Showing posts with label . Show all posts
Showing posts with label . Show all posts

মাতৃভক্তি

কালিদাস রায়

বায়েজিদ বোস্তামী-
শৈশব হতে জননীর সেবা করিতেন দিবাযামী।
দুপুর রাত্রে জননী জাগিয়া ডাকিলেন,'বাছাধন,
বড়ই পিয়াস পানি দাও' বলি মুদিলেন দু'নয়ন।
দেখিল বালক ঘরের কোণের কলসিতে নেই পানি,
বহুদূর পথ ঝরনা হইতে কলসি ভরিয়া আনি।

মায়ের তৃষ্ণা মিটাইবে বলি গভীর অন্ধকারে
ছুটিয়া বাহির হইল একাকী কলসি লইয়া ঘাড়ে।

জল ঢালি পিয়ালায়
সুপ্তা মাতার নয়ন শিয়রে দাঁড়ায়ে রহিল ঠায়।
ভাঙালে নিদ্রা হবে অপরাধ, কখন ভাঙিবে নিঁদ,
সেই ভরসায় পানি হাতে খাঁড়া রহিল যে বায়েজিদ।

পূর্ব গগন ফর্সা হইল,ডাকিয়া উঠিল পাখি,
জননী মেলিল আঁখি।
দেখিল শিয়রে দাঁড়ায়ে রয়েছে দশ বছরের ছেলে
পানি হাতে কেন, বুঝিল না মাতা প্রথম নয়ন মেলে।
সহসা পড়িল মনে,
গভীর রাতে পিপাসায় পানি চেয়েছিল বাছাধনে।
কহিল মা, মরি মরি!
বাছারে আমার, পানি হাতে করে সারা রাত্রটি ধরি
দাঁড়াইয়া আছ? ঘুমাওনি আজ?' চোখে এল জল ভরি।
পুত্রেরে কোলে নিয়ে মা চুমিল বার বার মুখখানি।
কহিল জননী,'নয়নের মণি, সাধারণ শিশু নও,
খোদার দোয়ার বরকতে তুমি জগতপূজ্য হও।
পুত্র গরবে গর্বিত বুকে,খোদা, স্মরি তব নাম,
তোমারে আমার জীবনের এই সম্বল সঁপিলাম।'
বিফল হয়নি মায়ের আশিস, হৃদয়ের প্রার্থনা
জগৎ-বন্দ্য জ্ঞানগুরুদের বায়েজিদ একজনা।

মানুষের মানচিত্র ১

রুদ্র মুহাম্মদ শহীদুল্লাহ্

আহারে বৃষ্টির রা, সোহাগি লো, আমি থাকি দূর পরবাসে।
কান্দে না তোমার বুকে একঝাঁক বুনোপাখি অবুঝ কৈতর?
কেমনে ফুরায় নিশি? বলো সই, কেমনে- বা কাটাও প্রহর?
পরাণ ছাপায়ে নামে বাউরি বাতাস, দারুণ বৃষ্টির মাসে।

যে বলে সে বলে কথা, কাছে বসে, হাতে খিলিপান দিয়ে কয়-
এতো জল ঝরে তবু পরান ভেজে না কেন, কও তো মরদ?
দুয়ারে লাগায়ে খিল যদি কেউ থাকে তারে কে দেবে দরদ।
শরীরের মোহনায় দেখি তার বুনো ঢেউ রক্ত-মাংসময়।

শরীর গুটায়ে রাখি, শামুকের মতো যাই গুটায়ে ভেতরে।
অন্ধকার চিরে চিরে বিজুলির ধলা দাঁত উপহাসে হাসে,
আমি বলি- ক্ষমা দাও, পরান বন্ধুয়া মোর থাকে পরবাসে,
দেহের রেকাবি খুলে পরানের খিলিপান কে খাওয়াবে তোরে।

