Showing posts with label alk001. Show all posts
Showing posts with label alk001. Show all posts

অচিন্ত্যকুমার সেনগুপ্ত

কবি পরিচিতি:অচিন্ত্যকুমার সেনগুপ্ত একজন বাঙালি কবি, ঔপন্যাসিক ও সম্পাদক। ১৯শে সেপ্টেম্বর, ১৯০৩ সালে পিতার কর্মস্থল নোয়াখালী শহরে তাঁর জন্ম হয়। তবে তাঁর পরিবারের আদি নিবাস ছিল বর্তমান মাদারিপুর জেলায়। তাঁর বাবা রাজকুমার সেনগুপ্ত নোয়াখালী আদালতের আইনজীবী ছিলেন।
অচিন্ত্যকুমারের শৈশব, বাল্যজীবন, ও প্রাথমিক শিক্ষা নোয়াখালীতেই সম্পন্ন হয়। ১৯১৬ সালে বাবার মৃত্যুর পর তিনি কলকাতায় অগ্রজ জিতেন্দ্রকুমার সেনগুপ্তের নিকট চলে যান এবং সাউথ সাবার্বান স্কুল থেকে ম্যাট্রিক (১৯২০), সাউথ সাবার্বান কলেজ (বর্তমান আশুতোষ কলেজ) থেকে আই. এ. (১৯২২), এবং ইংরেজি সাহিত্যে অনার্সসহ বি. এ. (১৯২৪) পাস করেন। কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ইংরেজিতে এম. এ (১৯২৬) ও পরবর্তীতে বি. এল ডিগ্রী (১৯২৯) লাভ করেন। ১৯৩১ সালে তিনি অস্থায়ী মুন্সেফ হিসেবে কর্মজীবন শুরু করেন এবং ক্রমে সাব-জজ, জেলা জজ ও ল' কমিশনের স্পেশাল অফিসার পদে উন্নীত হয়ে ১৯৬০ সালে চাকরি থেকে অবসর গ্রহণ করেন। ১৯২১ সালে প্রবাসী পত্রিকায় নীহারিকা দেবী ছদ্মনামে অচিন্ত্যকুমারের প্রথম কবিতা প্রকাশিত হয়। রবীন্দ্রনাথ ও শরৎচন্দ্রের পরে সাহিত্যজগতে আলোড়ন সৃষ্টিকারী কল্লোল যুগের লেখকদের মধ্য তিনি ছিলেন অন্যতম। অচিন্ত্যকুমার ১৯২৫ সালে কল্লোল পত্রিকা প্রকাশনার দায়িত্ব নেন। তিনি বিচিত্রায়ও কিছুদিন কাজ করেন। তিনি উপন্যাস ও ছোটগল্প রচনায় বিশেষ কৃতিত্ব দেখান। তিনি উপন্যাসের আঙ্গিকে আবেগপূর্ণ ভাষায় ধর্মগুরুদের জীবনীও (যেমন- পরমপুরুষ শ্রীরামকৃষ্ণ, চার খণ্ডে (১৯৫২-১৯৫৭)) লিখেছেন। তাঁর প্রথম উপন্যাস বেদে (১৯২৮); এটি আঙ্গিক, রচনাভঙ্গি ও বিষয়বিন্যাসে আধুনিক বাংলা সাহিত্যের একটি বিশিষ্ট উপন্যাস। তাঁর লেখায় আধুনিকতা অতি প্রবলভাবে ফুটে উঠেছে। কাকজ্যোৎস্না " প্রথম কদমফুল তাঁর অন্য দুইটি বিখ্যাত উপন্যাস। ছোটগল্পশিল্পী হিসেবেও তিনি খ্যাত। বিচারবিভাগে চাকরির বদৌলতে তিনি বাংলাদেশের নানা স্থানে ঘুরে বিভিন্ন শ্রেণীর মানুষের সংস্পর্শে আসেন; এইসব অন্তরঙ্গ পরিচিতজনদের জীবনের নানা কাহিনী অচিন্ত্যকুমার তাঁর ছোট গল্পগুলিতে নিপুণভাবে এঁকেছেন। টুটাফাটা (১৯২৮) তাঁর প্রথম ছোট গল্পের বই।
তাঁর স্মৃতিচারণমূলক গ্রন্থ কল্লোল যুগ (১৯৫০) পাঠক-মহলে বেশ সাড়া জাগায়। সাহিত্য ও সাংবাদিকতায় বিশেষ অবদানের জন্য তিনি জগত্তারিণী পুরস্কার, রবীন্দ্রস্মৃতি পুরস্কার (১৯৭৫) ও শরৎচন্দ্রস্মৃতি পুরস্কার (১৯৭৫) লাভ করেন। ১৯৭৬ সালের ২৯ জানুয়ারি কলকাতায় তাঁর মৃত্যু হয়।

