সহীদ
প্রাণ দিল যারা সাধিতে দেশের কাজ,
শায়িত তাহারা রয়েছে ধূলির মাঝে,
নাহি হেথা কোন' স্তম্ভ মীনার তাজ,
তাহা হতে উঁচু গৌরব-চূড়া রাজে।
মধুমাস তারে সাজায় কুসুম-হারে,
এত মনোরম স্বপ্নও নাহি পারে।
হুরীপরীগণ ফুল-চন্দন-দানে
আত্মাগুলিরে লয়েছে ত্রিদিবে বরি,
বন্দিছে কল-জয়মঙ্গল গানে
মহিমা, হেথায় তীর্থ-যাত্রা করি
স্বাধীনতা হেথা তপোরতা, ব্রত পালে,
আশ্রম রচি অশ্রু-শিশির ঢালে।
সান্তনা
সে সময়ে দিও দেখা !
নয়নে যখন ঘনাবে মরণ,
ধরণী হইবে ধূসর-বরণ ;
ময়নের তলে অতীত জীহন
স্বপনের সম লেখা !
পড়ে শ্বেতজাল শিব-নেত্র 'পর,
শিথিল শরীর, হিম পদ-কর,
আনাভি নিঃশ্বাস, কঠোর ঘর্ঘর
সে সময়ে দিও দেখা !
পলাই-পলাই ভাঙ্গি' দেহ-কারা,
আছাড়ে হৃদয় উন্মাদ-পারা,
ডাকে পরিজন নাহি পায় সাড়া
গভীর নিসুতি যাম ।
ভয়ে ভীত প্রাণ কাঁদিয়া কাতরে
শিরা-উপশিরা আঁকড়িয়া ধরে ;হ
দীপ নিবে-নিবে, সময় না নড়ে,
সবে করে হরিনাম ।
অতি নিরুপায়, কোথা ছিল পড়ি'
আজীবন-স্মৃতি আসে হা হা করি'!
প্রতি দিনে দিনে রহিয়াছে ভরি'
কি গাঢ় কলঙ্ক দাগ !
নিজ পাপে তাপে অদৃষ্ট গড়িয়া
দেহ হ'তে আমি যাই বাহিরিয়া
সে সময়ে কাছে দাঁড়াবে কি, প্রিয়া,
লয়ে চির অনুরাগ ?
সব কিছু নষ্টদের অধিকারে যাবে
হুমায়ুন আজাদ
আমি জানি সব কিছু নষ্টদের অধিকারে যাবে।
নষ্টদের দানবমুঠোতে ধরা পড়বে মানবিক
সব সংঘ-পরিষদ; চলে যাবে, অত্যন্ত উল্লাসে
চ’লে যাবে এই সমাজ-সভ্যতা-সমস্ত দলিল
নষ্টদের অধিকারে ধুয়েমুছে, যে-রকম রাষ্ট্র
আর রাষ্ট্রযন্ত্র দিকে দিকে চলে গেছে নষ্টদের
অধিকারে। চ’লে যাবে শহর বন্দর ধানক্ষেত
কালো মেঘ লাল শাড়ি শাদা চাঁদ পাখির পালক
মন্দির মসজিদ গির্জা সিনেগগ পবিত্র প্যাগোডা।
অস্ত্র আর গণতন্ত্র চ’লে গেছে, জনতাও যাবে;
চাষার সমস্ত স্বপ্ন আস্তাকুড়ে ছুঁড়ে একদিন
সাধের সমাজতন্ত্রও নষ্টদের অধিকারে যাবে।
,
আমি জানি সব কিছু নষ্টদের অধিকারে যাবে।
কড়কড়ে রৌদ্র আর গোলগাল পূর্ণিমার চাঁদ
নদীরে পাগল করা ভাটিয়ালি খড়ের গম্বুজ
শ্রাবণের সব বৃষ্টি নষ্টদের অধিকারে যাবে।
রবীন্দ্রনাথের সব জ্যোৎস্না আর রবিশংকরের
সমস্ত আলাপ হৃদয়স্পন্দন গাথা ঠোঁটের আঙুর
ঘাইহরিণীর মাংসের চিৎকার মাঠের রাখাল
কাশবন একদিন নষ্টদের অধিকারে যাবে।
চলে যাবে সেই সব উপকথাঃ সৌন্দর্য-প্রতিভা-মেধা;
এমনকি উন্মাদ ও নির্বোধদের প্রিয় অমরতা
নির্বাধ আর উন্মাদদের ভয়ানক কষ্ট দিয়ে
অত্যন্ত উল্লাসভরে নষ্টদের অধিকারে যাবে।
আমি জানি সব কিছু নষ্টদের অধিকারে যাবে।
সবচে সুন্দর মেয়ে দুইহাতে টেনে সারারাত
চুষবে নষ্টের লিঙ্গ; লম্পটের অশ্লীল উরুতে
গাঁথা থাকবে অপার্থিব সৌন্দর্যের দেবী। চ’লে যাবে,
কিশোরীরা চ’লে যাবে, আমাদের তীব্র প্রেমিকারা
ওষ্ঠ আর আলিঙ্গন ঘৃণা ক’রে চ’লে যাবে, নষ্টদের
উপপত্নী হবে। এই সব গ্রন্থ শ্লোক মুদ্রাযন্ত্র
শিশির বেহালা ধান রাজনীতি দোয়েলের স্বর
গদ্য পদ্য আমার সমস্ত ছাত্রী মার্ক্স-লেনিন,
আর বাঙলার বনের মত আমার শ্যামল কন্যা-
রাহুগ্রস্থ সভ্যতার অবশিষ্ট সামান্য আলোক
আমি জানি তারা সব নষ্টদের অধিকারে যাবে।
স্বাধীনতা
চক্ষুকে বিশ্বাস করতে পারছি না :
আমার প্রকাশ্য গৃহচূড়ে উড়ছে আমার স্বদেশের পতাকা-----