গতবার আষাঢ়ও পার হয়ে গেলো তাও নামে না বাদল,
এবার জ্যোষ্ঠিতে মাঠে নেমে গেছে কিষানের লাঙল-জোয়াল।
আমাদের মাঝে দেখো জমির ভাগের মতো কতো শত আল্,
এই দূর পরবাস কবে যাবে? জমিনের আসল আদল।
কবে পাবো? কবে পাবো আল্ হীন একখণ্ড মানব-জমিন?
পরবাস থাকবে না, থাকবে না দূরত্বের এই রীতি-নীতি।
মহুয়ার মদ খেয়ে মত্ত হয়ে থাকা সেই পার্বনের তিথি
কবে পাবো? কবে পাবো শর্তহীন আবাদের নির্বিরোধ দিন?

মনে পড়ে সুদূরের মাস্তুল

রুদ্র মুহাম্মদ শহীদুল্লাহ্

পেছনে তাকালে কেন মূক হয়ে আসে ভাষা !
মনে পড়ে সেই সব দুপুরের জলাভূমি,
সেই সব বেতফল, বকুল কুড়ানো ভোর,
আহা সেই রাঙাদির আঁচলতলের উত্তাপ,
মনে পড়ে...

মনে পড়ে, বন্দরে সেই সব কালোরাত,
ঈগলের মতো ডানা সেই বিশাল গভীর রাতে,
একটি কিশোর এসে চুপি চুপি সাগরের কূলে
দাঁড়াতো একাকী
তন্ময় চোখে তার রাশি রাশি বিস্ময় নিয়ে।

কবে তারে ডাক দিয়ে নিয়ে গেলো যৌবন সুচতুর,
কবে তারে ডেকে নিলো মলিন ইটের কালো সভ্যতা !

সবুজ ছায়ার নিচে ঘুমে চোখ ঢুলে এলে
মা যাকে শোনাতো সেই তুষারদেশের কথা,
তার চোখে আজ এতো রাতজাগা ক্লান্তির শোক !

পেছনে তাকালে কেন নিরবতা আসে চোখে !
মনে পড়ে- জ্যোৎস্নায় ঝলোমলো বালুচর,
একটি কিশোর- তার তন্ময় দুটি চোখে
রাশি রাশি কালোজল- সুদূরের মাস্তুল
মনে পড়ে...

মেয়েদের পদবী

সুকান্ত ভট্টাচার্য

মেয়েদের পদবীতে গোলমাল ভারী,
অনেকের নামে তাই দেখি বাড়াবাড়ি;
‘আ’কার অন্ত দিয়ে মহিলা করার
চেষ্টা হাসির। তাই ভূমিকা ছড়ার।
‘গুপ্ত’ ‘গুপ্তা’ হয় মেয়েদের নামে,
দেখেছি অনেক চিঠি, পোষ্টকার্ড, খামে।
সে নিয়মে যদি আজ ‘ঘোষ’ হয় ‘ঘোষা’,
তা হলে অনেক মেয়ে করবেই গোসা,
‘পালিত’ ‘পালিতা’ হলে ‘পাল’ হলে ‘পালা’
নির্ঘাৎ বাড়বেই মেয়েদের জ্বালা;
‘মল্লিক’ ‘মল্লিকা’, ‘ দাস’ হলে ‘দাসা’
শোনাবে পদবীগুলো অতিশয় খাসা;
‘কর’ যদি ‘করা’ হয়, ‘ধর’ হয় ‘ধরা’
মেয়েরা দেখবে এই পৃথিবীটা- “সরা”।
‘নাগ’ যদি ‘নাগা’ হয় ‘সেন’ হয় ‘সেনা’
বড়ই কঠিন হবে মেয়েদের চেনা।।

