Showing posts with label alk074. Show all posts
Showing posts with label alk074. Show all posts

যে যে কারনে আমি কষ্ট পাই

মহাদেব সাহা

খেতে বসে, ঘুমোতে গিয়ে
হাঁটতে হাঁটতে আমি কষ্ট পাই

কোনোদিন হঠাৎ ইচ্ছে হলে
গোলাপ ছিঁড়তে গিয়ে কষ্ট পাই
আমি কষ্ট পাই আকস্মিক, কথা
বলতে বলতে অপ্রত্যাশিতভাবে
আমি কষ্ট পাই রেস্তরাঁয়, পার্কে,
সিনেমা হলে, পোস্টাপিসের বারান্দায়
সহকর্মীদের পাশে বসে চা খেতে খেতে,
আমি প্রতিদিন বিভিন্নভাবে কষ্ট পাই

কারো সাথে কোনো মনোমালিন্য থেকে নয়,
কখনো কারো কুৎসা বা ভৎসনা শুনেও নয়
বন্ধুদের আপ্যায়নে ও উপেক্ষায় আমি কষ্ট পাই
ছবি দেখার মতো পয়সা না থাকলে
কষ্ট পাই, ছবি দেখতে গিয়েও কষ্ট পাই

অনেকদিন কারো চিঠি না পেলে
আমি কষ্ট পাই,
চিঠি পেয়েও কষ্ট পাই
আমার চোখের মধ্যে সূর্যাস্ত দেখে
আমি কষ্ট পাই
আমি কষ্ট পাই সকালবেলার আলোতে
অন্ধকারেও সারারাত

প্রতিদিন এমনি বহুভাবে কষ্ট পাই,
ফুলের জন্যে, পাখির জন্যে
সামান্য একটা শাদা পয়সার জন্যে
অহেতুক এমনি এমনি আমি
কষ্ট পাই।

মেঘ দেখার দুঃখ, গোলাপ দেখার ব্যাকুলতা

মহাদেব সাহা


কী করে বলি এই মেঘ দেখার দুঃখ, এই গোলাপ দেখার
ব্যাকুলতা-
কিন্তু আমিও যখন মেঘের দিকে তাকাই দেখি কালিদাসই
দেখছেন বিরহী যক্ষকে,
হঠাৎ মন ভরে যায় বহু যুগের ওপার থেকে আসা বর্ষণে:
এই গোলাপ দেখর কথা আমার হয়তো বলাই হবে না
কিন্তু যখান গোলাপের দিকে তাকাই দেখি ব্রেক
তাকিয়ে আছেন গেলোপের রুগ্নতার দিকে,
কিংবা রিলকে আয়ত্ত করে চলেছেন একটি শ্বেতগোলাপ,
কী করে বলি এই মেঘ দেখার দুঃখ, এই
গোলাপ দেখার ব্যাকুলতা!
মেঘ দেখতে দেখতে আমি যে কখন মেঘদূতের ভেতর ডুবে যাই,
বিরহকাতর যক্ষের জন্য ভারী হয়ে ওঠে এই বুক
কিংবা গোলাপের দিকে তাকাতেই চোখে ভেসৈ ওঠে
রিলকের মুখটি,
এই মেঘ দেখার দুঃখ, এই গোলাপ দেখার ব্যাকুলতা
কাউকে বলাই হবে না ;
আমি যখন এই প্রকৃতির দিকে তাকাই দেখি রবীন্দ্রনাথ
দেখছেন প্রকৃতির নীলাম্বরী
সেই ব্যকুল বসন্তে আমারও দুচোখ জলে ভরে যায় -
এই মেঘ, এই গোলাপ আমারও অলিখিত কবিতা।
যখন মানুষের সুদ্ধতার কথা ভাবি দেখি দাঁড়িয়ে আছেন
ব্যথিত বোদলেয়ার
শহরের রাত্রির দিকে তাকালে মনে হয় জীবনানন্দ দাশ দেখছেন
লিবিয়ার জঙ্গল,
যখন একজন বিপ্লবীর দিকে তাকাই দেখি দুচোখে
মায়াকোভস্কির স্বপ্ন
আর্ত স্বদেশের দিকে তাকিয়ে আমিও নেরুদার কথাই ভাবি,
কেউ জানে না একটি ফুলের মৃত্যু দেখে, একটি পাখির ক্রন্দন দেখে
আমারও হৃদয় পৃথিবীর আহত কবিদের মতোই হাহাকার
করে ওঠে।
একটি ফুল দেখে আমিও একজন প্রেমিকের মতোই পরাজিত
হতে ভালোবাসি
একটি ঝরাফুলের দুঃখ বুকে নিয়ে যে-কোনো ব্যথিত কবির
মতোই সারাদনি ঘুরে বেড়াই,
আসলে সে-কথাগুলোই বলা হয়নি, বলা হয়নি;
মানুষের সমাজে এই বৈষম্য দেখে আমিও একজন
বিপ্লবীর মতোই শ্রেনীসংগ্রামের জন্য তৈরি হই,
এই জরা বার্ধক্য দেখে কতোবার বুদ্ধের মতোই
ব্যথিত হয়ে উঠি;
কিন্তু কী করে বলবো এইসব মেঘ দেখার দুঃখ, এইসব
গোলাপ দেখার ব্যাকুলতা!

