় অকৃপণ
দুহাতে তীব্র সোনার মতন মদ,
যে সোনার মদ পান ক’রে ধন ক্ষেত
দিকে দিকে তার গড়ে তোলে জনপদ।
ভারতী! তোমার লাবণ্য দেহ ঢাকে
রৌদ্র তোমায় পরায় সোনার হার,
সূর্য তোমার শুকায় সবুজ চুল
প্রেয়সী, তোমার কত না অহংকার।

সারাটা বছর সূর্য এখানে বাঁধা
রোদে ঝলসায় মৌন পাহাড় কোনো,
অবাধ রোদ্রে তীব্র দহন ভরা
রৌদ্রে জ্বলুক তোমার আমার মনও।

বিদেশকে আজ ডাকো রৌদ্রের ভোজে
মুঠো মুঠো দাও কোষাগার-ভরা সোনা,
প্রান্তর বন ঝলমল করে রোদে,
কী মধুর আহা রৌদ্রে প্রহর গোনা!
রৌদ্রে কঠিন ইস্পাত উজ্জ্বল
ঝকমক করে ইশারা যে তার বুকে
শূন্য নীরব মাঠে রৌদ্রের প্রজা
স্তব করে জানি সূর্যের সম্মুখে।

পথিক-বিরল রাজপথে সূর্যের
প্রতিনিধি হাঁকে আসন্ন কলরব,
মধ্যাহ্নের কঠোর ধ্যানের শেষে
জানি আছে এক নির্ভয় উৎসব।

তাইতো এখানে সূর্য তাড়ায় রাত
প্রেয়সী, তুমি কি মেঘভয়ে আজ ভীত?
কৌতুকছলে এ মেঘ দেখায় ভয়,
এ ক্ষণিক মেঘ কেটে যাবে নিশ্চিত।

সূর্য, তোমায় আজকে এখানে ডাকি-
দুর্বল মন, দুর্বলতর কায়া,
আমি যে পুরনো অচল দীঘির জল
আমার এ বুকে জাগাও প্রতিচ্ছায়া।।

রুমির ইচ্ছা

নরেশ গুহ

আমি যদি হই ফুল,        হই ঝুঁটি-বুলবুল   হাঁস
        মৌমাছি হই একরাশ,
তবে আমি উড়ে যাই,        বাড়ি ছেড়ে দূরে যাই,
ছেড়ে যাই ধারাপাত,        দুপুরের ভূগোলের  ক্লাস।
তবে আমি টুপটুপ,            নীল-হ্রদে দিই ডুব  রোজ
        পায় না আমার কেউ খোঁজ।
তবে আমি উড়ে-উড়ে        ফুলেদের পাড়া ঘুরে
        মধু এনে দিই এক ভোজ।
হোক আমার এলো চুল,        তবু আমি হই ফুল   লাল
        ভরে দিই ডালিমের ডাল।
ঘড়িতে দুপুর বাজে;        বাবা ডুবে যান কাজে;
        তবু আর ফুরোয় না আমার সকাল।

রূপকথা নয়

আবু হাসান শাহরিয়ার

সবাই ছিলো ঘুমিয়ে, আমার
দুচোখ ছিলো খোলা-
আকাশ গাঙে শুভ্র চাঁদের
নাও ছিলো পাল-তোলা।
সে-নাও হঠাৎ ভিড়লো আমার
ঘরের নিঝুম ঘাটে,
দরজা খুলে দেখি গলুই
ঠেকেছে চৌকাঠে।
লাফিয়ে চাঁদের পাটাতনে
যেই বসেছি গিয়ে
ঝড়ের বেগে ছুটলো সে-নাও
আমাকে চমকিয়ে।
আকাশ-গাঙে শ্যাওলা নরম
মেঘেরা তুলতুল
দিঘির জলে শাপলা যেমন
তেমনি তারার ফুল।
তারার সে-ফুল একটি আমি
যেই নিয়েছি ছিঁড়ে
অমনি চাঁদের নাওয়ে সটান
ঘরেই এলাম ফিরে।
ঘুম ছিলো ওত পেতেই কাছে
চোখ দু’টোকে ধ’রে
বন্দি করে রাখলো তাদের
মুক্তি দিলো ভোরে।
জেগেই হলাম তারা ফুলের
সন্ধানে উৎসুক-
দেখি আমার মুঠোয় ধরা
মায়ের হাসি মুখ।

