Showing posts with label . Show all posts
Showing posts with label . Show all posts

শিকল

রুদ্র মুহাম্মদ শহীদুল্লাহ্

ওই আঁটসাঁট ছোট জামাটা আমার গায়ে
পরাবার চেষ্টা কোরো না।
আমাকে থাকতে দাও ঢিলে-ঢোলা
আমাকে খোলামেলা থাকতে দাও।
সমুদ্র থেকে উঠে আসছে যে নদী
পাখির মতো ডানা মেলে,
আমাকে সে নদীর মতো থাকতে দাও অফুরন্ত,
স্রোতের মতো প্রাণবান থাকতে দাও আমাকে।
চার দেয়ালের ভেতরে আমি ছিলাম
আমি ওই বদ্ধ জলাশয়েও ছিলাম
আমি ছিলাম কবরের সুপ্রাচীন অন্ধকারে,
গতিহীনতার কারাগার আমাকে
টুকরো টুকরো করে ছিঁড়েছে।
ফিরতে বোলো না।
আমাকে থাকতে দাও স্রোতময় জলের মতন,
আমাকে থাকতে দাও জোয়ারে ভাটায়
আমাকে থাকতে দাও পতনে উত্থানে—
ওই আঁটসাঁট জামা আমাকে পরতে বোলো না।
সংকীর্ণ আস্তিনে আমার
বাহু দুটি আটকা পড়ে যায়,
আমি পাখা মেলতে পারি না।
আমি নিঃশ্বাস নিতে পারি না।

শত নাগিনীর পাকে

অক্ষয় কুমার বড়াল

শত নাগিনীর পাকে বাঁধ' বাহু দিয়া
পাকে পাকে ভেঙে যাক্ এ মোর শরীর !
এ রুদ্ধ পঞ্জর হ'তে হৃদয় অধীর
পড়ুক ঝাঁপায় তব সর্বাঙ্গ ব্যাপিয়া !

হেরিয়া পূর্ণিমা-শশি  টুটিয়া লুটিয়া
ক্ষুভিয়া প্লাবিয়া যথা সমুদ্র অস্থির ;
বসন্তে   বনান্তে যথা দুরন্ত সমীর
সারা ফুলবন দলি' নহে তৃপ্ত হিয়া |

এদেহ   পাষাণ ভার কর গো অন্তর!
হৃদয়-গোমুখি-মাঝে প্রেম-ভাগীরথী,
ক্ষুদ্র অন্ধ পরিসরে ভ্রমি' নিরন্তর
হতেছে বিকৃত ক্রমে, অপবিত্র অতি |
আলোকে-পুলকে ঝরি, তুলি' কলস্বর
করুক তোমারে চির স্নিগ্ধ-শুদ্ধমতি !

শৃঙ্খলমুক্ত

অক্ষয় কুমার বড়াল

আর কেন বাঁধি তারে   শিকল দিলাম খুলি' ;
কত বর্ষ অনভ্যাসে উড়িতে গিয়াছে ভুলি' |
ঝাপটি' পড়িল ভূমে, ভয়ে কাঁপে পাখা দুটি ;
পুত্র কন্যা দেয় তাড়া    করে ঘরে ছুটাছুটি |

ল'য়ে গেনু গৃহ-শিরে অতি সন্তর্পণে ধরি,'
সর্বাঙ্গে বুলানু কর কত-না আদর করি' ;
ক্রমে সুস্থ, তুলি' গ্রীবা চাহিল আকাশ-পানে   
মুখরিত উপবন কূজনে গুঞ্জনে গানে |

স্ফুরিল কাকলি মুখে, সহসা উড়িল টিয়া   
উড়িছে    হরিত্-পক্ষে স্বর্ণ-রৌদ্র আলোড়িয়া |
কি আলোক-পরিপূর্ণ ! কি বায়ু    পাগল-করা !
প্রকৃতি মায়ের মত হাস্যমুখী মনোহরা !