পক্ষপাত

মহাদেব সাহা

আমি কার দিকে? ঠিক কিসের সপক্ষে?
হত্যাকারীর দিকে নাকি হত মানুষের দিকে,
আমি কি শান্তির পক্ষে, আমি কি শিল্পের পক্ষে
নাকি আমি ধ্বংসের পক্ষেই?

আমি কি গোলাপ চাই, সংসারে সুস্থতা চাই
সভ্যতার শুশ্রূষাকে চাই
নাকি আমি দুঃখ চাই, দুর্ভোগ দুর্দশা চাই, নিষ্ঠুরতা চাই?
আমি ঠিক কিসের সপক্ষে
না সংসারের দিকে, না গেরুয়া সন্ন্যাসে!

আমি কি প্রেমের দিকে, না আমি হিংসার দিকে,
আমি খুব ব্যক্তিগত
না আমি সমাজে?

আমি কি রাজার, নাকি ভিক্ষুকের

আমি কার দিকে, কিসের সপক্ষে

আমি কেউ নই

মহাদেব সাহা

আমি কেউ নই, আমি শরীরের
ভেতরে শরীর
গাছের ভেতরে গাছ,
এই অনন্ত দিনরাত্রির মধ্যে একটি বুদ্বুদ;
আমি মানুষের মতো কিন্তু মানুষ নই
শুধু মুখচ্ছবি
মানুষের একটি আদল
ছঅয়ার মানুষ;
আমি কেউ নই, কোননোকিছু নই
আমি মানুষের মতো
এক মুখোশ মানুষ
হয়তো জন্মেই মৃত আমি, হয়তো এখন
কেবল ছায়া,
মানুষের মতো
এই ছঅয়া-মানুষ;
আমি কেউ নই, আমি কোনোকিছু নই,
আমি ছায়ার ভেতরে শরীর
আমি কেউ নই, আমি মানুষের ভেতরে
মানুষ, ভেতর-মানুষ।

দ্বিধা

মহাদেব সাহা

আমি এখনো বহু বিষয়ে মন ঠিক করতে পারিনি
যেমন কোনোদিন আমি বিয়ে করবো কি করবো না
অথবা কোনোদিন যাবো কি না বেশ্যালয়ে
কাউকে কখনো খুন করবো কি,
কোনোদিন চরস খেয়ে পড়ে থাকবো কিনা রাস্তায়
অথবা কিনা কোনো ফকির দরবেশের সাথে চলে
যাবো ধর্মশালায়
কোনো একদিন লাটভবনের সামনে দাঁড়িয়ে আমাদের এই দুঃখ-
ধান্ধার জন্যে
খুব চেঁচিয়ে গালাগাল করবো কি না
একদিন সারারাত ঢিল ছুঁড়ে ভাঙবো কিনা ডিআইটি-র ঘরি
কোনোদিন সন্ধ্যেবেলা
পাওয়ার হাউসের সুইচটা টিপে
সারা শহরে বাধিয়ে দেবো কি না ভুতুরে কান্ড
……………………………….
……………………………….
মতিঝিলের বাণিজ্য এলাকায় পর পর কয়েক সপ্তাহ চালাবো
কিনা হরতাল
অথবা সস্তা জনসেবার বক্তৃতা দিয়ে নিজের আখের গোছাবো কিনা
নাকি হুজুর হুজুর করে কাটিয়ে দেবো জীবনটা
সত্যি কোনোদিন আমি এই দায়িত্বশীল লোকটা
যাচ্ছেতাই একটা কিছু করে বসবো কিনা
এমনি বহু বিষয়ে আমি এখনো মন ঠিক করতে পারিনি-