সূচী:
আজি রজনীতে
কুটির
তোমারে ভুলিয়া গেছি
পুব-পশ্চিম
প্রথম যখন
প্রিয়া ও পৃথিবী
রবীন্দ্রনাথ
রোগ শয্যায়
স্বাধীনতা
স্রষ্টা

আজি রজনীতে

অচিন্ত্যকুমার সেনগুপ্ত

আজি রজনীতে জানালার ধারে ফুটেছে আমার হেনা,
ওর পানে চেয়ে মনে পড়ে সেই বলেছিলে,---ভুলিবে না !
আছ কি নিদ্রাগত,
চোখের পাতায় ঘুম নেমেছে কি আমার স্নেহের মত ?
সফেনপুঞ্জা তটিনীর নীরে তুমি নবেন্দুরেখা,
দুখ-জাগানিয়া কোন্ বাঁশরীর অস্ফুট গীতলেখা !
শেষবিস্তারপান্ডুর তব স্তনকোরকের জ্যোতি,-----
শিথিল শিথানে কারে মোহিয়াছো---ব্রীড়ায় বেপথুমতী !
গোপন মিলন সুখে
মৃণালমৃদল দুটি বাহু দিয়ে জড়ায়েছো কা’রে বুকে !
পল্লবরাগতাম্র অধরে কার তরে এত মধু,
কা’র করে লীলাকমল তুমি গো, কার তুমি লীলাবধূ !
তনুতট উচ্ছল
শিশিরশীতল কপোলে পড়েছে বিচূর্ণকুন্তল !
হেথায় আঁধার নেমেছে নিবিড় কাকপক্ষের মত,
মনে আনে কা’র কালো দুটি আঁখি মমতায় সন্নত !
ফুটেছে ব্যথার হেনা,-----
কেন ঘুমাইলে, ---- আমার মতন কেন তা’রে চিনিলে না ?

রবীন্দ্রনাথ

অচিন্ত্যকুমার সেনগুপ্ত

আমি তো ছিলাম ঘুমে,
তুমি মোর শির চুমে
গুঞ্জরিলে কী উদাত্ত মহামন্ত্র মোর কানে-কানে !
চলো রে অলস কবি
ডেকেছে মধ্যাহ্ন-রবি
হেথা নয়, হেথা নয়, অন্য কোথা, অন্য কোনখানে |

চমকি উঠিনু জাগি’
ওগো মৃত্যু-অনুরাগী
উন্মুখ ডানায় কোন অভিসারে দূর-পানে ধাও,
আমারো বুকের কাছে
সহসা যে পাখা নাচে------
ঝড়ের ঝাপট লগে হয়েছে সে উন্মত্ত উধাও |

দেখি চন্দ্র-সূর্য-তারা
মত্ত নৃত্যে দিশাহারা,
দামাল যে তৃণশিশু, নীহারিকা হয়েছে বিবাগী,
তোমার দূরের সুরে
সকলি চলেছে উড়ে
অনির্ণীত অনিশ্চিত অপ্রেমেয় অসীমের লাগি’ |