ধায় ছাড়ি' গ্রাম, নদী ; দূর মাঠে যায় দেখা,   
দিগন্তে অরণ্য-শীর্ষ   শ্যামল বঙ্কিম রেখা |
ল'য়ে শত শূণ্য নীড় ডাকে ধরা অবিরত   
নীল স্থির নভস্থলে ভাসে ক্ষুদ্র মরকত |

চকিতে সরিল মেঘ    কোথা কিছু নাহি আর!
চকিতে ভাতিল মেঘে অমরার সিংহদ্বার !
ঝটিতি মিশিল বায়ে মিলনের কলধ্বনি   
ত্রিদিব পেয়েছে ফিরে' যেন তার হারামণি !

এই মৃত্যু   এই মুক্তি ! হে দেব, হে বিশ্বস্বামী !
আমিও ত বদ্ধজীব, আমিও ত মুক্তিকামী !
আমিও কি ফেলি' দেহ   বিস্ময়ে আতঙ্ক-হীন   
অসীম সৌন্দর্যে তব হইব আনন্দে লীন ?

শোক

অক্ষয় কুমার বড়াল

গোলাপের দলে দলে পড়িয়াছে হিমরাশি
আদরে দুলায় শাখা প্রভাত-পবন আসি ;
ঝরিতেছে হিমভার, সরিতেছে অন্ধকার,
পাণ্ডুর অধরে তার ফুটেছে রক্তিম হাসি |
ওগো, তুমি এস-এস, শ্বসিয়া সে প্রেমশ্বাস !
কতদিন আছি বেঁচে    ক্রমে হয় অবিশ্বাস !
এস মৃত্যু-দ্বার ভাঙ্গি, আকাশ উঠুক রাঙ্গি,
পড়ুক হৃদয় মোর তোমার হৃদয়াভাষ |
আবার দাঁড়াও, দেবী, দৃষ্টি-মুগ্ধ করি হিয়া,
নারীসম ভালবেসে সুখে দুখে আলিঙ্গিয়া !
কৈশোর কল্পনা সম, জড়ায়ে জীবন মম,
আধ স্বপ্ন-জাগরণে   জগতে আড়াল দিয়া |

      *         *          *

ওই বহ্নি   ওই ধূম   ওই অন্ধকার   
বিগত-জীবন স্বপ্ন, কিছু নাই আর !
জীবন প্রথম হ'তে ওই পথে ধাই   
কাহারো চরণচিহ্ন কূলে পড়ে নাই |
কি ঘন জলদে ঢাকা মৃত্যু-পরপার   
বায়ু না আনিতে পারে দূর সমাচার !
তপন কিরণে যায় সর্ব বিশ্ব দেখা,
কোথা চির-মিলনের উপকূল রেখা !
দুর্ভেদ্য দুস্তর শূণ্য, ক্ষুদ্রদৃষ্টি নর ;
ওই বহ্নি, ওই ধূম ! কিবা তারপর ?

শাড়ি

সুবোধ সরকার

বিয়েতে একান্নটা শাড়ি পেয়েছিল মেয়েটা
অষ্টমঙ্গলায় এসে আরো ছটা
এতো শাড়ি একসঙ্গে সে জীবনে দেখেনি।

আলমারির প্রথম থাকে সে রাখল সব নীল শাড়িদের
হালকা নীল একটাকে জড়িয়ে ধরে বলল, তুই আমার আকাশ
দ্বিতীয় থাকে রাখল সব গোলাপীদের
একটা গোলাপীকে জড়িয়ে সে বলল, তোর নাম অভিমান
তৃতীয় থাকে তিনটি ময়ূর, যেন তিনদিক থেকে ছুটে আসার সুখ
তেজপাতা রং যে শাড়িটার, তার নাম দিল বিষাদ।
সারা বছর সে শুধু শাড়ি উপহার পেল
এত শাড়ি সে কী করে এক জীবনে পরবে ?