তোমরা কেমন আছ

মহাদেব সাহা

তোমরা কেমন আছো হে আমার গভীর রাতের আহত কবিরা
তোমরা কেমন আছো
কেমন আছো আমার ফেলে আসা কবিতা তুমি কেমন আছো, কেমন
আছো তোমরা সখ দুঃখ, তোমরা তোমরা?
আমি বহুদিন তোমাদের ফেলে এসেছি, মধ্যরাতের চাঁদ তোমাদের
তোমরা কেমন আছো, সবাই কেমন আছো, তোমরা সব্বাই?
আমি বেশ কিছুকার তোমাদের সঙ্গছাড়া, বেশ কিছুকাল
অলস নিদ্রায়, অসুখে, আচ্ছন্নতায় শুয়ে আছি, শুয়ে আছি
তোমাদের সকলের স্নান, সন্ধ্যালাপ, প্রত্যুষের উপাসনা মন্তর
আমার মনে পড়ে, হে পাখি, বসন্তরাত্রির একলা কোকিল
তোমাদের
শহরের সব নার্সারীর প্রত্যহ দর্শক তোমরা, পানশালার
নিমগ্ন প্রেমিক
ভবঘুরে, ছন্নছাড়া, ভাই, তোমরা কেমন আছো
নারী তুমি কেমন আছো, বৃক্ষ তুমি কেমন আছো, কেমন,
শস্য তুমি আছো, নদী তুমি আছো,
তোমাদের নিজস্ব স্বভাবে আজো তোমরা কবি।
তবু একবার বলো, তুমি বলো, তোমরা বলো, বলো
নারী তোমরা কেমন আছো, বৃক্ষ তোমরা কেন আছো,
তোমরা কেমন আছো, মানুষ?

আমার এ-ভয় অন্যরকম

মহাদেব সাহা

তোমরা সবাই ভয় পাও এই বাইরে যেতে
দুয়ার খুলে বাইরে যেতে
পথ পেরোতে
গাড়ির ভিড়ে বড়ো রাস্তা পার হতে যেই পা বাড়ালে

এ জীবন আমার নয়

মহাদেব সাহা

এ জীবন আমার নয়, আমি বেঁচে আছি
অন্য কোনো পাখির জীবনে,
কোনো উদ্ভিদের জীবনে আমি বেঁচে আমি
লতাগুল্ম-ফুলের জীবনে;
মনে হয় চাঁদের বুকের কোনো আদিম পাথার আমি
ভস্মকণা,
ভাসমান একটু শ্যাওলা আমি;
এই যে জীবন দেখছো এ জীবন আমার নয়
আমি বেঁচে আছি বৃক্ষের জীবনে,
পাখি, ফুল, ঘাসের জীবনে।
আমি তো জন্মেই মৃত, বেঁচে আছি
অন্য এক জলের উদ্ভিদ-
আমার শরীর এইসব সামদ্রিক প্রাণীদের
সামান্য দেহের অংশ,
আমি কোটি কোটি বছরের পুরাতন একটি
বৃক্ষের পাতা
একবিন্দু প্রাণের উৎস, জীবনের
সামান্য একটি কোষ;
এ জীবন আমার নয় আমি সেইসব অন্তহীন
জীবনের একটি জীবন,
আমি বেঁচে আছি অন্য জীবনে, অন্য
স্বপ্ন-ভালোবাসায়।