আমারে জাগায়ে দিলে,
চেয়ে দেখি এ-নিখিলে
সন্ধ্যা, ঊষা, বিভাবরী, বসুন্ধরা-বধূ বৈরাগিণী ;
জলে স্থলে নভতলে
গতির আগুন জ্বলে
কূল হ’তে নিলো মোরে সর্বনাশা গতির তটিনী |

তুমি ছাড়া কে পরিতো
নিয়ে যেতে অবারিত
মরণের মহাকাশে মহেন্দ্রের মন্দির-সন্ধানে ;
তুমি ছাড়া আর কার
এ-উদাত্ত হাহাকার-----
হেথা নয়, হেথা নয়, অন্য কোথা, অন্য কোনখানে |

পুব-পশ্চিম

অচিন্ত্যকুমার সেনগুপ্ত

তোমার শীতললক্ষ্যা আর আমার ময়ূরাক্ষী
তোমার ভৈরব আর আমার রূপনারায়ণ
তোমার কর্ণফুলি আর আমার শিলাবতী
তোমার পায়রা আর আমার পিয়ালী
এক জল এক ঢেউ এক ধারা
একই শীতল অতল অবগাহন, শুভদায়িনী শান্তি |
তোমার চোখের আকাশের রোদ আমার চোখের উঠোনে এসে পড়ে
তোমার ভাবনার বাতাস আমার ভাবনার বাগানে ফুল ফোটায় |

তোমার নারকেল সুপুরি অশোক শিমুল
আমার তাল খেজুর শাল মহুয়া
এক ছায়া এক মায়া একই মুকুল মঞ্জরী |
তোমার ভাটিয়াল আমার গম্ভীরা
তোমার সারি-জারি আমার বাউল
এক সুর এক টান একই অকূলের আকূতি
তোমার টাঙ্গাইল আমার ধনেখালি
তোমার জামদানি আমার বালুচর
এক সুতো এক ছন্দ একই লাণ্যের টানা-পোড়েন
চলেছে একই রূপনগরের হাতছানিতে |

আমরা এক বৃন্তে দুই ফুল, এক মাঠে দুই ফসল
আমাদের খাঁচার ভিতরে একই অচিন পাখির আনাগোনা |
আমার দেবতার থানে তুমি বটের ঝুরিতে সুতো বাঁধো
আমি তোমার পীরের দরগায় চেরাগ জ্বালি |
আমার স্তোত্রপাঠ তোমাকে ডাকে
তোমার আজান আমাকে খুঁজে বেড়ায় |

আমাদের এক সুখ এক কান্না এত পিপাসা
ভূগোল ইতিহাসে আমরা এক
এক মন এক মানুষ এক মাটি এক মমতা
পরস্পর আমরা পর নই
আমরা পড়শী ---আর পড়শীই তো আরশি
তুমি সুলতানা আমি অপূর্ব
আমি মহবুব তুমি শ্যামলী |

আমাদের শত্রুও সেই এক
যারা আমাদের আস্ত মস্ত সোনার দেশকে খন্ড-খন্ড করেছে
যারা আমাদের রাখতে চায় বিচ্ছিন্ন করে বিরূপ করে বিমুখ করে |
কিন্তু নদীর দুর্বার জলকে কে বাঁধবে
কে রুখবে বাতাসের অবাধ স্রোত
কে মুছে দেবে আমাদের মুখের ভাষা আমাদের রক্তের কবিতা
আমাদের হৃদয়ের গভীর গুঞ্জন ?
তুমি আমার ভাষা বলো আমি আনন্দকে দেখি
আমি তোমাদের ভাষা বলি তুমি আশ্চর্যে দেখ
এই ভাষায় আমাদের আনন্দে -আশ্চর্যে সাক্ষাত্কার |
কার সাধ্য অমৃতদীপিত সূর্য-চন্দ্রকে কেড়ে নেবে আকাশ থেকে ?