কিন্তু বছর যেতে না যেতে ঘটে গেল সেই ঘটনাটা
সন্ধ্যের মুখে মেয়েটি বেরিয়েছিল স্বামীর সঙ্গে, চাইনিজ খেতে
কাপড়ে মুখ বাঁধা তিনটি ছেলে এসে দাঁড়ালো
স্বামীর তলপেটে ঢুকে গেল বারো ইঞ্চি
ওপর থেকে নীচে। নীচে থেকে ডানদিকে।
যাকে বল এল।
পড়ে রইল খাবার, চিলি ফিশ থেকে তখনো ধোঁয়া উঠছে।
এর নাম রাজনীতি, বলেছিল পাড়ার লোকেরা।

বিয়েতে একান্নটা শাড়ি পেয়েছিল মেয়েটা
অষ্টমঙ্গলায় ফিরে এসে আরো ছটা
একদিন দুপুরে, শাশুড়ি ঘুমিয়ে, সমস্ত শাড়ি বের করে
ছ'তলার বারান্দা থেকে উড়িয়ে দিল নীচের পৃথিবীতে।
শাশুড়ি পরিয়ে দিয়েছেন তাকে সাদা থান
উনিশ বছরের একটা মেয়ে, সে একা।

কিন্তু সেই থানও এক ঝটকায় খুলে নিল তিনজন, পাড়ার মোড়ে
একটি সদ্য নগ্ন বিধবা মেয়ে দৌড়াচ্ছে আর চিৎকার করছে, বাঁচাও
পেছনে তিনজন, সে কী উল্লাস, নির্বাক পাড়ার লোকেরা।
বিয়েতে একান্নটা শাড়ি পেয়েছিল মেয়েটা।
অষ্টমঙ্গলায় ফিরে এসে আরও ছটা...

শোকগাথা কাব্যগ্রন্থ থেকে অংশ বিশেষ

রাজকুমারী অনঙ্গমোহিনী দেবী

|| ১ ||
জন্মশোধ বিদায়ের বিষাদ-চুম্বন,
যাতনায় ক্লিষ্ট সেই বিবর্ণ বদন!
আকুল বিষাদ ভরে হাতে হাত রাখি
চেয়েছিল, অশ্রুপূর্ণ প্রভাহীন আঁখি!
এ বিষাদ-ছবি জাগে হৃদি-দরপণে,
এ করুণ-গীতিভাসে মৃদু গঞ্জরণে
আয়স্তী জীবনে মম, প্রভাতে সন্ধ্যায়
শুধু সেই স্মৃতি রেখা হৃদয়েতে বায়!
হৃদয়ের রক্ত দিয়ে করিয়ে পোষণ,
রাখিয়াছি সেই স্মৃতি করি সযতন।

|| ২ ||
আজিকে নিবিড় মেঘের আঁধারে
ঊষার মলিন আলোকে ভায় ;
নিরাশা-হুতাশ ঘেরিছে আমারে
ম্লান মুখে আশা চলিয়া যায়!
ডুবে যায় চাঁদ পশ্চিম গগনে
নিবু নিবু আলো মিশিয়া যায় ;
সরসীর নীল সলিল শয়নে
মূরছি কুমুদী পড়িছে হায়!

* * * *

আজিকে কেবলি সাধ হয় মনে
ঊষার কোলেতে মিশিয়া যাই,
মেঘের মেদুর বাতাসের সনে
সুদূর আকাশে ভাসিয়া যাই।
অথবা অকূল সাগরের তীরে
বসিয়া দেখিব তরঙ্গ মালা ;
সজনী গো শুধু কহিব সমীরে
আমার অসহ মরম জ্বালা।