মা

কাজী কাদের নেওয়াজ

মা কথাটি ছোট্ট অতি,
কিন্তু জেনো ভাই,
ইহার চেয়ে নামটি মধুর
তিন ভূবনে নাই।

সত্য ন্যায়ের ধর্ম থাকুক
মাথার’ পরে আজি
অন্তরে মা থাকুক মম
ঝরুক স্নেহরাজি।

রোগ-বিছানায় শুয়ে শুয়ে
যন্ত্রণাতে মরি
সান্তনা পাই মায়ের মধু
নামটি হৃদে স্মরি।

বিদেশ গেলে ঐ মধু নাম
জপ করি অন্তরে,
মন যে কেমন করে আমার
প্রাণ যে কেমন করে।

মা যে আমায় ঘুম পাড়াত
দোলনা ঠেলে ঠেলে,
শীতল হতো প্রাণটা মায়ের
হাতটা বুকে পেলে।

মাগো, আমি বিদেশ থেকে
দিচ্ছি তোমায় চিঠি,
কেমন আছ জানতে চাহি,
দেখতে চাহি দিঠি।

তোমায় স্মরি চোখ ফেটে মোর
অশ্রু যে আজ ঝরে,
প্রাণ যে কেমন করে আমার
মন যে কেমন করে।

মাধবিকা

যতীন্দ্র মোহন বাগচী

দখিন হাওয়া---রঙিন হাওয়া, নূতন রঙের ভাণ্ডারী,
জীবন-রসের রসিক বঁধু, যৌবনেরি কাণ্ডারী!
সিন্ধু থেকে সদ্দ বুঝি আসছ আজি স্নান করি'---
গাং-চিলেদের পক্ষধ্বনির শন্ শনানির গান্ ধরি' ;
মৌমাছিদের মনভুলানি গুনগুনানির সুর ধরে'---
চললে কোথায় মুগ্ধ পথিক, পথটি বেয়ে উত্তরে?

অনেক দিনের পরে দেখা, বছর-পারের সঙ্গী গো,
হোক্ না হাজার ছাড়াছাড়ি, রেখেছ সেই ভঙ্গি তো!
---তেমনি সরস ঠাণ্ডা পরশ, তেমনি গলার হাঁকটি , সেই
দেখতে পেলেই চিনতে পারি, কোনোখানেই ফাঁকটি নেই!
---কোথায় ছিলে বন্ধু আমার, কোন্ মলয়ের বন ঘিরে,'
নারিকেলের কুঞ্জে-বেড়া কোন্ সাগরের কোন্ তীরে!
লকলকে সেই বেতসবীথির বলো তো ভাই কোন্ গলি,
এলা-লতার কেয়াপাতার খবর তো সব মঙ্গলই?

---ভালো কথা, দেখলে পথে সবাই তোমায় বন্দে তো,---
বন্ধু বলে' চিনতে কারো হয়নি তো ভাই সন্দেহ?
নরনারী তোমার মোহে তেমনি তো সব ভুল করে---
তেমনিতর পরস্পরের মনের বনে ফুল ধরে!
আসতে যেতে দীঘির পথে তেমনি নারীর ছল করা ;
পথিকবধুর চোখের কোণে তেমনি তো সেই জলভরা?
*      *      *      *      *      *
রঙ্গনে সেই রং তো আছে, অশোকে তাই ফুটছে তো,
শাখায় তারি দুলতে দোলায় তরুণীদল জুটছে তো?
তোমায় দেখে' তেমনি দেখে উঠছে তো সব বিহঙ্গ,
সবুজ ঘাসের শীষটি বেয়ে রয় তো চেয়ে পতঙ্গ?