তিমিরমুক্ত অম্বরের অভিমুখে
উথ্বিত হচ্ছে আমার নিরুদ্ধ আত্মার প্রথম উদার সম্ভাষণ
আমার জন্মের প্রথম জয়ঘোষণা |
এক প্রান্তে গম্ভীর গৈরিক
অনপনেয় দুঃখের ঔদাস্য আর অপরিমেয় ত্যাগের প্রসন্নতা ;
অন্য প্রান্তে উল্লাস-উজ্জ্বল সবুজের অপর্যাপ্তি
অমিত জীবনের সৃজনসৌন্দর্যের উদ্ভাবন ;
মধ্যস্থলে তুষারসঙ্কশা শুভ্রতা
কর্মের নির্মলতা ও অনবদ্য অন্তরমাধুর্যের প্রতীতি |
আর সেই শুভ্রতার অন্তরে ঘননীল অশোকচক্র,
সমস্ত অলাতচক্রের ঊর্ধ্বে
শান্তির স্থির বাণী
দিকে-দিকে দেশে-দেশে মৈত্রীর আমন্ত্রণ ;
শোকশূন্য সময়ের ঘূর্ণ্যমানতার প্রতীক
বর্তমান থেকে বৃহত্তর ভবিষ্যতের
মহত্তর সম্ভাবনায় নিয়ত-আবর্তিত
উড়ছে আমার ধ্রুব বিশ্বাসের ধ্বজপট
আমার বীজমন্ত্রের বৈজয়ন্তী |
কত দুর্গম পর্বত ও কত কন্টকক্লেশিত অরণ্য পার হয়ে
কত দুঃসহ দুর্যোগের মধ্য দিয়ে
অভ্রান্তলক্ষ্যে চলে এসেছ তোমরা,
দৃঢ় হাতে বহন করে এনেছ এই পতাকাকে |
কত রোষকষায়িত কশা, কত বলদর্পিত বুট
কত বর্বর বুলেট
ছিন্ন ভিন্ন করে দিয়েছে তোমাদের,
কিন্তু বজ্রমুষ্টি শিথিল করতে পারেনি,
স্খলিত করতে পারেনি তোমাদের পতাকার উদ্ধতি,
নমিত করতে পারেনি তোমাদের দুষ্পরাজেয় প্রতিজ্ঞা |
মায়ের বুকে সন্তানের মত
পক্ষিচঞ্চুপুটে তৃণখন্ডের মত
বারুদের বুকে বহ্নিকণার প্রত্যাশার মত
বহন করে এনেছে এই পতাকা
যাতে আমি প্রোথিত করতে পারি আমার প্রকাশ্য গৃহচূড়ে |
নবীনারম্ভের নিশ্বাসে বিস্তার করতে পারি বুক,
জজ্জ্বল উপলব্ধিতে উদ্ধত করতে পারি মেরুদন্ড |
লেখনীকে বিশ্বাস করতে পারছি না
যা আমি আজ লিখছি এই মুহূর্তে |
কত বাক্য রুদ্ধ হয়ে গেছে তোমাদের কন্ঠে
দলিত হয়েছে কত অরুন্তদ আর্তনাদ
স্তব্ধ হয়েছে কত বঞ্চিত বুকের দ্রোহবাণী |
সত্যভাষের সেই অধিকারকে তবু বিধ্বস্ত হতে দাওনি,
বহন করে এনেছ এই পতাকা
এই উদাত্ত বীরবার্তা ;
তন্দ্রিত আকাশে মুক্ত করে দিয়েছ
সিতপক্ষ কলহংসের কাকলি,
যাতে আমি পেতে পারি আমার ভাষা
লেখনীতে অপরাঙ্মুখ তীক্ষ্ণতা |
তাই আজ এই পতাকাকে যখন প্রণাম করি
প্রণাম করি তোমাদের দুর্জয় বীর্যবত্তাকে |
স্মরণ করি তোমাদের
যারা ফাঁসির রজ্জুকে মনে করেছে কন্ঠলগ্ন কোমল ফুলমালা
মৃত্যুতে দেখেছ অমরত্বের রাজধানী |
স্মরণ করি তোমাদের
নাগ-নক্ষত্র যাদের যাত্রা,
যারা কারাকক্ষে নিয়তিনির্দিষ্ট হয়ে
যাপন করেছে অবিচ্ছেদ্য অন্ধকার,
আকাঙ্ক্ষার অগ্নিতেজে তপ্ত রেখেছ বক্ষঃস্থল,
জতুগৃহদাহে দেখেছ ইন্দ্রপ্রস্থের নির্মিতি |
আর তোমাদের স্মরণ করি
সেই সব অগণন নানহীন পথিক পদাতিকের দল,
নির্বিশঙ্ক জীবনের আহ্বানে
পদে-পদে রক্তচিহ্নিত করেছ পথ-প্রান্তর-জনপদ,
ঘরে ঘরে জ্বেলেছ
জায়া-জননীর হাহাকারের দাবাগ্নি |
যাতে আমি জীবনে পেতে পারি মর্যাদা
অমূল্য মূল্যবোধ |
যাতে হাতে পেতে পারি তেজিষ্ঠ লেখনী
কন্ঠে পেতে পারি দুর্বার কলস্বন
আর প্রকাশ্য গৃহচূড়ে এই অপ্রকল্প পতাকা ||
সাধনা
নিন্দা হবে জানি-----
তবু রাণী, তোমার দ্বারেই সাধবো সেতার খানি |
আঙুল আমার বশ মানেনা, সুর ফোটে না তারে,
অধীর আবেগ আঘাত শুধু করে বুকের দ্বারে ;
তুমি তারে গুছিয়ে বেঁধে বশ মানিয়ে নিয়ে
সফল করে’ তোলো তোমার ভাবের আবেশ দিয়ে !