রেলের গাড়ি

দীনবন্ধু মিত্র


গড় গড় তাড়াতাড়ি,
চলিছে রেলের গাড়ি,
ধারেতে নড়িছে বাড়ি,
জানালার পরে শাড়ী
    রমণীরা দেখিছে।

ধন্য ধন্য সুকৌশল,
জ্বালিয়ে অঙ্গারানল
পরিতপ্ত করি জল,
বার করি বাষ্প দল,
    বেগে কল চলিছে।

কিবা তড়িতের তার,
হইয়াছে সুবিস্তার,
অবনীর অঙ্গে হার,
সমাচার অনিবার,
    নিমেষেতে ধাইছে।

দূরিত হইল দূর,
কালের ভাঙ্গিল ভুর,
বন্ধুর ভূধর চূর,
একদিনে কানপুর,
    পথিকেরা পাইছে।

পদার্থবিদ্যার বলে,
খোদিয়ে ভূধর দলে,
সুড়ঙ্গ করেছে কলে,
তার মধ্যে গাড়ি চলে,
     অপরূপ দেখিতে।

শোণ নদ ভীমকায়,
ইষ্টকের সেতু তায়,
কটিবন্ধ শোভা পায়,
নির্ভয়েতে গাড়ি যায়,
     দেবকীর্ত্তি মহীতে।

অশ্ব গজে দিয়ে ছাই,
হাসিতে হাসিতে ভাই,
বোম্বাই নগরে যাই,
পথে নেবে নাহি খাই,
     কি সুবিধা হয়েছে।

এ পাড়া ও পাড়া কাশী,
পাঞ্জাবিয়া প্রতিবাসী,
সহজে মান্দ্রাজি আসি,
পবিত্র গঙ্গায় ভাসি,
     দিবানিশি রয়েছে।

রেলের কল্যাণে কবে,
মঙ্গল সাধন হবে,
ভারতের জাতি সবে,
একমত হয়ে রবে,
     সুমিলনে মিলিয়ে।

সাধিতে স্বদেশ হিত,
মনে হয় হরষিত,
কবে বিজ্ঞ মনোনীত,
বিলাতেতে উপনিত,
     হবে মুখ খুলিয়ে।।

রাঙা সন্ধ্যা

অজিত দত্ত

রাঙা সন্ধ্যার স্তব্ধ আকাশ কাঁপায়ে পাখার ঘায়
ডানা মেলে দুরে উড়ে চলে যায় দুটি কম্পিত কথা,
রাঙা সন্ধ্যার বহ্নির পানে দুটি কথা উড়ে যায় |

পাখার শব্ দে কাঁপে হৃদয়ের প্রস্তর-স্তব্ ধতা,
দূর হতে দূর---তবু কানে বাজে সে পাখার স্পন্দন,
ক্ষীণ হতে ক্ষীণ, ঝড়ের মতন তবু তার মত্ততা |

চলে যায় তারা চোখের আড়ালে, লক্ষ কথার বন
অট্টহাস্যে কোলাহল করে, তবু ভেসে আসে কানে
পাখার ঝাপট, বজ্র ছাপায়ে এ কি অলিগুঞ্জন?

যাযাবর যত পক্ষী-মিথুন আসে তারা কোনখানে?
মানুষের ছায়া সে আলোর নিচে পড়েছে কি কোনদিন?
তুমি ত আমারে ভুলে যাবে নাকো যাই যদি সন্ধানে?