শারদ-তরঙ্গিণী

কৃষ্ণচন্দ্র মজুমদার

একদিন এ সময় তরঙ্গিনী-তীরে,
চলিলাম চিন্তাকুল চিতে ধীরে ধীরে |
তটিনীর তটপরি সিকতা-আসনে,
বসিলাম ভাবময়ী কল্পনার সনে।
তরঙ্গিণী-তনু তনু শারদাগমনে,
নিরখি নয়নে আমি নিরখি নয়নে;
সুধালেম "অয়ি কলস্বরা স্রোতস্রতি!
আজ কেন তোমা হেরি দীনা ক্ষীণা অতি?
বরষার সময়জ প্রভাবনিচয়,
কেন কেন কেন আজ দৃশ্য নাহি হয়?
তরঙ্গিণী! কোথা তব তরঙ্গের রঙ্গ,
হেরি যাহা, পোতারহী পাইত আতঙ্ক?
যে সকল লহরী, করিয়া ঘোর স্বন,
তরণীর হৃদয় করিত বিদারণ,
কোথা তাহা? কোথা সেই দ্রুতগামী নীর
চলিত যা মদগর্বে অতিক্রমি তীর?
কূলস্থ বিহঙ্গাশ্রম মহীরুহগণ
করিত তাদের কোপে মূল উন্মূলন!
অয়ি ধুনি! কোথা তব সেই মহাধ্বনি,
ভয় জন্মাইত মেন যার প্রতিধ্বনি?''
শুনিয়া আমার ভাষ অতি কলস্বরে,
তরঙ্গিণী উত্তর করিলা তদন্তরে---
"শুনহে হে ভাবুক! এই জানিবে নিশ্চয়,
চিরদিন একদশা কাহারো না রয় |"

শূন্যের ভিতরে ঢেউ


শঙ্খ ঘোষ

বলিনি কখনো?
আমি তো ভেবেছি বলা হয়ে গেছে কবে।
এভাবে নিথর এসে দাঁড়ানো তোমার সামনে
সেই এক বলা
কেননা নীরব এই শরীরের চেয়ে আরো বড়ো
কোনো ভাষা নেই
কেননা শরীর তার দেহহীন উত্থানে জেগে
যতদূর মুছে নিতে জানে
দীর্ঘ চরাচর
তার চেয়ে আর কোনো দীর্ঘতর যবনিকা নেই।
কেননা পড়ন্ত ফুল, চিতার রুপালি ছাই, ধাবমান শেষ ট্রাম
সকলেই চেয়েছে আশ্রয়
সেকথা বলিনি? তবে কী ভাবে তাকাল এতদিন
জলের কিনারে নিচু জবা?
শুন্যতাই জানো শুধু? শুন্যের ভিতরে এত ঢেউ আছে
সেকথা জানো না?

শৈশব

সাজ্জাদ হুসাইন

রূপকথা, ছড়া আর
অদেখা ঠাকুরমার-
ঝুলি ভরা গল্পের, কল্পের বই-সব-

কিছু নেই
তাকাতেই পিছু-ভাবি কই-সব
ফেলে আসা
ভাসা-ভাসা, স্মৃতি জুড়ে শৈশব!

ভরা-গাঙে লাফ-ঝাঁপ
বরষার টুপটাপ
পুকুরের তাজা কই, উনুনের খই-সব-

কিছু নেই
তাকাতেই পিছু-ভাবি কই-সব
ফেলে আসা
ভাসা-ভাসা, স্মৃতি জুড়ে শৈশব!

খেজুরের মধু-রস
পাকা আম টসটস
এলোমেলো হাঁটা-পথ, খাঁটি মাঠা-দই সব-

কিছু নেই
তাকাতেই পিছু-ভাবি কই-সব
ফেলে আসা
ভাসা-ভাসা, স্মৃতি জুড়ে শৈশব!

প্রজাপতি সেই মন
ছুটে চলা প্রতিক্ষণ
বড় হওয়া মাছে-ভাতে, গাছে ওঠা মই-সব-

কিছু নেই
তাকাতেই পিছু-ভাবি কই-সব
ফেলে আসা
ভাসা-ভাসা, স্মৃতি জুড়ে শৈশব!