মর্ম্মরিয়া বাজুক সে তার মর্ম্মতারের মত
গুঞ্জরিয়া উঠুক বুকের গোপন ব্যথা যত ;
করুক লোকে কানাকানি, হাসুক যেবা হাসে----
তোমার চোখের দীপ্তিতে আজ দীক্ষা দেহ দাসে |
শঙ্কা তোমার নাই----
নিভৃত যে কুটীর খানি গ্রামের সীমানায় ;
উদার মাঠে নদী পারের পথটি গেছে বাঁকা,
শিয়রে তার নিঃশ্বসিছে বুনো-ঝাউয়ের শাখা |
এদিক বড় লোক চলেনা, ভাবে ---- যে জন যায়----
এমন সাঁঝে মাঠের মাঝে গজল কে বাজায় !
পথিক জানবে কেমন ক’রে কে লাগায় সে সুর ;
কাহার দেওয়া ব্যথায় হেথা সেতার ভরপুর !
না-হয় হেথায় নাইক প্রাসাদ, যন্ত্রী নাই বা আছে,
একটি ভক্ত জাগে তবু একটি দেবীর কাছে !
বিজন নদী তীর-----
ঝাউ শাখাতে ঘনায় ধীরে নিশীথ সুনিবিড় ;
দুয়ার না হয় খোলাই থাকুক, কিসের ক্ষতি তায় !
ভয় কোর’ না --- ভৃত্য দ্বারে রইল প্রতীক্ষায় !
দখিন বায়ে গৃহচ্ছায়ে কাঁপছে যে দীপ খানি,
সেই কাঁপনের সুরটি ধরে’ গমক যাবো টানি !
থরথরিয়ে কাঁপবে আঙুল , বক্ষ কাঁপবে সাথে,
অশ্রু কাঁপবে নয়ন-পাতে ব্যাকুল বেদনাতে |
মূর্চ্ছামগ্ন মৌন রাতি প্রহর বেড়ে যায়
ঝিঁঝির ঝুমুর সঙ্গে কাঁদে সেতার মূর্চ্ছনায় |
বাতাস যদি থামে,-----
ভোরের রাতে হঠাৎ ছাতে বাদল যদি নামে ;
দুয়ার ফাঁকে হাওয়ার হাঁকে প্রদীপ যদি নিবে !
ভক্ত তোমার বাহির দ্বারে, আগলটি কি দিবে !
দীপ নিবে যায়, কি ক্ষতি তায়---কি ফল বলো লাজে,
মল্লারেতে মীড় মিলিয়ে সেতার যে তার বাজে !
মেঘের পর্দ্দা ঘনায় যদি অন্ধ রাতের পরে,
কি প্রয়োজন, দুয়ার দেওয়া রইল কিনা ঘরে !
অশ্রু নামে বর্ষাসম ---- হায় গো রাণী হায়,
মুর্ত্তীমতী সিদ্ধি কি তার ফলবে সাধনায় |
ঐরে এল আলো-----
রক্ত ঊষা পরল ভূষা সাদার সাথে কালো |
বায়ুর কন্ঠে নাই গরজন, ভজন গাহে পাখী,
পূর্ব্বাচলের তোরণ দ্বারে অরুণ মেলে আঁখি ;
উদাস তব নয়ন-তারার পান্ডু করুণ ছবি----
এই বেলা তার সুর মিলিয়ে বাজারে ভৈরবী |
সাধক, তুমি সিদ্ধ আজি-----পূর্ণ মনোরথ,
ওই সুরে তোর যায় রে দেখা নূতন সুরের পথ |
যে যা বলে বলুক লোকে ভক্ত তোরই জয়,
বাণীর সাথে বীণার আজি নিবিড় পরিচয় !
স্বপ্ন দেশ
আজ ফাল্গুনী চাঁদের জ্যোছনা-জুয়ারে ভুবন ভাসিয়া যায়,
ওরে স্বপন-দেশের পরী-বিহঙ্গী, পাখা মেলে উড়ে' যায়'!
এই শ্যামল কোমল ঘাসে এই বিকচ পুন্দরাশে
এই বন-মল্লিকাবাসে, এই ফুরফুরে মলয়ায়---
তোর তারালোক হ'তে কিরণ-সুতায় ধীরে ধীরে নেমে আয়ে |
দেখ্ ঘাসের ডাঁটায় ফড়িং ঘুমায় সবুজ-স্বপন-সুখে,
দেখ্ পদ্মকোরকে অচেতন অলি শেষ মধুকণা মুখে!