তুমি নীড়, তুমি উষ্ণকোমল, পাখার শব্ দ ক্ষীণ |
তবু সে আমাকে ডাকে, ডাকে শুধু ছেদহীণ ক্ষমাহীণ ||

রূপাই

জসীমউদদীন

এই গাঁয়ের এক চাষার ছেলে লম্বা মাথার চুল-
কালো মুখেই কালো ভ্রমর, কিসের রঙিন ফুল?
কাঁচা ধানের পাতার মত কচি-মুখের মায়া,
তার সাথে কে মাখিয়ে দেছে নবীন তৃণের ছায়া।
জালি লাউয়ের ডগার মত বাহু দুখান সরু।
গা-খানি তার শাঙন মাসের যেমন তমাল তরু।
বাদল-ধোয়া মেঘে কে গো মাখিয়ে দেছে তেল,
বিজলী মেয়ে পিছলে পড়ে ছড়িয়ে আলোর খেল।
কচি ধানের তুলতে চারা হয়ত কোনো চাষী
মুখে তাহার ছড়িয়ে গেছে কতকটা তার হাসি।

কালো চোখের তারা দিয়েই সকল ধরা দেখি,
কালো দতের কালি দিয়েই কেতাব কোরাণ লেখি।
জনম কালো, মরণ কালো, কালো ভূবনময় ;
চাষীদের ওই কালো ছেলে সব করেছে জয়।
সোনায় যে জন সোনা বানায়, কিসের গরব তার?
রঙ পেলে ভাই গড়তে পারি রামধণুকের হার।
সোনা নহে, পিতল নহে, নহে সোনার মুখ-
কালো-বরণ চাষীর ছেলে জুড়ায় যেন বুক |

রামগরুড়ের ছানা

সুকুমার রায়

রামগরুড়ের ছানা           হাসতে তাদের মানা,
হাসির কথা শুনলে বলে,
``হাসব না-না, না-না!''
সদাই মরে ত্রাসে--- ওই বুঝি কেউ হাসে!
এক চোখে তাই মিটমিটিয়ে
তাকায় আশে পাশে।
ঘুম নাহি তার চোখে           আপনি ব'কে ব'কে
আপনারে কয়, ``হাসিস যদি
মারব কিন্তু তোকে!''
যায় না বনের কাছে,           কিম্বা গাছে গাছে,
দখিন হাওয়ার সুড়সুড়িতে
হাসিয়ে ফেলে পাছে!
সোয়াস্তি নেই মনে--- মেঘের কোণে কোণে
হাসির বাষ্প উঠছে ফেঁপে
কান পেতে তাই শোনে!
ঝোপের ধারে ধারে           রাতের অন্ধকারে
জোনাক জ্বলে আলোর তালে
হাসির ঠারে ঠারে।
হাসতে হাসতে যারা           হচ্ছে কেবল সারা,
রামগরুড়ের লাগছে ব্যথা
বুঝছে না কি তারা?
রামগরুড়ের বাসা           ধমক দিয়ে ঠাসা,
হাসির হাওয়া বন্ধ সেথায়,
নিষেধ সেথায় হাসা।

রাখাল

হেলাল হাফিজ

আমি কোনো পোষা পাখি নাকি?
যেমন শেখাবে বুলি
সেভাবেই ঠোঁট নেড়ে যাবো, অথবা প্রত্যহ
মনোরঞ্জনের গান ব্যাকুল আগ্রহে গেয়ে
অনুগত ভঙ্গিমায় অনুকূলে খেলাবো আকাশ,
আমি কোনো সে রকম পোষা পাখি নাকি?

আমার তেমন কিছু বাণিজ্যিক ঋণ নেই,
কিংবা সজ্ঞানে এ বাগানে নির্মোহ ভ্রমণে
কোনোদিন ভণিতা করিনি। নির্লোভ প্রার্থনা
শর্ত সাপেক্ষে কারো পক্ষপাত কখনো চাবো না।

তিনি, শুধু তিনি
নাড়ীর আত্মীয় এক সংগঠিত আর অসহায় কৃষক আছেন
ভেতরে থাকেন, যখন যেভাবে তিনি আমাকে বলেন
হয়ে যাই শর্তাহীন তেমন রাখাল বিনা বাক্য ব্যয়ে।

কাঙাল কৃষক তিনি, জীবনে প্রথম তাকে যখন বুঝেছি
স্বেচ্ছায় বিবেক আমি তার কাছে শর্তাহীন বন্ধক রেখেছি।