জোছনায় ভেজা-রাত
কত ফাঁকি, অজুহাত
হাসি-খুশি থইথই, প্রিয় হইচই-সব-

কিছু নেই
তাকাতেই পিছু-ভাবি কই-সব
ফেলে আসা
ভাসা-ভাসা, স্মৃতি জুড়ে শৈশব!

শুদ্ধ করো আমার জীবন

মহাদেব সাহা

তুমি শুদ্ধ করো আমার জীবন, আমি প্রতিটি ভোরের মতো
আবার নতুন হয়ে উঠি,
হই সূর্যোদয়
আমার জীবন তুমি পরিশুদ্ধ করো, আমি প্রস্ফুটিত হই
আমি বহুদিন ঝরা ব্যথিত বকুল অন্ধকারে, আমি বহুদিন
বিষন্ন বিধুর ;
একবার আমার মাথায় হাত রাখো, সুপ্রসন্ন হও
এই দগ্ধ বুকে করো শ্রাবণের অঝোর বর্ষণ
আমি শ্যামল সবুজ বৃক্ষ হয়ে উঠি ।
তুমি শুদ্ধ করো আমার জীবন, আমি হই সূর্যোদয়,
আমি হই উদিত আকাশ
আমি হয়ে উঠি প্রতিটি শিশুর হাতে প্রথম বানান শেখা বই,
হয়ে উঠি ভোরবেলাকার পাখিদের গান ;
আমার জীবন তুমি শুদ্ধ করো, আমি হই নতুন সবুজ
কোনো দ্বীপ,
আমি হই বর্ষাকাল, আমি হই বরষার নব জলধারা
আমি বহুদিন ব্যথিত বিষাদ, আমি বহুদিন একা
ঝাউবন ।
তুমি শুদ্ধ করো আমার জীবন, আমি হয়ে উঠি সদ্যফোটা ফুল
আমি হয়ে উঠি সকালের ঘুমভাঙ্গা চোখ ।

শরতে


কালিদাস রায়

ছুটির খবর এসেছে আজ নীল আকাশের পথে !
ও ভাই ছুটী - ছুটী - ছুটী,
আয়না - চোখে দেখনা - ওকে অরুণ আলোর রথে
সোনা - ছড়ায় মুঠি - মুঠি !
তরু লতায়, পাখীর নীড়ে, হর্ষে জড়াজড়ি
সারং - বাজছে বনে বনে,
নূতন নূতন পোষাক পরে' মেঘ আকাশের পরী
কেমন - সাজছে খনে খনে |
খবর আসার আগেই এল গুপ্ত সুড়ং ধরি'
ছুটী - আজ যে মনে মনে,
কে জানালো ফুলকলিদের, ফুট্ ল কানন ভরি'
যারা-করত ফুটি-ফুটি--
ও ভাই - ছুটী - ছুটী - ছুটী |

কোণা হতে আয় বেরিয়ে সোনা কুড়াই ভাই,
আয় - গায়ে মাঠে মাঠে,
বাতাবি-বন মাতাবি-কে ? শিউলি বোঁটা চাই ?
আয়-বনের বাটে বাটে |
ঢেউয়ের তালে দুবল আজি, কলার ভেলা বাই,
আয় - নদীর ঘাটে ঘাটে,
কাশের বনে হাঁসেন সনে কণ্ঠ ছেড়ে গাই,
আয় - করব লুটোপুটি
ও ভাই - ছুটী - ছুটী - ছুটী |

চাইনা মোরা পায়ে জুতো - চাইনা মাথায় ছাতা,
বনে - ঘুরবো ছায়ে ছায়ে,
সাঁতার কেটে দীঘির জলে মুছব না আজ মাথা,
রোদে - শুকাক্ বায়ে বায়ে |
ফেলবো ছুঁড়ে আজকে শেলেট অঙ্ক কষার খাতা
তারা - লুটুক পায়ে পায়ে,
সরল-ভূগোল, নীতিকুসুম, ধারাপাতের পাতা
ছিঁড়ে - করব কুটি কুটি
ও ভাই - ছুটী - ছুটী - ছুটী |