হেথা ঝিঁঝির ঝি ঝিট তান, দেখ নিশি শেষে অবসান,
ছোট টুনটুনিদের গান এবে বিরত ক্লান্ত বুকে ;---
দেখ্ মোহ-মুর্ছিত মুখর ধরণী, সব ধ্বনি গেছে চুকে' ||
তোরে শিরীষ-ফুলের পাপড়ি খসায়ে পরাগ করিব দান,
তোরে রজনীগন্ধা গেলাস ভরিয়া অমিয়া করাব পান ;
শেষে ঘুম যদি তোর পায় হোথা ঘুমাবি হিন্দোলায়,
মোরা মৃদু দোল দিব তায়, গাহি' মৃদু-গুঞ্জন গান,---
চারু ঊর্ণনাভের ঝিকিমিকি জালে কেশরের উপাধান |
শেষে জোনাকির আলো নিভাবে যখন ঊষার কুয়াশাসারে,
মোরা স্বপন-শয়ন ভাঙি' দিব তোর পাপিয়ার ঝংকারে!
যদি ফিরে' যেতে মন চায়, যাস্ ঝিরি ঝিরি ঊষা-বায়,
চড়ি' প্রজাপতির পাখায়--- হিম সিক্ত শিশিরধারে ;
সাথে নিয়ে যাস্ এই রজনীর স্মৃতি ধরণীর পরপারে ||
সাধন পথে
[ব্রহ্মবাদী, ভাদ্র, ১৩৪৩]
এক বিন্দু অমৃতের লাগি
কি আকুল পিপাসিত হিয়া,
এক বিন্দু শান্তির লাগিয়া
কর্মক্লান্ত দুটি বাহু দিয়া---
কাজ শুধু করে যায়
অন্তরেতে দুরন্ত সাধনা,
তুমি তার দীর্ঘ পথে
হবে সাথী একান্ত ভাবনা |
সে জানে এ আরাধনা
কবে তার হইবে সফল ;
তব বাণী যেই দিন তারি
ভাষা হয়ে ঘুচাবে সকল
অন্তরের অহঙ্কার,
স্তুতি, নিন্দা, ভয়
সেদিন লভিবে শান্তি,
সংগ্রামে বিজয় |
তোমার স্বরূপে তার রূপ হবে লীন!
সেই তার সাধনার পরম সুদিন |
সিংহ গাধা ও অন্যান্য
১.
মানুষ সিংহের প্রশংসা করে,
তবে গাধাকেই আসলে পছন্দ করে।
আমার প্রতিভাকে প্রশংসা করলেও
ওই পুঁজিপতি গাধাটাকেই
আসলে পছন্দ কর তুমি।
২.
তোমাকে নিয়ে এতোগুলো কবিতা লিখেছি।
তার গোটাচারি শিল্পোত্তীর্ণ
আর অন্তত একটি কালোত্তীর্ণ।
এতেই সবাই বুঝবে তোমাকে আমি পাই নি কখনো।
৩.
প্রাক্তন দ্রোহীরা যখন অর্ঘ্য পায়
তাদের কবরে যখন স্মৃতিস্তম্ভ মাথা তোলে
নতুন বিদ্রোহীরা কারাগারে ঢোকে
আর ফাঁসিকাঠে ঝোলে।
৪.
মেয়ে, তোমার সুন্দর মনের থেকে
অনেক আকর্ষণীয়
তোমার সুন্দর শরীর।
৫.
যখন তোমার রিকশা উড়ে আসে
সামনের দিক থেকে প্রজাপতির মতো
তখন পেছন দিক থেকে দানবের মতো ছুটে আসে
একটা লকলকে জিভের ট্রাক
প্রজাপতি আর দানবের মধ্যে আমি পিষ্ঠ চিরকাল।
সবিনয় নিবেদন
শঙ্খ ঘোষ
আমি তো আমার শপথ রেখেছি
অক্ষরে অক্ষরে
যারা প্রতিবাদী তাদের জীবন
দিয়েছি নরক করে |
দাপিয়ে বেড়াবে আমাদের দল
অন্যে কবে না কথা
বজ্র কঠিন রাজ্যশাসনে
সেটাই স্বাভাবিকতা |
গুলির জন্য সমস্ত রাত
সমস্ত দিন খোলা
বজ্র কঠিন রাজ্যে এটাই
শান্তি শৃঙ্খলা |
যে মরে মরুক, অথবা জীবন
কেটে যাক শোক করে—
আমি আজ জয়ী, সবার জীবন
দিয়েছি নরক করে |
সায়াহ্নে
হে পান্থ, কোথায় যাও কোন্ দূরদেশে
কার আশে? সে কি তোমা করিছে আহ্বান?
সম্মুখে তামসী নিশা রাক্ষসীর বেশে
শোন না কি চারিদিকে মরণের তান!
সে তোমারে ওহে পান্থ, হাসিমুখে এসে,
সে তোমারে ছলে বলে গ্রাসিবে এখনি |
যেয়োনা একাকী পান্থ, সে দূর বিদেশে,
ফিরে এসো, ওহে পান্থ, ফিরে এসো তুমি |
এ ক্ষুদ্র জীবন লয়ে কেন এত আশা?
জান না কি এ জগত্ নিশার স্বপন?