তেমনি---সবই তেমনি আছে! --- হ'লাম শুনে' খুব খুশী,
প্রাণটা ওঠে চনচনিয়ে, মনটা ওঠে উসখুসি', ---
নূতন রসে রসল হৃদয়, রক্ত চলে চঞ্চলি', ---
বন্ধু তোমায় অর্ঘ্য দিলাম উচ্ছলিত অঞ্জলি |
গ্রহণ করো, গ্রহণ করো---বন্ধু আমার দণ্ডেকের---
জানিনাক আবার কবে দেখা তোমার সঙ্গে ফের ||

মায়ের প্রতি

কুসুমকুমারী দাশ

[প্রবাসী, ৬ষ্ট ভাগ, ২য় সংখ্যা, জ্যৈষ্ঠ ১৩১৩]

তোমার বন্দিনী মূর্তি ফুটিল যখন,
            দীপ্ত দিবালোকে,
সহস্র ভায়ের প্রাণ উঠিল শিহরি,
            ঘৃণা, লজ্জা, শোকে |
পবিত্র বন্দনমন্ত্রে কম্পিত বাংলা
            দূর আর্য ভূমি!
মুক্তকণ্ঠে যুক্তকরে ডাকিছে তোমায়,
            হে লজ্জাবারিণী--- |
সাধনার ধন তুমি ভারতবাসীর,---
            সহস্র পীড়নে,
উপবাসে, অনশনে ভোলে নাই তোমা |
            দুর্বল সন্তানে
দিব্য মন্ত্রে দিব্য স্নেহে দাও স্থান আজি
            মন্দিরে তোমার ;
যায় যাক্ থাক্ প্রাণ, সে মন্ত্র শুনিয়া
            জাগিব আবার--- |
হিমাচল হবে দূর কুমারিকা পার
            কাননে, প্রান্তরে,
নগরে-নগরে ক্ষুদ্র প্রল্লীতে-পল্লীতে,
            প্রাসাদে কুটিরে,
কোটি কোটি মৃত প্রাণ, হোমাগ্নির প্রায়
            উঠুক জ্বলিয়া,
মা তোর তাপসী-মূর্তি পূজিবে সন্তান
            হিয়া রক্ত দিয়া |

মুখ ঢেকে যায় বিজ্ঞাপনে


শঙ্খ ঘোষ

একলা হয়ে দাঁড়িয়ে আছি
তোমার জন্য গলির কোণে
ভাবি আমার মুখ দেখাব
মুখ ঢেকে যায় বিজ্ঞাপনে।

একটা দুটো সহজ কথা
বলব ভাবি চোখের আড়ে
জৌলুশে তা ঝলসে ওঠে
বিজ্ঞাপনে, রংবাহারে।

কে কাকে ঠিক কেমন দেখে
বুঝতে পারা শক্ত খুবই
হা রে আমার বাড়িয়ে বলা
হা রে আমার জন্মভূমি!

বিকিয়ে গেছে চোখের চাওয়া
তোমার সঙ্গে ওতপ্রোত
নিওন আলোয় পণ্য হলো
যা-কিছু আজ ব্যক্তিগত।

মুখের কথা একলা হয়ে
রইল পড়ে গলির কোণে
ক্লান্ত আমার মুখোশ শুধু
ঝুলতে থাকে বিজ্ঞাপনে।

মুখোশ, মুখোশ শুধু

পবিত্র মুখোপাধ্যায়

মুখোশ, মুখোশ শুধু, চারিদিকে মুখোশের ভিড়;
আমাকে অস্থির
ক’রে তোলে, নিরুপায় হয়ে তুলি হাত
আকাশে,… খটখটে মেঘ-রোদ্দুরের অনির্বচনীয়
সুন্দর নির্মাণ করে চিরায়ত
আর এক পৃথিবী;
আমি চেয়ে থাকি নির্নিমেষ।

এখন মুখোশ যুদ্ধে কেউই পরে না ছদ্মবেশ,
স্বাভাবিক দেখে ভাবি- আড়ালে
নেকড়ের চোখ জ্বলে;
ধারালো নখের লক্ষ্য ঢেকেছে আস্তিনে।
আমি অক্ষরের যাদুবলে
মুখোশের আড়ালে যে মুখ, তাকে চিনে
নিতে গিয়ে দেখি, তাও
প্লাস্টিক সার্জারী করা, অন্য আগন্তুক।