মনে পড়ে

মহাদেব সাহা

এখন শুধু মনে পড়ে আর মনে পড়ে
মনে পড়ে মেঘ, মনে পড়ে চাঁদ,
জলের ধারা কেমন ছিলো-
সেসব কথাই মনে পড়ে;
এখন শুধু মনে পড়ে, নদীর কথা মনে পড়ে,
তোমার কথা মনে পড়ে,
এখন এই গভীর রাতে মনে পড়ে
তোমার মুখ, তোমার ছায়া,
তোমার বাড়ির ভেতর-মহল,
তোমার উঠোন, সন্ধ্যাতারা
এখন শুধু মনে পড়ে, তোমার কথা মনে পড়ে;
তোমার কথা মনে পড়ে
অনেক কথা মনে পড়ে,
এখন শুধু মনে পড়ে, এখন শুধু মনে পড়ে;
এখন শুধু মনে পড়ে আর মনে পড়ে
আকাশে মেঘ থেকে থেকে
এখন বুঝি বৃষ্টি ঝরে।

মানুষের বুকে এতো দীর্ঘশ্বাস

মহাদেব সাহা

কেউ জানেনা একেকেটি মানুষ বুকের মধ্যে কী গভীর দীর্ঘশ্বাস নিয়ে বেড়ায়-
কোনো বিষন্ন ক্যাসেটেও এতো বেদনার সংগ্রহ নেই আর,
এই বুকের মধ্যে দীর্ঘশ্বাসের পর দীর্ঘশ্বাস যেন একখানি অন্তহীন প্রগাঢ় এপিক!
পাতায় পাতায় চোখের জল সেখানে লিপিবদ্ধ
আর মনোবেদনা সেই এপিকের ট্রাজিক মলাট;
মানুষের বুকে এতো দীর্ঘশ্বাস, এতো দীর্ঘশ্বাস, কে জানতো!

দীর্ঘশ্বাসভরা এই বুকের চেয়ে শীতপ্রধান বিপন্ন অঞ্চল আর কোথাও নেই,
এমন হলুদ, ধূসর আর তুষারবৃত!
একেকটি মানুষ বুকের মধ্যে কী গভীর দীর্ঘশ্বাস নিয়ে বেড়ায়, কেউ জানে না
হঠাৎ একসঙ্গে অসংখ দুঃখ যদি কখনো কেঁদে ওঠে কিংবা যদি
প্রাচীন শিলালিপি থেকে সব শোকের গান সশব্দে বেজে যায়,
তাহলে যেমন মধ্যাহ্নের আকাশ সহসা দুঃখে ম্লান হয়ে যাবে
গোলাপ হবে কৃষ্ণবর্ণ, তার চেয়েও বিষন্নতা নেমে আসবে
মানুষের বুক থেকে এই দীর্ঘশ্বাস যদি বৃষ্টির মতো ঝরে পড়ে।

তেমন সম্ভাবনা আছে বলেই মানুষ বুকের মধ্যে দীর্ঘশ্বাস চেপে রাখে
তার চোখে নিয়তই জল ঝরে তবু দেখা যায় না;

মানুষের ভেতর কতো যে দীর্ঘশ্বাস, জমাট বেঁধে আছে
কতো যে ক্রন্দন, পাতা ঝরার শব্দ, মৃত্যুসংবাদ
মানুষের বুকের মধ্যে ব্যথিত ব্যাকুল ইতিহাস আর আহত সভ্যতা
মেঘের মতো ঘনীভূত হতে হতে একেকটি মর্মান্তিক দীর্ঘশ্বাস হয়ে আছে
মানুষ তাকে বয়ে বয়ে দগ্ধ বেঁচে থাকে;
একেকটি মানুষ বুকের মধ্যে কী গভীর দীর্ঘশ্বাস বয়ে বেড়ায়, কেউ জানে না
একেকটি মানুষ নিজের মধ্যে কীভাবে নিজেই মরে যায়, হায়, কেউ জানে না!