মায়া মরীচিকী প্রায় স্নেহ ভালবাসা---
জীবনের পাছে ওই রয়েছে মরণ
হে পান্থ হেথায় শুরু আঁধারের স্তর ;
মৃত্যুর উপর মৃত্যু, মৃত্যু তার পর!
সাত সাগরের মাঝি
কত যে আঁধার পর্দা পারায়ে ভোর হল জানি না তা ।
নারঙ্গি বনে কাঁপছে সবুজ পাতা ।
দুয়ারে তোমার সাত সাগরের জোয়ার এনেছে ফেনা।
তবু জাগলে না ? তবু, তুমি জাগলে না ?
স্রোতে রাজহাঁস আসছে
কোমল জলের ঘ্রাণ মাখুক হাঁসেরা;
বহুদিন পর ওরা জলে নামছে, বহুদিন পর ওরা কাটছে সাঁতার
স্রোতে রাজহাঁস আসছে, আসতে দাও,
বহুদিন পর যেনো রোদ আসছে, আসতে দাও
নত হতে দাও আকাশকে,
আর একটু নত হোক আলো
আর একটু নির্জন হোক অন্ধকার !
আর তুমি পরে নাও তোমার গহনা, দুল
তোমার আঙ্গুল হোক হেমন্তের ফুল,
আমি শুঁকি, শুঁকতে দাও !
বহুদিন পর যেনো শুঁকছি বকুল !
বহুদিন তোমার ভিতরে যাইনা, বহুদিন বকুল ফুলের ঘ্রাণ
পাইনা এ মনে !
মনে করতে দাও তবু কোনখানে বকুলবাগান ছিল
গেরস্থের হাজার দুয়ারী ঘরবাড়ি
উঁচু আসন, সিংহাসন
মনে করো, মনে কোরে নাও
আমাদেরও সিংহাসন আছে আজও
আমাদের হাজার দুয়ারী বাড়ি আছে
মাটির ময়ূর, ঠোঁটে ঠোঁট, ফুলে ফুল
লুকোনো ডাকবাকস আছে সবুজের কাছে
মনে করো আমাদেরও ভালোবাসা আছে
খাগের কলমে লেখা তাদের অক্ষরগুলি
ধানের শীষের মতো টলমলায় সেখানে শরীরে
তুমি মনে করো, মনে করে নাও
তোমার শরীরে শাড়ি,
গেরস্থের হাজার দুয়ারী ঘরবাড়ি
আলো আর অন্ধকার মনে করো, মনে করে নাও
আমরা নৌকার জলে ভাসতে ভাসতে যেনো প্রতীকের হাঁস
ঐ রাজহাঁস
জল থেকে আরো জলে,
ঢেউ থেকে আরো ঢেউয়ে ছড়াতে ছড়াতে
পৌঁছে যাবো আগে।
শেষ মুহূর্তের কবিতা
আমার মৃত্যুর জন্য কেউ দায়ী নয়
প্রকৃতপক্ষে আমার মৃত্যুর জন্য তুমিই দায়ী
অসম্ভব ঘন কাঁচের ভেতর থেকে তোমাকে দেখতে
পাত্র ভর্তি পারদের ভেতর থেকে বিরল স্পর্শ করতে
স্বপ্নের ভেতরে একসাথে আকাশে-আকাশে শঙ্খচিল হতে
পৃথিবীর জন্যে একটা মৃত্যু তেমন কিছু নয়
কিন্তু মানুষের জন্যে একটা মৃত্যু সাংঘাতিক শূন্যতা
ঘাসের চোখ থেকে শিশির শুকিয়ে যাওয়ার মতো
সুর সৃষ্টিতে পরাজিত মার্সিয়াসের শরীর থেকে
চামড়া ছাড়িয়ে নেয়ার মতো
পেগাসাস পঙ্খীরাজের পেছনে একটা ডাসকে
লেলিয়ে দেয়ার মতো
অপেক্ষায় আছি এই আত্মবোধন থেকে আমাকে বাঁচাবে
উদ্যত নৃশংস ক্রুরছুরির অন্তিম আলোয় জাপটে ধরবে হাত
অনন্তকাল আমার দিকে তীব্র তাকিয়ে থাকবে
যত ইচ্ছা আমি তোমাকে বাতাসের মতো স্পর্শ করবো
আষাঢ়ের মেঘমন্দ্রের মতো অনবরত তোমার কণ্ঠস্বর শুনবো
আভারনাস-হ্রদের আকাশে শঙ্খচিল হবো
কখনো-কখনো মৃত্যু একটা বেলেহাঁসের পালকের চেয়েও হালকা
কখনো-কখনো আলপসের চেয়ে ভারি
কিন্তু আমার আত্মমৃত্যু পৃথিবীর মতো বিবর্তমান
আমার এখনো অনেক কিছু দেখা হয়নি
পৃথিবীর বড় বড় সভ্যতা ও সমুদ্র
নেমেসিসের শবাধার, সক্রেটিসের সৌন্দর্য, হোমারের অন্ধত্ব
তোমার চোখের মতো চিল্কার হ্রদের আস্ত আকাশ
এমনকি দান্তের নরকের একটা হিংস্র চিতাবাঘ
তবু এই অসম্পূর্ণতার মধ্যেই মেনে নিচ্ছি মৃত্যু
লিখতে হচ্ছে আমার মৃত্যুর জন্যে কেউ দায়ী নয়
সোনালি আর ডালিয়া
সোনালির সঙ্গে ডালিয়ার দেখা হয়ে গেল একদিন।
ডালিয়াকে জড়িয়ে ধরল সোনালি।
ডালিয়া বলল—আপনি কে?