রাত্রি

অমিয় চক্রবর্তী

অতন্দ্রিলা,
ঘুমাওনি জানি
তাই চুপিচুপি গাঢ় রাত্রে শুয়ে
বলি, শোনো,
সৌরতারা ছাওয়া এই বিছানায়
-সূক্ষ্মজাল রাত্রির মশারি-
কত দীর্ঘ দু-জনার গোলো সারাদিন,
আলাদা নিশ্বাসে-
এতক্ষণে ছায়া-ছায়া পাশে ছুঁই
কী আশ্চর্য দু-জনে দু-জনা-
অতন্দ্রিলা,
হঠাৎ কখন শুভ্র বিছানায় পড়ে জ্যোৎস্না,
দেখি তুমি নেই।

রুপান্তর

বুদ্ধদেব বসু

দিন মোর কর্মের প্রহারে পাংশু,
রাত্রি মোর জ্বলন্ত জাগ্রত স্বপ্নে |
ধাতুর সংঘর্ষে জাগো, হে সুন্দর, শুভ্র অগ্নিশিখা,
বস্তুপুঞ্জ বায়ু হোক, চাঁদ হোক নারী,
মৃত্তিকার ফুল হোক আকাশের তারা |
জাগো, হে পবিত্র পদ্ম, জাগো তুমি প্রাণের মৃণালে,
চিরন্তনে মুক্তি দাও ক্ষণিকার অম্লান ক্ষমায়,
ক্ষণিকেরে কর চিরন্তন |
দেহ হোক মন, মন হোক প্রাণ, প্রাণে হোক মৃত্যুর সঙ্গম,
মৃত্যু হোক দেহ প্রাণ, মন

রক্তাম্বর-ধারিণী

কাজী নজরুল ইসলাম
["অগ্নিবীণা" থেকে নেওয়া]

রক্তাম্বর পর মা এবার
        জ্ব’লে পুড়ে যাক শ্বেত বসন ।
দেখি ঐ কার সাজে মা কেমন
       বাজে তরবারি ঝনন্-ঝন্ ।

রেখে দিয়ো

মহাদেব সাহা

এখানে তোমাদের এই অশ্রুহীন চোখ,
কয়েক লাইন বিদ্যা মুখস্থ করা গম্ভীর মুখ
আর মলাট চিবানো দাঁত দেখতে দেখতে আমি ক্লান্ত;
আমি তাই হাত বাড়িয়ে আছি তাদের দিকে
যারা ডোবা বিল আর পুকুরে পদ্মফুল ফোটায়,
বাংলা সন-তারিখ দিয়ে চিঠি লেখে;

আমি তোমাদের দিকেই তাকিয়ে আছি, যদি পার
একগুচ্ছ তৃণ আর একফোঁটা অশ্রু
আমার জন্য রেখে দিয়ো;
আমি তার গন্ধে মৃত্যুলোক থেকে জেগে উঠতে পারি।

আজ আর আমার শহরের এই অন্ধ
ফুটপাতের কাছে,
এই সব মুখোশ-পরা মুখের কাছে
কিছুই চাওয়ার নেই;
দাঁত আর নখের গর্বে যারা মত্ত তারা কেন
আমার জন্য কখনো চোখের জল ফেলতে যাবে?

তোমরা যারা ডোবা-বিল খেতখামারের লকলকে
ঘাসের মধ্যে ডুবে আছ,
তোমরা যারা গায়ে মাখ পাকা ধানের গন্ধ,
তাদের বলি, আমার জন্য রেখে দিয়ো
একফোঁটা অশ্রু।