শুদ্ধ করো আমার জীবন

মহাদেব সাহা

তুমি শুদ্ধ করো আমার জীবন, আমি প্রতিটি ভোরের মতো
আবার নতুন হয়ে উঠি,
হই সূর্যোদয়
আমার জীবন তুমি পরিশুদ্ধ করো, আমি প্রস্ফুটিত হই
আমি বহুদিন ঝরা ব্যথিত বকুল অন্ধকারে, আমি বহুদিন
বিষন্ন বিধুর ;
একবার আমার মাথায় হাত রাখো, সুপ্রসন্ন হও
এই দগ্ধ বুকে করো শ্রাবণের অঝোর বর্ষণ
আমি শ্যামল সবুজ বৃক্ষ হয়ে উঠি ।
তুমি শুদ্ধ করো আমার জীবন, আমি হই সূর্যোদয়,
আমি হই উদিত আকাশ
আমি হয়ে উঠি প্রতিটি শিশুর হাতে প্রথম বানান শেখা বই,
হয়ে উঠি ভোরবেলাকার পাখিদের গান ;
আমার জীবন তুমি শুদ্ধ করো, আমি হই নতুন সবুজ
কোনো দ্বীপ,
আমি হই বর্ষাকাল, আমি হই বরষার নব জলধারা
আমি বহুদিন ব্যথিত বিষাদ, আমি বহুদিন একা
ঝাউবন ।
তুমি শুদ্ধ করো আমার জীবন, আমি হয়ে উঠি সদ্যফোটা ফুল
আমি হয়ে উঠি সকালের ঘুমভাঙ্গা চোখ ।

বর্ষা বৃষ্টি কিংবা ভালোবাসার কবিতা

মহাদেব সাহা

এই একখন্ড সাদা কাগজের উপর মেঘ এসে যখন দাঁড়ায়
তখন প্রতিটি অক্ষর হয়ে ওঠে একেকটি বৃষ্টির ফোঁটা,
শব্দগুলি বর্ষাকাল
গুঁড়ি গুঁড়ি বৃষ্টি বিন্দু বিন্দু অশ্রুর কবিতা।
মেঘ ভাঙতে ভাঙতে দক্ষিণ গোলার্ধ থেকে
উত্তর গোলার্ধে যায়।
সাদা কাগজের উপর পড়ে থাকে স্মৃতি,
ভালোবাসার গন্ধ
আমি হাত বাড়িয়ে সেই মেঘবৃষ্টির স্বর্ণমুদ্রা কুড়াতে থাকি,
এই শাদা কাগজ মূহুর্তে হয়ে ওঠে বিরহী মেঘদুত
অথই গীতবিতান।
কাগজ আবিষ্কারের পূর্বে মানুষ প্রেমের কবিতা
লিখে রেখেছে আকাশে
সেই ভালোবাসার কবিতা এই বৃষ্টি,
এই ভরা বর্ষা।

বন্ধুর জন্য বিজ্ঞাপন

মহাদেব সাহা

আমি একটি বন্ধু খুঁজছিলাম যে আমার
পিতৃশোক ভাগ করে নেবে, নেবে
আমার ফুসফুস থেকে দূষিত বাতাস;

চিঠি দিও

মহাদেব সাহা

করুণা করে হলেও চিঠি দিও, খামে ভরে তুলে দিও
আঙ্গুলের মিহিন সেলাই
ভুল বানানেও লিখো প্রিয়, বেশি হলে কেটে ফেলো তাও,
এটুকু সামান্য দাবি, চিঠি দিও, তোমার শাড়ির মতো
অক্ষর পাড়-বোনা একখানি চিঠি।

চুলের মতন কোনো চিহ্ন দিও বিস্ময় বোঝাতে যদি চাও ...
বর্ণণা আলস্য লাগে তোমার চোখের মতো চিহ্ন কিছু দিও!
আজো তো অমল আমি চিঠি চাই, পথ চেয়ে আছি,
আসবেন অচেনা রাজার লোক
তার হাতে চিঠি দিও, বাড়ি পৌঁছে দেবে ....
এমন ব্যস্ততা যদি শুদ্ধ করে একটি শব্দই শুধু লিখো, তোমার কুশল! ...