সোনালি বলল—আমি সোনালি।
কত নাম শুনেছি তোমার।
তোমাকে তো দেখামাত্র চিনে ফেললাম।
ডালিয়া বলল—কার কাছে নাম শুনেছেন আপনি?
নাম বলল সোনালি।
ছায়া নামল ডালিয়ার দুধের মতো ফরসা মুখমণ্ডলে।
বলল শুধু—ও।
সোনালি বলে—মুখ কালো হয়ে গেল কেন তোমার?
উনি সারাক্ষণই তোমার কথা বলেন।
ম্লান মুখে ডালিয়া বলল—
সে-সব কথা ভুলে গেছি আমি।
আমার কথা বলে লাভ আছে আর?
সোনালির উত্তর—সে-কথা আমিও বলি।
কবিতা লিখে কী হবে?
জীবনে তো...
তারপরই সোনালি বলে—
ওনার আসল কে, চেনো না তুমি।
—কে?—
সোনালি হাসতে থাকে।
—তুমি আমি কেউ না। তার নাম কবিতা।
—কে মেয়েটা?
সোনালি বলে—চলো, কোথাও বসি।
কফি খেতে খেতে তোমাকে বলছি সব।
সেরগেই এসেনিন বলছে
ইসাডোরা, বার্লিনে তোমার সঙ্গে আছি আমি।
আমার সঙ্গে আরেক কবি – গাধাও বলতে পারো -
গলায় ঝোলানো গিটার,
খামোখাই,
বাজাতে-টাজাতে পারে না।
কোত্থেকে এলেন আমাদের সেই মহাকথাশিল্পী,
ম্যাকসিম গোর্কি।
চেহারা ভাঙাচোরা হলে কী হবে,
চোখ দুটিতে তাঁর যেন ছুরির ঝলক,
সেই চোখ সব-কিছুর অন্তস্তলে ঢুকে যায়।
আমার দিকে তাকিয়ে গোর্কি,
চোখে স্নেহ ঝরে পড়ছে,
বললেন, ‘এসেনিন, কবিতা লিখছ তো?’
আমি পাশের গাধা-কবিটার সঙ্গে
তাঁর পরিচয় করিয়ে দিলাম।
ছোট্ট একটা ঘরের মধ্যে তুমি নাচছ, ইসাডোরা।
মরচে-রঙা পোশাক তোমার।
তোমার আধ-খোলা স্তনজোড়ার বিভাজিকায়
একগুচ্ছ মলিন ফুলের স্তবক।
নাচছিলে তুমি -
কী-যে বিচ্ছিরি লাগছিল তোমাকে!
গেলাশে চুমুক দিয়ে
তাকাচ্ছিলাম চোখের কোনায়।
তারপর
ক্লান্ত হাঁটু মুড়ে
একটা মাদি-ঘোড়ার মতো
যেন ভেঙে পরলে আমার পায়ের কাছে।
ঠোঁটে অর্থহীন বাঁধানো হাসি নিয়ে
তাকালে আমার দিকে।
আমি তো তোমার ভাষা জানি না।
রিয়াজানের ছেলে আমি।
ইঙ্গিতে,
কনুইয়ের ঠেলায়,
হাঁটুর গুঁতোয়
আমার কথা ঠিকঠাকই জানিয়ে দিচ্ছিলাম তোমাকে।
এখানে যারা আছে তারা কিছু না-বুঝলেও,
গোর্কির তীক্ষ্ম চোখই বলে দিচ্ছিল :
আমি তোমার শরীরের
গোপনতম তিলটিরও খোঁজ রাখি।
আমাকে যখন কবিতা আবৃত্তি করতে বলা হলো,
উঠলাম।
আমার কণ্ঠস্বরের সঙ্গে
ওঠানামা করছিল আমার হাত।
শ্রোতা-দর্শকদের চোখ-মুখ জানিয়ে দিচ্ছিল
তারা কিরকম উদ্দীপিত হয়ে উঠছে।
বিশ্ববিখ্যাত হতে পারো তুমি,
কিন্তু তোমার নৃত্যের ঘূর্ণি-যে অন্তত আজ,
এখানে,
এই আসরে,
কিছু নয় -
সেটাও আয়নার মতো পরিষ্কার ফুটে উঠছিল
ওদের চোখে।
আর তারপর তুমি
বেহায়ার মতো
সব রুশীদের চুমো খাচ্ছিলে।
মদ-জড়ানো গলায়
বলছিলে তোমার ভাঙা রুশ ভাষায়,
‘আহা, রাশিয়ানরা কত ভাল!
এরকম দেখিনি আর-কোথাও!’
সব বাহানা!
সবাইকেই তুমি বলো ওরকম!
এ তো আমার নিজের চোখে দেখা -
মার্কিনিদের সঙ্গে,
ব্রিটিশদের সঙ্গে,
ফরাশিদের সঙ্গে
একই তোষামুদে ভাষায় কথা বলেছ।
একেবারে একই ভাষায়।
ছিঃ!
রিয়াজানের গ্রামীণ যুবতীরাও তোমার চেয়ে সুন্দর!