রেশন কার্ড

সুকান্ত ভট্টাচার্য

রঘুবীর একদিন দিতে গিয়ে আড্ডা,
হারিয়ে ফেলল ভুলে রেশনের কার্ডটা;
তারপর খোঁজাখুজি এখানে ও ওখানে,
রঘু ছুটে এল তার রেশনের দোকানে,
সেখানে বলল কেঁদে, হুজুর, চাই যে আটা-
দোকানী বলল হেঁকে, চলবে না কাঁদা-কাঁটা,
হাটে মাঠে-ঘাটে যাও, খোঁজো গিয়ে রাস্তায়
ছুটে যাও আড্ডায়, খোঁজো চারিপাশটায়;
কিংবা অফিসে যাও এ রেশন এলাকার,
আমার মামার পিসে, কাজ করে ছেলে তার,
তার কাছে গেলে পরে সবই ঠিক হয়ে যাবে,
ছ’মাসের মধ্যেই নয়া এক কার্ড পাবে।
রঘুবীর বলে কেঁদে, ছ’মাস কি করব?
ছ’মাস কি উপবাস ক’রে ধুঁকে মরব?
আমি তার করব কী?- দোকানী উঠল রেগে-
যা খুশি তা করো তুমি- বলল সে অতি বেগে;
পয়সা থাকে তো খেও হোটেলে কি মেসেতে,
নইলে সটান্ তুমি যেতে পার দেশেতে।।

রূপকথা

আহসান হাবীব

খেলাঘর পাতা আছে এই এখানে,
স্বপ্নের ঝিকিমিকি আঁকা যেখানে।
এখানে রাতের ছায়া ঘুমের নগর,
চোখের পাতায় ঘুম ঝরে ঝরঝর।
এইখানে খেলাঘর পাতা আমাদের,
আকাশের নীল রং ছাউনিতে এর।
পরীদের ডানা দিয়ে তৈরি দেয়াল,
প্রজাপতি রং মাখা জানালার জাল।
তারা ঝিকিমিকি পথ ঘুমের দেশের,
এইখানে খেলাঘর পাতা আমাদের।
ছোট বোন পারুলের হাতে রেখে হাত,
সাতভাই চম্পার কেটে যায় রাত।
কখনও ঘোড়ায় চড়ে হাতে নিয়ে তীর,
ঘুরে আসি সেই দেশ চম্পাবতীর।
এই খানে আমাদের মানা কিছু নাই,
নিজেদের খুশি মত কাহিনী বানাই।

রসাল ও স্বর্ণলতিকা

মাইকেল মধুসূদন দত্ত

রসাল কহিল উচ্চে স্বর্ণলতিকারে;-
শুন মোর কথা, ধনি, নিন্দ বিধাতারে।
নিদারুণ তিনি অতি;
নাহি দয়া তব প্রতি;
তেঁই ক্ষুদ্র-কায়া করি সৃজিলা তোমারে।
মলয় বহিলে, হায়,
নতশিরা তুমি তায়,
মধুকর- ভরে তুমি পড় লো ঢলিয়া;
হিমাদ্রি সদৃশ আমি,
বন-বৃক্ষ-কুল-স্বামী,
মেঘলোকে উঠ শির আকাশ ভেদিয়া!
দূরে রাখি গাভী-দলে,
রাখাল আমার তলে
বিরাম লভয়ে অনুক্ষণ,-
শুন, ধনি, রাজ-কাজ দরিদ্র পালন!
আমার প্রসাদ ভুঞ্জে পথ-গামী জন।
কেহ অন্ন রাঁধি খায়
কেহ পড়ি নিদ্রা যায
এ রাজ চরণে।
মধু-মাখা ফল মোর বিখ্যাত ভূবনে!
তুমি কি তা জান না ললনে?
দেখ মোর ডাল-রাশি,
কত পাখি বাঁধে আসি
বাসা এ আগারে!
ধন্য মোর জনম সংসারে!
কিন্তু তব দুঃখ দেখি নিত্য আমি দুঃখী
নিন্দ বিধাতায় তুমি, নিন্দ, বিধুমুখী!
নীরবিলা তরুরাজ; উড়িল গগনে
যমদূতাকৃতি মেঘ গম্ভীর স্বননে;
মহাঘাতে মড়মড়ি
রসাল ভূতলে পড়ি
হায়, বায়ুবলে
হারাইল আয়ু-সহ দর্প বনস্থলে!

ঊর্ধ্বশির যদি তুমি কুল মান ধনে;
করিও না ঘৃণা তবু নিচ-শির জনে।