করুণা করে হলেও চিঠি দিও, ভুলে গিয়ে ভুল করে একখানি চিঠি
দিও খামে
কিছুই লেখার নেই তবু লিখো একটি পাখির শিস
একটি ফুলের ছোট নাম,
টুকিটাকি হয়তো হারিয়ে গেছে কিছু হয়তো পাওনি খুঁজে
সেইসব চুপচাপ কোন দুপুরবেলার গল্প
খুব মেঘ করে এলে কখনো কখনো বড় একা লাগে, তাই লিখো

করুণা করে হলেও চিঠি দিও, মিথ্যা করে হলেও বোলো, ভালবাসি

কফিন কাহিনী

মহাদেব সাহা

চারজন দেবদূত এসে ঘিরে আছে একটি কফিন
একজন বললো দেখো ভিতরে রঙিন
রক্তমাখা জামা ছিলো হয়ে গেছে ফুল
চোখ দুটি মেঘে মেঘে ব্যথিত বকুল !

চারজন দেবদূত এসে ঘিরে আছে এক শবদেহ
একজন বললো দেখো ভিতরে সন্দেহ
যেমন মানুষটি ছিলো মানুষটি নাই
মাটির মানচিত্র হয়ে ফুটে আছে তাই !

চারজন দেবদূত এসে ঘিরে আছে একটি শরীর
একজন বললো দেখো ভিতরে কী স্থির
মৃত নয়, দেহ নয়, দেশ শুয়ে আছে
সমস্ত নদীর উৎস হৃদয়ের কাছে !

চারজন দেবদূত এসে ঘিরে আছে একটি কফিন
একজন বললো দেখো ভিতরে নবীন
হাতের আঙুলগুলি আরক্ত করবী
রক্তমাখা বুক জুড়ে স্বদেশের ছবি !

রেখে দিয়ো

মহাদেব সাহা

এখানে তোমাদের এই অশ্রুহীন চোখ,
কয়েক লাইন বিদ্যা মুখস্থ করা গম্ভীর মুখ
আর মলাট চিবানো দাঁত দেখতে দেখতে আমি ক্লান্ত;
আমি তাই হাত বাড়িয়ে আছি তাদের দিকে
যারা ডোবা বিল আর পুকুরে পদ্মফুল ফোটায়,
বাংলা সন-তারিখ দিয়ে চিঠি লেখে;

আমি তোমাদের দিকেই তাকিয়ে আছি, যদি পার
একগুচ্ছ তৃণ আর একফোঁটা অশ্রু
আমার জন্য রেখে দিয়ো;
আমি তার গন্ধে মৃত্যুলোক থেকে জেগে উঠতে পারি।

আজ আর আমার শহরের এই অন্ধ
ফুটপাতের কাছে,
এই সব মুখোশ-পরা মুখের কাছে
কিছুই চাওয়ার নেই;
দাঁত আর নখের গর্বে যারা মত্ত তারা কেন
আমার জন্য কখনো চোখের জল ফেলতে যাবে?

তোমরা যারা ডোবা-বিল খেতখামারের লকলকে
ঘাসের মধ্যে ডুবে আছ,
তোমরা যারা গায়ে মাখ পাকা ধানের গন্ধ,
তাদের বলি, আমার জন্য রেখে দিয়ো
একফোঁটা অশ্রু।

মন ভালো নেই

মহাদেব সাহা

বিষাদ ছুঁয়েছে আজ, মন ভালো নেই,
মন ভালো নেই;
ফাঁকা রাস্তা, শূন্য বারান্দা
সারাদিন ডাকি সাড়া নেই,
একবার ফিরেও চায় না কেউ
পথ ভুলকরে চলে যায়, এদিকে আসে না
আমি কি সহস্র সহস্র বর্ষ এভাবে
তাকিয়ে থাকবো শূন্যতার দিকে?
এই শূন্য ঘরে, এই নির্বসনে
কতোকাল, আর কতোকাল!
আজ দুঃখ ছুঁয়েছে ঘরবাড়ি,
উদ্যানে উঠেচে ক্যাকটাস্ত
কেউ নেই, কড়া নাড়ার মতো কেউ নেই,
শুধু শূন্যতার এই দীর্ঘশ্বাস, এই দীর্ঘ পদধ্বনি।
টেলিফোন ঘোরাতে ঘোরাতে আমি ক্লান্ত
ডাকতে ডাকতে একশেষ;
কেউ ডাক শোনে না, কেউ ফিরে তাকায় না
এই হিমঘরে ভাঙা চেয়ারে একা বসে আছি।
এ কী শান্তি তুমি আমাকে দিচ্ছো ঈশ্বর,
এভাবে দগ্ধ হওয়ার নাম কি বেঁচে থাকা!
তবু মানুষ বেঁচে থাকতে চায়, আমি বেঁচে থাকতে চাই
আমি ভালোবাসতে চাই, পাগলের মতো
ভালোবাসতে চাই-
এই কি আমার অপরাধ!
আজ বিষাদ ছুঁয়েছে বুক, বিষাদ ছুঁয়েছে বুক
মন ভালো নেই, মন ভালো নেই;
তোমার আসার কথা ছিলো, তোমার যাওয়ার
কথা ছিল-
আসা-যাওয়ার পথের ধারে
ফুল ফোটানো কথা ছিলো
সেসব কিছুই হলো না, কিছুই হলো না;
আমার ভেতরে শুধু এক কোটি বছর ধরে অশ্রুপাত
শুধু হাহাকার
শুধু শূন্যতা, শূন্যতা।
তোমার শূন্য পথের দিকে তাকাতে তাকাতে
দুই চোখ অন্ধ হয়ে গেলো,
সব নদীপথ বন্ধ হলো, তোমার সময় হলো না-
আজ সারাদিন বিষাদপর্ব, সারাদিন তুষারপাত-
মন ভালো নেই, মন ভালো নেই।