আয়না সবাই দেখনা ও ভাই কে ওই অরুণ রথে
সোনা - ছড়ায় মুঠি - মুঠি |
ছুটির খবর পেয়েছি আজ নীল আকাশের পথে
ও ভাই - করব ছুটোছুটি -- |

শহীদদের প্রতি


আসাদ চৌধুরী

তোমাদের যা বলার ছিল
বলছে কি তা বাংলাদেশ ?
শেষ কথাটি সুখের ছিল ?
ঘৃণার ছিল ?
নাকি ক্রোধের,
প্রতিশোধের,
কোনটা ছিল ?
নাকি কোনো সুখের
নাকি মনে তৃপ্তি ছিল
এই যাওয়াটাই সুখের।
তোমরা গেলে, বাতাস যেমন যায়
গভীর নদী যেমন বাঁকা
স্রোতটিকে লুকায়
যেমন পাখির ডানার ঝলক
গগনে মিলায়।
সাঁঝে যখন কোকিল ডাকে
কারনিসে কি ধুসর শাখে
বারুদেরই গন্ধস্মৃতি
ভুবন ফেলে ছেয়ে
ফুলের গন্ধ পরাজিত
স্লোগান আসে ধেয়ে।
তোমার যা বলার ছিল
বলছে কি তা বাংলাদেশ ?

শুধু তোমার জন্য

নির্মলেন্দু গুণ

কতবার যে আমি তোমোকে স্পর্শ করতে গিয়ে
গুটিয়ে নিয়েছি হাত-সে কথা ঈশ্বর জানেন।
তোমাকে ভালোবাসার কথা বলতে গিয়েও
কতবার যে আমি সে কথা বলিনি
সে কথা আমার ঈশ্বর জানেন।
তোমার হাতের মৃদু কড়ানাড়ার শব্দ শুনে জেগে উঠবার জন্য
দরোজার সঙ্গে চুম্বকের মতো আমি গেঁথে রেখেছিলাম
আমার কর্ণযুগল; তুমি এসে আমাকে ডেকে বলবেঃ
‘এই ওঠো,
আমি, আ…মি…।‘
আর অমি এ-কী শুনলাম
এমত উল্লাসে নিজেকে নিক্ষেপ করবো তোমার উদ্দেশ্যে
কতবার যে এরকম একটি দৃশ্যের কথা আমি মনে মনে
কল্পনা করেছি, সে-কথা আমার ঈশ্বর জানেন।
আমার চুল পেকেছে তোমার জন্য,
আমার গায়ে জ্বর এসেছে তোমার জন্য,
আমার ঈশ্বর জানেন- আমার মৃত্যু হবে তোমার জন্য।
তারপর অনেকদিন পর একদিন তুমিও জানবে,
আমি জন্মেছিলাম তোমার জন্য। শুধু তোমার জন্য।

শরতে

আহসান হাবীব


ফূল ফুল তুল তুল গা ভেজা শিশিরে,
বুল বুল মশগুল, কার গান গাহিরে?

তর বর উঠে পর রাত ভোর দেখ না?
হাত তুলে প্রাণ খুলে স্রষ্টারে ডাক না..

ঝিক মিক দশ দিক নাই পিক পাপিয়া..
সাদা বক চক চক উড়ে যায় ডাকিয়া..

বিল ঝিল খিল খিল লাল নীল বরণে,
গাছে গাছে ফিঙ্গে নাচে চঞ্জল চরনে।

ভেজা ভেজা তাজা তাজা শেফালির সুবাসে,
শিশুদল কোলাহল করে নানা হরষে।

টিদার জরিপার শ্যাম শাড়ী অঙ্গে
এ্যলো কেশে এলো হেসে শরত এ বঙ্গে..