ছেলেবেলাকার সেই চোখ-নাক-মসৃণ চিবুক
কিশোর, যুবক আজ নেই,
পণ্যভার বহনের ভারে ক্লিষ্ট প্রাণ
মানুষ হয়ে ছদ্মবেশী
যুগের অস্থির অভিনেতা
আজ সকলেই।

মুখ ও মুখোশে আজ ভেদ নেই, কোন ভেদ নেই।

মরণ

অনঙ্গমোহিনী দেবী

["প্রীতি" কাব্য, ১৯১০, থেকে নেওয়া]

এস ওগো, এস এস আমার মরণ!
এস হো সুন্দর সৌম্য, সুনীল বরণ!
বাজিয়া উঠিছে শঙ্খ সন্ধ্যার আরতি!
তুমি এস হৃদিতলে মন্দগতি।
শ্যামস্নিগ্ধ গোধূলিতে করিব বরণ,
এস সখা, বরবেশে মন্থর-চরণ।
আমরা দু’জন যাত্রী অনন্ত পথের,
বাজিছে অধীরে ভেরী তোমার রথের।
হৃদি-অন্তঃপুর হতে পরাণ-বধূরে
অলক্ষ্যে লইয়া যাও অনন্ত সুদূরে!
দেখিবে না, জানিবে না, কেহ কভু আর
পাবে না উদ্দেশ খুঁজি এ জগতে তার!
ফুটিয়া উঠিছে তারা রঙীন আকাশে,
পতাকা চঞ্চল তব সন্ধ্যার বাতাসে।
শিথিলিত হয়ে আসে জীবন-বন্ধন---
নিমীলিত হয়ে আসে অবস নয়ন!

মালার স্মৃতি

আব্দুল মান্নান সৈয়দ

‘মনে রাখার দিন গিয়েছে, এখন ভোলার পালা!’
_প্রশ্ন আমার : ভুলতে কি পেরেছিলেন কাজী কবি স্বয়ং?
বর্ণহীন জীবনে কেউ ভুলতে পারে ভালোবাসার রঙ?
মালার স্মৃতি থেকেই যায়, যতো শুকোক মালা!

মুকুরে প্রতিফলিত

বিনয় মজুমদার

মুকুরে প্রতিফলিত সূর্যালোক স্বল্পকাল হাসে |
শিক্ষায়তনের কাছে হে নিশ্চল, স্নিগ্ধ দেবদারু
জিহ্বার উপরে দ্রব লবণের মত কণা-কণা
কী ছড়ায়, কে ছড়ায় ; শোনো, কী অস্ফুট স্বর, শোনো
‘কোথায়, কোথায় তুমি, কোথায় তোমার ডানা, শ্বেত পক্ষীমাতা,
এই যে এখানে জন্ম, একি সেই জনশ্রুত নীড় না মৃত্তিকা?
নীড় না মৃত্তিকা পূর্ণ এ অস্বচ্ছ মৃত্যুময় হিমে…’
তুমি বৃক্ষ, জ্ঞানহীন, মরণের ক্লিষ্ট সমাচার
জানো না, এখন তবে স্বর শোনো,অবহিত হও |

সুস্থ মৃত্তিকার চেয়ে সমুদ্রেরা কত বেশি বিপদসংকুল
তারো বেশি বিপদের নীলিমায় প্রক্ষালিত বিভিন্ন আকাশ,
এ-সত্য জেনেও তবু আমরা তো সাগরে আকাশে
সঞ্চারিত হ’তে চাই, চিরকাল হ’তে অভিলাষী,
সকল প্রকার জ্বরে মাথা ধোয়া আমাদের ভালো লাগে ব’লে |
তবুও কেন যে আজো, হায় হাসি, হায় দেবদারু,
মানুষ নিকটে গেলে প্রকৃত সারস উড়ে যায়!