আমাদের এক রবীন্দ্রনাথ এক নজরুল |
আমরা ভাষায় এক ভালোবাসায় এক মানবতায় এক
বিনা সুতোয় রাখীবন্ধনের কারিগর
আমরাই একে অন্যের হৃদয়ের অনুবাদ
মর্মের মধুকর, মঙ্গলের দূত
আমরাই চিরন্তন কুশলসাধক ||

স্বাধীনতা

অচিন্ত্যকুমার সেনগুপ্ত

চক্ষুকে বিশ্বাস করতে পারছি না :
আমার প্রকাশ্য গৃহচূড়ে উড়ছে আমার স্বদেশের পতাকা-----
তিমিরমুক্ত অম্বরের অভিমুখে
উথ্বিত হচ্ছে আমার নিরুদ্ধ আত্মার প্রথম উদার সম্ভাষণ
আমার জন্মের প্রথম জয়ঘোষণা |
এক প্রান্তে গম্ভীর গৈরিক
অনপনেয় দুঃখের ঔদাস্য আর অপরিমেয় ত্যাগের প্রসন্নতা ;
অন্য প্রান্তে উল্লাস-উজ্জ্বল সবুজের অপর্যাপ্তি
অমিত জীবনের সৃজনসৌন্দর্যের উদ্ভাবন ;
মধ্যস্থলে তুষারসঙ্কশা শুভ্রতা
কর্মের নির্মলতা ও অনবদ্য অন্তরমাধুর্যের প্রতীতি |
আর সেই শুভ্রতার অন্তরে ঘননীল অশোকচক্র,
সমস্ত অলাতচক্রের ঊর্ধ্বে
শান্তির স্থির বাণী
দিকে-দিকে দেশে-দেশে মৈত্রীর আমন্ত্রণ ;
শোকশূন্য সময়ের ঘূর্ণ্যমানতার প্রতীক
বর্তমান থেকে বৃহত্তর ভবিষ্যতের
মহত্তর সম্ভাবনায় নিয়ত-আবর্তিত
উড়ছে আমার ধ্রুব বিশ্বাসের ধ্বজপট
আমার বীজমন্ত্রের বৈজয়ন্তী |


কত দুর্গম পর্বত ও কত কন্টকক্লেশিত অরণ্য পার হয়ে
কত দুঃসহ দুর্যোগের মধ্য দিয়ে
অভ্রান্তলক্ষ্যে চলে এসেছ তোমরা,
দৃঢ় হাতে বহন করে এনেছ এই পতাকাকে |
কত রোষকষায়িত কশা, কত বলদর্পিত বুট
কত বর্বর বুলেট
ছিন্ন ভিন্ন করে দিয়েছে তোমাদের,
কিন্তু বজ্রমুষ্টি শিথিল করতে পারেনি,
স্খলিত করতে পারেনি তোমাদের পতাকার উদ্ধতি,
নমিত করতে পারেনি তোমাদের দুষ্পরাজেয় প্রতিজ্ঞা |
মায়ের বুকে সন্তানের মত
পক্ষিচঞ্চুপুটে তৃণখন্ডের মত
বারুদের বুকে বহ্নিকণার প্রত্যাশার মত
বহন করে এনেছে এই পতাকা
যাতে আমি প্রোথিত করতে পারি আমার প্রকাশ্য গৃহচূড়ে |
নবীনারম্ভের নিশ্বাসে বিস্তার করতে পারি বুক,
জজ্জ্বল উপলব্ধিতে উদ্ধত করতে পারি মেরুদন্ড |