*
আমি বেরিয়ে এলাম।
একা।
বার্লিনের পথ-ঘাট কিছু চিনি না।
ঘুরতে ঘুরতে নদীতীরে এলাম।
কে-একজন বলল, এর নাম বুড়িগঙ্গা নদী!
আমি ঝাঁপিয়ে পড়লাম।
এই নদী থেকে অন্য নদীতে পড়ব -
সেই নদী থেকে আরেক নদীতে -
এম্নি করে পৌছে যাব একদিন
ইছামতী নদীতে।
তারপর সাঁৎরে উঠব পাড়ে।
পৌছে যাব জালালপুর গ্রামে।
আম-জাম-কাঁঠালগাছে সবুজে-সবুজ
আমাদের সেই বাড়িতে গিয়ে উঠব।
সেখানে আমার জন্যে অপেক্ষা করে আছে সবাই।
সৃষ্টিশীলতার প্রতি
শুধু তোমাকে সালাম– আর কাউক্কে তোয়াক্কা করি না,
আর-সব-পায়ে-দলা মুথাঘাস– শুধু তুমি ঘাসে রত্নফুল,
আর-সব নোংরা টাকা-পয়সার মতো : হাতে-হাতে ঘোরে-ফেরে–
শুধু তুমি অমল-ধবল তুমি,
তোমার আহারে শুধু ঘড়ি লাগে– আর-কিছুই রোচে না তোমার,
নামো ঝরনা ফাটিয়ে পাথর– সৃষ্টি তার মুখোশ ছিঁড়েছে,
বস্তুর বিরুদ্ধে শুধু অফুরান প্রজাপতি ওড়ে ।
সাবেকি
গেলো
গুরুচরণ কামার, দোকানটা তার মামার,
হাতুড়ি আর হাপর ধারের ( জানা ছিল আমার )
দেহটা নিজস্ব |
রাম নাম সত্ হ্যায়
গৌর বসাকের প’ড়ে রইল ভরন্ত খেত খামার |
রাম নাম সত্ হ্যায় ||
দু-চার পিপে জমিয়ে নস্য হঠাত্ ভোরে হ’লো অদৃশ্য—
ধরনটা তার খ্যাপারই—
হরেকৃষ্ণ ব্যাপারি |
রাম নাম সত্ হ্যায়
ছাই মেখে চোখ শূণ্যে থুয়ে, পেরেকের খাট তাতে শুয়ে
পলাতক সেই বিধুর স্বামী
আরো অপার্থিবের গামী
রাম নাম সত্ হ্যায়
রান্না রেঁধেকান্না কেঁদে, সকলের প্রাণে প্রাণে বেঁধে
দিদি ঠাকরুন গেলেন চ’লে—
খিড়কি দুয়োর শূণ্যে খোলে!
রাম নাম সত্ হ্যায়
আমরা কাজে রই নিযুক্ত, কেউ কেরানি কেউ অভুক্ত,
লাঙল চালাই কলম ঠেলি, যখন তখন শুনে ফেলি
রাম নাম সত্ হ্যায়
শুনবো না আর যখন কানে বাজবে তবু এই এখানে
রাম নাম সত্ হ্যায় ||
স্রষ্টা
আমিও তোমারি মত সৃজিয়াছি একখানি অপূর্ব্ব ভূবন,
সেথা রাত্রি নেমে আসে বক্ষে ল’য়ে বিরহের ব্যথা-গুঞ্জরণ
রিক্তা নিরাভরণার মত,
অঙ্গে ধরি’ ব্যর্থতার ব্রত !
প্রেমের প্রাচুর্য্য দিয়া রচিয়াছি আকাশের মঙ্গল মহিমা,
ব্যথার লাবণ্য দিয়া আঁকিয়াছি শরতের প্রশান্ত নীলিমা.
রামধনু আঁকিয়াছি অস্ফুট চুম্বনে,
গগন-কম্পন-ব্যথা মুগ্ধ আলিঙ্গনে ;
অসংখ্য আশার ভাতি জ্বালায়েছি নয়নে তারার,
অশ্রু দিয়া গড়িয়াছি নবঘনপুঞ্জিত আষাঢ় !
যৌবনের ইচ্ছাখানি ছন্দি তুলি জলদের কম্পন-আনন্দে ;
মনের নিকুঞ্জতল পুঞ্জ পুঞ্জ বেদনার কেতকী-সুগন্ধে
আন্দোলিয়া উঠিছে উতলি’ ;----
আকাঙ্ক্ষার বিহঙ্গ-কাকলী !
যেমন তুমি হে কবি, রচিয়াছ এ সুন্দর সৃষ্টির কবিতা,
আপন আনন্দ-ছন্দে মেলিয়াছ নব নব বর্ণ-বিলাসিতা, ----
তেমনি আমিও কবি, আমার কল্পনা
আঁকে নিত্য আনন্দের শুভ্র আলিম্পনা !
নিত্য মায়া-মহোত্সব আমার সে মর্ম্মরিত মর্ম্মের জগতে,
প্রিয়া সেথা চিরযাত্রী পল্লব-হিল্লোল-ফুল্ল ফাল্গুনের রথে-----
গানের কুসুম দিয়া সেথা নিত্য মাল্য-বিচরন,
ব্যথিত বুকের গৃহে সেথা মোর বাসক-শয়ন,
সেথা নিত্য আশা যায় বুনি’
আকাশের ফুলের ফাল্গুনী !