মনুষ্যত্ব


কুসুমকুমারী দাশ

একদিন লিখেছিনু আদর্শ যে হবে
"কথায় না বড় হয়ে কাজে বড় হবে" |
আজ লিখিতেছি বড় দুঃখ লয়ে প্রাণে
তোমরা মানুষ হবে কাহার কল্যাণে ?
মানুষ গড়িয়া ওঠে কোন্ উপাদানে ;
বাঙালি বোঝেনি তাহা এখনো জীবনে---
পুঁথি হাতে পাঠ শেখা---দু-চারটে পাশ
আজিকার দিনে তাহে মিলে না আশ্বাস,
চাই শৌর্য, চাই বীর্য, তেজে ভরা মন
"মানুষ হইতে হবে" হবে এই পণ---
বিপদ আসিলে কাছে হবে আগুয়ান
দুই খানি বাহু বিশ্বে সবারি সমান---
দাতার যে দান তাহা সকলেই পায়
কেউ ছোট কেউ বড় কেন হয়ে যায়!
কেন তবে পদতলে পড়ি বারবার ?
"মনুষ্যত্ব" জাগাইলে পাইব উদ্ধার--- |
যত অপমান, যত লাঞ্ছনা পীড়ন
একতার বলে সব হইবে দমন!
তেজীয়ান, বলীয়ান সেই ছেলে চাই
সোনার বাংলা আজি হারায়েছে তাই |
আবার গড়িতে হবে বীর শিশুদল,
বাংলার রূপ যাহে হবে সমুজ্জ্বল---

ময়নামতীর চর

বন্দে আলী মিঞা

এ-পারের এই বুনো ঝাউ আর ও পারের বুড়ো বট
মাঝখানে তার আগাছায় ভরা শুকনো গাঙের তট ;
এরি উঁচু পারে নিত্য বিহানে লাঙল দিয়েছে চাষী,
কুমীরেরা সেথা পোহাইছে রোদ শুয়ে শুয়ে পাশাপাশি |
কূলে কূলে চলে খরমূলা মাছ, দাঁড়িকানা পালে পালে
ছোঁ দিয়ে তার একটারে ধরি' গাঙ চিল বসে ডালে
ঠোঁটে চেপে ধরি' আছাড়ি আছাড়ি নিস্তেজ করি তায়
মুড়ো পেটি লেজ ছিঁড়ি একে একে গিলিয়া গিলিয়া খায় |
এরি কিছু দূরে একপাল গোরু বিচরিছে হেথা সেথা
শিঙে মাটি মাখা দড়ি ছিঁড়ি ষাঁড় চলে সে স্বাধীনচেতা |
মাথা নিচু করি কেহ বা ঝিমায় কেহ বা খেতেছে ঘাস,
শুয়ে শুয়ে কেহ জাবর কাটিয়া ছাড়িতেছে নিঃশ্বাস ;
গোচর পাখিরা ইহাদের গায়ে নির্ভয়ে চলে ফেরে
উকুন আঠালু ঠোকরিয়া খায় লেজের পালক নেড়ে ;
বক পাখিগুলো গোচরকীয়ার হয়েছে অংশীদার
শালিক কেবলই করিছে ঝগড়া কাজ কিছু নাই তার |
নতুন চরের পলি জমিটাতে কলাই বুনেছে যারা
আখের খামারে দিতেছে তারাই রাতভর পাহারা ;
খেতে কোণায় বাঁশ পুঁতে পুঁতে শূণ্যে বেঁধেছে ঘর
বিচালী বিছায়ে রচেছে শয্যা বাঁশের বাখারি 'পর |
এমন শীতেও মাঝ মাঠে তারা থড়ের মশাল জ্বালি
ঠকঠকি নেড়ে করিছে শব্দ হাতে বাজাইছে তালি |
ওপার হইতে পদ্মা সাঁতারি বন্য বরাহ পাল
এ-পারে আসিয়া আখ খায় রোজ ভেঙে করে পয়মাল |
তাই বেচারিরা দারুণ শীতেও এসেছে নতুন চরে
টোঙে বসি বসি জাগিতেছে রাত পাহারা দেবার তরে ;
কুয়াশা যেন কে বুলায়ে দিয়েছে মশারির মত করি
মাঠের ওপারে ডাকিতেছে "ফেউ" কাঁপাইয়া বিভাবরী |
ঘুমেল শিশুরা এই ডাক শুনি জড়ায়ে ধরিছে মায়,
কৃষাণ যুবতী ঝাপটি তাহারে মনে মনে ভয় পায় ;
"ফেউ" নাকি চলে বাঘের পেছনে গাঁয়ের লোকেরা বলে
টোঙের মানুষ ভাবিতেছে ঘর, ঘর ভেজে আঁখি জলে |