লেখনীকে বিশ্বাস করতে পারছি না
যা আমি আজ লিখছি এই মুহূর্তে |
কত বাক্য রুদ্ধ হয়ে গেছে তোমাদের কন্ঠে
দলিত হয়েছে কত অরুন্তদ আর্তনাদ
স্তব্ধ হয়েছে কত বঞ্চিত বুকের দ্রোহবাণী |
সত্যভাষের সেই অধিকারকে তবু বিধ্বস্ত হতে দাওনি,
বহন করে এনেছ এই পতাকা
এই উদাত্ত বীরবার্তা ;
তন্দ্রিত আকাশে মুক্ত করে দিয়েছ
সিতপক্ষ কলহংসের কাকলি,
যাতে আমি পেতে পারি আমার ভাষা
লেখনীতে অপরাঙ্মুখ তীক্ষ্ণতা |

তাই আজ এই পতাকাকে যখন প্রণাম করি
প্রণাম করি তোমাদের দুর্জয় বীর্যবত্তাকে |
স্মরণ করি তোমাদের
যারা ফাঁসির রজ্জুকে মনে করেছে কন্ঠলগ্ন কোমল ফুলমালা
মৃত্যুতে দেখেছ অমরত্বের রাজধানী |
স্মরণ করি তোমাদের
নাগ-নক্ষত্র যাদের যাত্রা,
যারা কারাকক্ষে নিয়তিনির্দিষ্ট হয়ে
যাপন করেছে অবিচ্ছেদ্য অন্ধকার,
আকাঙ্ক্ষার অগ্নিতেজে তপ্ত রেখেছ বক্ষঃস্থল,
জতুগৃহদাহে দেখেছ ইন্দ্রপ্রস্থের নির্মিতি |
আর তোমাদের স্মরণ করি
সেই সব অগণন নানহীন পথিক পদাতিকের দল,
নির্বিশঙ্ক জীবনের আহ্বানে
পদে-পদে রক্তচিহ্নিত করেছ পথ-প্রান্তর-জনপদ,
ঘরে ঘরে জ্বেলেছ
জায়া-জননীর হাহাকারের দাবাগ্নি |
যাতে আমি জীবনে পেতে পারি মর্যাদা
অমূল্য মূল্যবোধ |
যাতে হাতে পেতে পারি তেজিষ্ঠ লেখনী
কন্ঠে পেতে পারি দুর্বার কলস্বন
আর প্রকাশ্য গৃহচূড়ে এই অপ্রকল্প পতাকা ||