আপন মানুষদের কাছে ফিরে যাবো

মহাদেব সাহা

এখানে মানুষ থাকে, এই নির্দয় নিষ্প্রাণ দেশে,
এই লৌহপুরীতে?
এই শহরের ভিড়ে পাখিদের ওড়াউড়ি নেই,
গাভীর হাম্বা রব কখনো শুনি না;
শুধু অচেনা মানুষের কোলাহল, গাড়ির কর্কশ শব্দ

বাড়ির উঠানে এখানে ওঠে না চাঁদ, নদীময় তারাভরা
দেখি না আকাশ
জুড়ায় না ক্লান্ত দেহ দখিনা বাতাস

এখানে মানুষেরা এক সাথে হেঁটে যায় কেই কাউকে চেনে না, মানুষ
এখানে থাকে?
ঢের হয়েছে বিদ্যা, ঢের হয়েছে প্রাপ্তি, তবু যেটুকু জীবন
আছে, বুকে নিয়ে
এবার আপন মানুষদের কাছে ফিরে যাবো, গলা
ছেড়ে ডাকবো বাহার কাকা,
কানু ভাই তোমরা কোথায়?
ছি, এখানে মানুষ থাকে, এই সোনার খাঁচায়, ইটের জঙ্গলে,
বন্দিশালায়
হোটেলের বদ্ধ ঘরে, ফ্ল্যাট বাড়ির চার দেয়ালের মধ্যে
বৈদ্যুতিক আলোর এই অন্ধকারে,
এই স্নেহহীন, মায়াহীন, জলবায়ু শুন্য জতুগৃহে?
কতোদিন শুনি না ঘুঘুর ডাক, রাখালের বাঁশি,
টানা বাতাসের শব্দ
দেখিনা সবুজ মাঠ, উধাও দিগন্ত
ঘরের পিছনের ছোট্ট জংলায় দোয়েলের উড়াউড়ি,
কোথাও দেখিনা একটি ধানের শীষে গঙ্গাফড়িং,
লাউ জাংলার পাশে স্থলপদ্ম,
এখানে কী পেয়েছি প্রচুর সুখ, পেয়েছি প্রচুর শান্তি,

এবার অর্ধেক মানুষ আমি খুইয়ে এখানে
সব অনুভুতি, শুদ্ধতা, আনন্দ
সেই আপন মানুষদের কাছে ফিরে যাবো।
সেই বন্ধুগাছ, বন্ধুপাখি, ডোবার কচুরি ফুল,
সেই কাদামাটি জলে ভেজা বাড়ি
কাজলাদিদির কথা লেখা সেই পাঠ্যবই, তোমাদের কারো
কিছুই জানি না;
পাখিরা যেমন আপন পাখিদের সাথে মিশে যায়
আমিও তেমনি আপন মানুষদের মাঝে মিশে যাবো
প্রিয় বৃক্ষ, প্রিয় নদী, আপন মানুষ।