এই চরে ওই হালটার কোণে বিঘে দুই ক্ষেত ভরি
বট ও পাকুড়ে দোঁহে ঘিরে ঘিরে করি আছে জড়াজড়ি |
গাঁয়ের লোকেরা নতুন কাপড় তেল ও সিঁদুর দিয়া
ঢাক ঢোল পিটি গাছ দুইটির দিয়ে গেছে নাকি বায়া |
নতুন চালুনি ভেঙে গেছে তার, মুছি আর কড়িগুলা
রাখাল ছেলেরা নিয়ে গেছে সব ভরি গামছায় ঝুলা |
চড়কের মেলা এই গাছতলে হয় বছরের শেষে
সে দিন যেন গো সারা চরখানি উত্সবে ওঠে হেসে |
বটের পাতায় নৌকা গড়িয়া ছেড়ে দেয় জলে কেউ,
এই চর হতে ওই গাঁ'র পানে নিয়ে যায় তারে ঢেউ |
ছোট ছেলেপুলে বাঁশি কিনে কিনে বেদম বাজায়ে চলে,
বুড়োদের হাতে ঠোঙায় খাবার, কাশে আর কথা বলে |
ছেঁড়া কলাপাতা টুকড়ো বাতাসা চারিদিকে পড়ে রয়
পরদিনে তার রাখাল ছেলেরা সবে মিলে ঘুঁটে লয় ;
উত্সব শেষে খাঁ খাঁ করে হায় শূণ্য বালির চর---
এ পারের পানে চাহিয়া ও পার কাঁদে শুধু রাত ভর |

মোহররম

কাজী নজরুল ইসলাম

["অগ্নি-বীণা" থেকে নেয়া]

নীল সিয়া আসমান, লালে লাল দুনিয়া,-
“আম্মা ! লা’ল তেরি খুন কিয়া খুনিয়া !”
কাঁদে কোন্ ক্রন্দসী কারবালা ফোরাতে,
সে কাঁদনে আঁসু আনে সীমারেরও ছোরাতে !

মাঠ মানে ছুট

কার্তিক ঘোষ

মাঠ মানে কি মজাই শুধু মাঠ মানে কি ছুটি-
মাঠ মানে কি অথৈ খুশির অগাধ লুটোপুটি !
মাঠ মানে কি হল্লা শুধুই মাঠ মানে কি হাসি-
মাঠ মানে কি ঘুম তাড়ানো মন হারানো বাঁশি !
মাঠ মানে কি নিকেল করা বিকেল আসা দিন ,
মাঠ মানে কি নাচনা পায়ের বাজনা তাধিন ধিন !
মাঠ মানে তো সবুজ প্রাণের শাশ্বত এক দীপ-
মাঠ মানে ছুট এগিয়ে যাবার-পিপির পিপির পিপ।

ছুট মানে কি ছোটাই শুধু ছুট মানে কি আশা-
ছুট মানে কি শক্ত পায়ের পোক্ত কোন ভাষা।
ছুট মানে কি সাহস শুধু ছুট মানে কি বাঁচা ,
ছুট মানে কি ছোট্ট পাখির আগল ভাঙা খাঁচা !
ছুট মানে কি ছুটন্ত আর ফুটন্ত সব প্রাণে-
সাতটি সবুজ সমুদ্দুরের ঢেউকে ডেকে আনে !
ছুট মানে তো জীবন এবং ছুট মানে যে সোনা-
ছুট মানে কি ছুটেই দেখ- আর কিছু বলবো না।