প্রিয়া ও পৃথিবী

অচিন্ত্যকুমার সেনগুপ্ত

নিঃশঙ্ক, নিঃশব্দপদে একদিন এসেছিলে কাছে
ঈপ্সিত মৃত্যুর মতো, নয়নে যেটুকু বহ্নি আছে,
অধরে যেটুকু ক্ষুধা --- সব দিয়ে লইলাম মুছে
লোলুপ লাবণ্য তব; দিনান্তের দুঃখ গেলো ঘুচে,
উদিলো সন্ধ্যার তারা দিগ্বধূর ললাটের টিপ |
কদম্বপ্রসব-সম জ্ব’লে ওঠে কামনাপ্রদীপ,
যুগ্ম দেহে ; শ্মশানে অতসী হাসে, নিকষে কনক ;
মেঘলগ্ন ঘনবল্লী আকূল পলকে নিষ্পলক |
কঙ্করে অঙ্কুর জাগে, মরুভূতে ফুটিলা মালতী----
তুমি রতি মূর্তিমতী, আর আমি আনন্দ-আরতি |
দেহের ধূপতি হ’তে জ্ব’লে ওঠে বাসনার ধুনা
লেলিহরসনা, তবু কালো চোখে কোমল করুণা |
শুভ্র ভালে খেলা করে তৃতীয়ার ম্লান শিশু শশী,
তোমার বরাঙ্গ যেন সন্ধ্যাস্নিগ্ধ, শ্যামল তুলসী |
ভুজের ভুজঙ্গতলে হে নতাঙ্গী, নির্ভয় নির্ভরে
তোমার স্তনাগ্রচূড়া কাঁপিলো নিবিড় থরথরে |
স্ফুরত্প্রবাল ওষ্টে গূঢ়ফণা চুম্বন-উত্সুক,
এপারে রক্তাশোক, অন্য তটে হিংসুক কিংশুক |
শ্লথ হ’লো নীবিবন্ধ, চূর্ণালক, শিথিল কিঙ্কিণী,
কজ্জলে মলিন হ’লো পান্ডু গন্ড, কাটিলো যামিনী |
দূরে বুঝি দেখা দিলো দিগ্বালার রজত-বলয়,
বলিলাম কানে-কানে : ‘মরণের মধুর সময় |’
আজি তুমি পলাতকা, মুক্তপক্ষ পাখি উদাসীন,
ক্লান্ত, দূর নভোচারী দিগন্তের সীমান্তে বিলীন |
বিদ্যুৎ ফুরায়ে গেছে, কখন বিদায় নিলো মেঘ,
অবিচল শূন্যতার নভোব্যাপী নিস্তব্ধ উদ্বেগ
আবরিয়া রহিয়াছে হৃদয়ের অনন্ত পরিধি
চাহি না ঘৃণিত মৃত্য, তব গুপ্ত হীন প্রতিনিধি |
নীবিবন্ধ শিথিলিতে কটিতটে যদিও কিঙ্কিনী,
বাজে আজো, কজ্জলে মলিন গন্ড, তবু, কলঙ্কিনী,
চাহি না অতীত মৃত্যু | নভস্তলে অনিবন্ধনীবি
ঘুম পায় পার্শ্বে মোর বীরভোগ্যা প্রেয়সী পৃথিবী |
তারে চাই ; তাহারি সুধার তরে অসাধ্য সাধনাস,
বিস্মিত আকাস ঘিরি’ সুস্মিত, সনীল অভ্যর্থনা,
অজস্র প্রশ্রয় | মৃত্তিকার উদ্বেলিত পয়োধরে
সম্ভোগের সুরাস্রোত ওষ্ঠাধরে উচ্ছসিয়া পড়ে,
শস্য ফলে, নদী বহে, ঊর্ধ্বে জাগে উত্তুঙ্গ পর্বত,
হাস্য করে মৌনমুখে উলঙ্গ, উজ্জ্বল ভবিষ্যৎ |
আয়ুর সমুদ্র মোর দুই চক্ষে, মৃত্যু পদলীন,
তোমার বিস্মৃতি দিয়া পৃথিবীরে করেছি রঙিন |
নক্ষত্র-আলোক হ’তে সমুদ্রের তরঙ্গ অবধি
ব’হে চলে একখানি পরিপূর্ণ যৌবনের নদী |
তারি তলে করি স্নান, নাহি কূল, নাহি পরিমিতি,
তুমি নাই, আছে মুক্তি, পৃথ্বীব্যাপী প্রচুর বিস্মৃতি |

প্রথম যখন

অচিন্ত্যকুমার সেনগুপ্ত

প্রথম যখন দেখা হয়েছিল, কয়েছিলে মৃদুভাষে
‘কোথায় তোমারে দেখেছি বলো তো,---- কিছুতে মনে না আসে |
কালি পূর্ণিমা রাতে
ঘুমায়ে ছিলে কি আমার আতুর নয়নের বিছানাতে ?
মোর জীবনের হে রাজপুত্র, বুকের মধ্য়মণি,
প্রতি নিশ্বাসে শুনেছি তোমার স্তব্ধ পদধ্বনি !
তখনো হয়তো আঁধার কাটেনি,---সৃষ্টির শৈশব,-----
এলে তরুণীর বুকে হে প্রথম অরুনের অনুভব !’
আমি বলেছিনু, ‘জানি,
স্তবগুঞ্জন তুলি তোরে ঘিরে হে মোর মক্ষিরানী !’
যাপিলাম কত পরশ তপ্ত রজনী নিদ্রাহীন,
দু’চোখে দু’চোখ পাতিয়া শুধালে, ‘কোথা ছিলে এতদিন ?’
লঘু দুটি বাহু মেলে’
মোর বলিবার আগেই বলিলে ; ‘যেয়ো না আমাকে ফেলে |’