শিশুর পণ

গোলাম মোস্তফা

এই করিনু পণ
মোরা এই করিনু পণ
ফুলের মতো গড়ব মোরা
মোদের এই জীবন।
হাসব মোরা সহজ সুখে
গন্ধ রবে লুকিয়ে বুকে
মোদের কাছে এলে সবার
জুড়িয়ে যাবে মন।

নদী যেমন দুই কূলে তার
বিলিয়ে চলে জল,
ফুটিয়ে তোলে সবার তরে
শস্য, ফুল ও ফল।
তেমনি করে মোরাও সবে
পরের ভাল করব ভবে
মোদের সেবায় উঠবে হেসে
এই ধরণীতল।
সূর্য যেমন নিখিল ধরায়
করে কিরণ দান,
আঁধার দূরে যায় পালিয়ে
জাগে পাখির গান।
তেমনি মোদের জ্ঞানের আলো
দূর করিবে সকল কালো
উঠবে জেগে ঘুমিয়ে আছে
যে সব নীরব প্রাণ।

শহীদ স্মরণে

মোহম্মদ মনিরুজ্জামান

কবিতায় আর কি লিখব?
যখন বুকের রক্তে লিখেছি
একটি নাম
বাংলাদেশ।

গানে আর ভিন্ন কি সুরের ব্যঞ্জনা?
যখন হানাদারবধ সংগীতে
ঘৃণার প্রবল মন্ত্রে জাগ্রত
স্বদেশের তরুণ হাতে
নিত্য বেজেছে অবিরাম
মেশিনগান, মর্টার, গ্রেনেড।

কবিতায় কি লিখব?
যখন আসাদ
মনিরামপুরেরর প্রবল শ্যামল
হৃদয়ের তপ্ত রুধিরে করেছে রঞ্জিত
সারা বাংলায় আজ উড্ডীন
সেই রক্তাক্ত পতাকা।
আসাদের মৃত্যুতে আমি
অশ্রুহীন; অশোক; কেননা
নয়ন কেবল বজ্রবর্ষী; কেননা
আমার বৃদ্ধ পিতার শরীরে
এখন পশুদের প্রহারের
চিহ্ণ; কেননা আমার বৃদ্ধা মাতার
কণ্ঠে নেই আর্ত হাহাকার, নেই
অভিসম্পাত- কেবল
দুর্মর ঘৃণার আগুন; কোন
সান্ত্বনা বাক্য নয়, নয় কোন
বিমর্ষ বিলাপ; তাঁকে বলি নি
'তোমার ছেলে আসল ফিরে
হাজার ছেলে হয়ে
আর কেঁদো না মা'; কেননা
মা তো কাঁদে না;
মার চোখে নেই অশ্রু, কেবল
অনলজ্বালা, দু চোখে তাঁর
শত্রুহননের আহ্বান।
আসদের রক্তধারায় মহৎ
কবিতার, সব মহাকাব্যের,
আদি অনাদি আবেগ-
বাংলাদেশ-জাগ্রত।

আমি কবিতায় নতুন আর
কি বলব? যখন মতিউর
করাচীর খাঁচা ছিঁড়ে ছুটে গেল
মহাশূন্যে টি-৩৩ বিমানের দুর্দম পাখায় তার স্বপ্নের
স্বধীন স্বদেশ মনে করে-
ফেলে তার মাহিন তুহিন মিলি
সর্বস্ব সম্পদ; পরম আশ্চর্য এক
কবিতার ইন্দ্রজাল স্রষ্টা হল-
তার অধিক কবিতা আর
কোন বঙ্গভাষী কবে লিখেছে কোথায়?
আমি কোন শহীদের স্মরণে লিখব?
বয়ান্ন, বাষট্টি, উনসত্তর, একাত্তর;
বাংলার লক্ষ লক্ষ আসাদ মতিউর আজ
বুকের শোণিতে উর্বর করেছে এই
প্রগাঢ় শ্যামল।

শহীদের পূণ্য রক্তে সাত কোটি
বাঙালির প্রাণের আবেগ আজ
পুষ্পিত সৌরভ। বাংলার নগর, বন্দর
গঞ্জ, বাষট্টি হাজার গ্রাম
ধ্বংস্তুপের থেকে সাত কোটি ফুল
হয়ে ফোটে। প্রাণময় মহৎ কবিতা
আর কোথাও দেখি না এর চেয়ে।