মাটির হাতে

নীরেন্দ্রনাথ চক্রবর্তী

এ কোন্ যন্ত্রণা দিবসে, আর
এ কোন্ যন্ত্রণা রাতে;
আকাশী স্বপ্ন সে ছুঁয়েছে তার
মাটিতে গড়া দুই হাতে।

বোঝেনি, রাত্রির ঝোড়ো হাওয়ায়
যখন চলে মাতামাতি,
জ্বলতে নেই কোনো আকাঙ্ক্ষায়
জ্বালাতে নেই মোমবাতি।

ভেবেছে, সবখানে খোলা দুয়ার
দ্যাখেনি দেয়ালের লেখা;
এবং বোঝেনি যে বারান্দার
ধারেই তার সীমারেখা।

তবু সে গিয়েছিল বারান্দায়,
কাঁপেনি তবু তার বুক;
তবু সে মোমবাতি জ্বেলেছে, হায়,
দেখেছে আকাশের মুখ।

এখন যন্ত্রণা দিবসে, আর
এখন যন্ত্রণা রাতে।
আকাশী স্বপ্ন সে ছুঁয়েছে তার
মাটিতে গড়া দুই হাতে।

মানুষের সেবা

আবদুল কাদির

হাশরের দিন বলিবেন খোদা- হে আদম সন্তান
তুমি মোরে সেবা কর নাই যবে ছিনু রোগে অজ্ঞান।
মানুষ বলিবে – তুমি প্রভু করতার,
আমরা কেমনে লইব তোমার পরিচর্যার ভার?
বলিবেন খোদা- দেখনি মানুষ কেঁদেছে রোগের ঘোরে,
তারি শুশ্রুষা করিলে তুমি যে সেথায় পাইতে মোরে।
খোদা বলিবেন- হে আদম সন্তান,
আমি চেয়েছিনু ক্ষুধায় অন্ন, তুমি কর নাই দান।
মানুষ বলিবে- তুমি জগতের প্রভু,
আমরা কেমনে খাওয়াব তোমারে, সে কাজ কি হয় কভু?
বলিবেন খোদা- ক্ষুধিত বান্দা গিয়েছিল তব দ্বারে,
মোর কাছে তুমি ফিরে পেতে তাহা যদি খাওয়াইতে তারে।
পুনরপি খোদা বলিবেন- শোন হে আদম সন্তান,
পিপাসিত হয়ে গিয়েছিনু আমি, করাও নি জল পান।
মানুষ বলিবে- তুমি জগতের স্বামী,
তোমারে কেমনে পিয়াইব বারি, অধম বান্দা আমি?
বলিবেন খোদা- তৃষ্ণার্ত তোমা ডেকেছিল জল আশে,
তারে যদি জল দিতে তুমি তাহা পাইতে আমায় পাশে।

মুনাজাত

কাজী নজরুল ইসলাম

আমারে সকল ক্ষুদ্রতা হতে
          বাঁচাও প্রভু উদার।
হে প্রভু! শেখাও - নীচতার চেয়ে
          নীচ পাপ নাহি আর।

যদি শতেক জন্ম পাপে হই পাপী,
     যুগ-যুগান্ত নরকেও যাপি,
     জানি জানি প্রভু, তারও আছে ক্ষমা-
               ক্ষমা নাহি নীচতার।।

ক্ষুদ্র করো না হে প্রভু আমার
          হৃদয়ের পরিসর,
যেন সম ঠাঁই পায়
          শত্রু-মিত্র-পর।

     নিন্দা না করি ঈর্ষায় কারো
     অন্যের সুখে সুখ পাই আরো,
     কাঁদি তারি তরে অশেষ দুঃখী
               ক্ষুদ্র আত্মা তার।।