আমিও তোমার মত হে মায়াবী শিল্পকার, হে ক্ষ্যাপা খেয়ালী,
বেদনার রসায়নে রচি নিত্য আনন্দের দীপের দেয়ালি ;
অন্তর ব্যঞ্জনা দিয়া মঞ্জুল করেছি মোর মনের মঞ্জুষা ,
সেথা রাত্রি-অবসানে দেখা দেয় তনুগাত্রী জ্যোতির্ম্ময়ী ঊষা ;
সেথা সূর্য্য-সন্তানের নব নব জন্মের উত্সব,
আলোকের স্তোত্রে স্তোত্রে আনন্দের মন্ত্র-কলরব ;
সেথা ফোটে প্রেমের মালতী,
তাই সেথা অরুণ-আরতি !
যেমন তুমি গো তারপর
ভেঙে ফেল’ স্বপ্ন-খেলা-ঘর,
ধূলির সঞ্চয় কাড়ি’ নিঃসম্বল কর ধরণীরে,
সৃষ্টির কবিতাখানি অবহেলে ফেলে’ দাও ছিঁড়ে ;
তেমনি আমিও একদিন
অশান্ত, বিরক্ত, তৃপ্তিহীন----
দারুণ হেলার ভরে চূর্ণ করি আনন্দ-লেখনী,
দীর্ঘশ্বাসে ভস্ম করে দিয়ে যাই স্বপ্নের বিপণি !
দুইজনে ভয়ঙ্কর, বীভত্স, নিষ্ঠুর,
শুধু ছবি আঁকি বসে জীবন মৃত্যুর !
আমার ভুবনে আমি তোমা মত খুসী-ক্ষ্যাপা স্রষ্টা ভগবান,
কাহারে বঞ্চিত করি, বক্ষ ভরি’ কাহারে সর্ব্বস্ব করি দান |
মিলন-চুম্বন কা’রে, কাহারে বা আতপ্ত বিরহ,
কা’রে দগ্ধ মরুভূমি, কা’রে বর্ষা-স্নিগ্ধ অনুগ্রহ !
আমার খেয়াল মত গান গাহি ভৈরবী বিভাসে,
ধন্য করি কা’রে প্রেমে , খিন্ন করি কা’রে দীর্ঘশ্বাসে ;
কা’রে কন্টকের মালা, কা’রে বা মাধবী,
যাহা খুশি দান করি তোমা-সম, কবি !
আমিও তোমারি মত পাইয়াছি অমূল্য সে স্বর্ণ-সিংহাসন,
রাত্রি দিন সেথা বসি’ মূল্যহীন রাজত্বের করি আয়োজন ;
অকারণে বসে’ বসে’ ক্ষণিকের ক্ষণপ্রভা হানি,
তার পরে ইচ্ছা হ’লে মৃত্যুর গুন্ঠন দিই টানি’
একে একে মিশে’ যায় মূল্যহীন স্বপ্নের বুদ্বুদ,
আতঙ্কে নিবিয়া যায় সৃষ্টির সে রহস্য-বিদ্যুৎ,
পড়ে’ থাকে বিদীর্ণ বাঁশরী,
ভগ্ন যত ভাবের গাগরী ||
সব রৌদ্র ফিরে যায় না
রাতের ফাঁকে যেমন তুমি।
কোথায় ছিলে ? কোন্ পাহাড় কোন্ পোস্টাফিসে
চিঠির মতো
ভোরের মতো কোন্ জানালায় তাকিয়ে ছিলে
চোখের ছায়ায় ?
সব রৌদ্র ফিরে যায় না লুকিয়ে থাকে
পথের পাশে
কাঁচের মতন গোল গেলাসে
জলের ছায়ায়
ফিরে আসে, যেমন তুমি ফিরে এলে।
স্মৃতি বড় উচ্ছৃঙ্খল
পুরনো পকেট থেকে উঠে এল কবেকার শুকনো গোলাপ |
কবেকার ? কার দেওয়া ? কোন্ মাসে ? বসন্তে না শীতে ?
গোলাপের মৃতদেহে তার পাঠযোগ্য স্মৃতিচিহ্ন নেই |
স্মৃতি কি আমারও আছে ? স্মৃতি কি গুছিয়ে রাখা আছে
বইয়ের তাকের মত, লং প্লেইং রেকর্ড-ক্যাসেটে
যে-রকম সুসংবদ্ধ নথীভুক্ত থাকে গান, আলাপচারীতা ?
আমার স্মৃতিরা বড় উচ্ছৃঙ্খল, দমকা হাওয়া যেন
লুকোচুরি, ভাঙাভাঙি, ওলোটপালটে মহাখুশি
দুঃখেরও দুপুরে গায়, গাইতে পারে, আনন্দ-ভৈরবী |
আকাঙ্খার ডানাগুলি মিশে গেছে আকাশের অভ্রে ও আবীরে
আগুনের দিনগুলি মিশে গেছে সদ্যজাত ঘাসের সবুজে
প্রিয়তম মুখগুলি মিশে গেছে সমুদ্রের ভিতরের নীলে |
স্মৃতি বড় উচ্ছৃঙ্খল, দুহাজার বছরেও সব মনে রাখে
ব্যাধের মতন জানে অরণ্যের আদ্যোপান্ত মূর্তি ও মর্মর |
অথচ কাল বা পরশু কে ডেকে গোলাপ দিল কিছুতে বলবে না |