শব্দভূক পদ্যব্যবসায়ী ভীরু বঙ্গজ পুঙ্গব সব
এই মহাকাব্যের কাননে খোঁজে
নতুন বিস্ময়। কলমের সাথে আজ
কবির দুর্জয় হাতে নির্ভুল স্টেনগান কথা বলে।
কবিতায় আর নতুন কি লিখব।
যখন বুকের রক্তে
লিখেছি একটি নাম
বাংলাদেশ।

শিক্ষকের মর্যাদা

কাজী কাদের নেওয়াজ

বাদশাহ আলমগীর-
কুমারে তাঁহার পড়াইত এক মৌলভী দিল্লীর।
একদা প্রভাতে গিয়া
দেখেন বাদশাহ- শাহজাদা এক পাত্র হস্তে নিয়া
ঢালিতেছে বারি গুরুর চরণে
পুলকিত হৃদে আনত-নয়নে,
শিক্ষক শুধু নিজ হাত দিয়া নিজেরি পায়ের ধুলি
ধুয়ে মুছে সব করিছেন সাফ্ সঞ্চারি অঙ্গুলি।
শিক্ষক মৌলভী
ভাবিলেন আজি নিস্তার নাহি, যায় বুঝি তার সবি।
দিল্লীপতির পুত্রের করে
লইয়াছে পানি চরণের পরে,
স্পর্ধার কাজ হেন অপরাধ কে করেছে কোন্ কালে!
ভাবিতে ভাবিতে চিন্তার রেখা দেখা দিল তার ভালে।
হঠাৎ কি ভাবি উঠি
কহিলেন, আমি ভয় করি না'ক, যায় যাবে শির টুটি,
শিক্ষক আমি শ্রেষ্ঠ সবার
দিল্লীর পতি সে তো কোন্ ছার,
ভয় করি না'ক, ধারি না'ক ধার, মনে আছে মোর বল,
বাদশাহ্ শুধালে শাস্ত্রের কথা শুনাব অনর্গল।
যায় যাবে প্রাণ তাহে,
প্রাণের চেয়েও মান বড়, আমি বোঝাব শাহানশাহে।

তার পরদিন প্রাতে
বাদশাহর দূত শিক্ষকে ডেকে নিয়ে গেল কেল্লাতে।
খাস কামরাতে যবে
শিক্ষকে ডাকি বাদশা কহেন, ''শুনুন জনাব তবে,
পুত্র আমার আপনার কাছে সৌজন্য কি কিছু শিখিয়াছে?
বরং শিখেছে বেয়াদবি আর গুরুজনে অবহেলা,
নহিলে সেদিন দেখিলাম যাহা স্বয়ং সকাল বেলা''
শিক্ষক কন-''জাহপানা, আমি বুঝিতে পারিনি হায়,
কি কথা বলিতে আজিকে আমায় ডেকেছেন নিরালায়?''
বাদশাহ্ কহেন, ''সেদিন প্রভাতে দেখিলাম আমি দাঁড়ায়ে তফাতে
নিজ হাতে যবে চরণ আপনি করেন প্রক্ষালন,
পুত্র আমার জল ঢালি শুধু ভিজাইছে ও চরণ।
নিজ হাতখানি আপনার পায়ে বুলাইয়া সযতনে
ধুয়ে দিল না'ক কেন সে চরণ, স্মরি ব্যথা পাই মনে।''

উচ্ছ্বাস ভরে শিক্ষকে আজি দাঁড়ায়ে সগৌরবে
কুর্ণিশ করি বাদশাহে তবে কহেন উচ্চরবে-
''আজ হতে চির-উন্নত হল শিক্ষাগুরুর শির,
সত্যই তুমি মহান উদার বাদশাহ্ আলমগীর।''