আজি ভাবি ব’সে বহুদিন পরে ফের যদি দেখা হয়,
তেমনি দু’চোখে বিশ্বাসাতীত জাগিবে কি বিস্ময় ?
কহিবে কি মৃদুহাসে,
‘কোথায় তোমারে দেখেছি বলো তো, কিছুতে মনে না আসে ||’

রোগ শয্যায়

অচিন্ত্যকুমার সেনগুপ্ত

মলিন দিনের মাধুরী হেরিয়া মধুর হয়েছে মন
রোগ শয্যায় একা শুয়ে আছি একান্ত অকারণ |
তবু সবি লাগে ভালো,
বিদায় বেলায় গোধূলির চোখে মৃদু মুমূর্ষ আলো |
পাশের ছাতের আলিসা হইতে কাপড়টি নিতে আসা,
পথে যেতে যেতে দু’টি বন্ধুর দরদী দরাজ হাসা
তৃণের ডগায় ছোট আলোটুকু, একটি তারকা ফোটে,
শুক্ নো পাতাটি নীড়ে ফিরে-যাওয়া ভীরু শালিকের ঠোঁটে !
শুয়ে রোগ শয্যায়
আকাশের চোখে ক্লান্ত কাকুতি মোর চোখে পৌঁচায় |
কোমল করিয়া ডাকেনিক’ কেহ, জ্বালেনিক’ দীপ-শিখা,
আজিকে আঁধারে তারাটীর সনে মোর মুখ-চন্দ্রিকা !
সন্ধ্যা কোমল কায়া
ছোট বোনটির মতো পাশে বসে’ নয়নে করুণ মায়া !
তুনি কি এখন চঞ্চলপদে গৃহ আচরণে রত,
তোমার চোখে কি সন্ধ্যা নেমেছে আমার স্নেহের মত ?
শুয়ে আছি চুপচাপ,
কান পেতে শুনি রাতের পাখায় বাজে আজি কি বিলাপ |

তোমারে ভুলিয়া গেছি

অচিন্ত্যকুমার সেনগুপ্ত

তোমারে ভুলিয়া গেছি,-----পরিপূর্ণ, পরিতৃপ্ত আজি মোর মন,
আমার মুহূর্তগুলি উড়ে চলে লঘুপক্ষ বকের মতন |
তোমারে ভুলিয়া গেছি নভচারী শ্রান্ত ডানা ধীরে বুজে আসে |
কূলের কুলায়ে হায়---কুয়াশার ঘুম ভাঙে চৈত্রের বাতাসে |
শ্মশান ঘুমায়ে আছে, আষাঢ়ের অশ্রু জলে নিভে গেছে চিতা,
শীতার্ত বিশীর্ণ নদী---নাহি আর আবেগের অমিতব্যয়িতা |
হাতে আজ কতো কাজ : ভুলে গেছি কখন ফুটেছে ছোট জুঁই,
ক্ষুদ্র গৃহনীড় ছেড়ে কখন বিদায় নিল চটুল চড়ুই |
তোমারে ভুলিয়া গেছি--- উদ্বেগ-উদ্বেল তনু লভেছে বিশ্রাম,
প্রতীক্ষার ক্লান্তি হতে লভিয়াছি শূন্যতার আরোগ্য আরাম |
রৌদ্রের দারিদ্র মাঝে ভুলে গেছি নক্ষত্রের মধুক্ষরা চিঠি,
গায়ে হলুদের দিনে, ভুলে গেছি, পরেছিলে হলুদ শাড়িটি |

দ্বার রুদ্ধ করি নাকো--- জানি আর বাজিবে না ভীরু করাঘাত,
রজনীর সুপ্তিশেষে জানি শুধু দেখা দিবে প্রসন্ন প্রভাত |
তোমারে ভুলিয়া গেছি --- জীবনেরে তাই যেন আরো বড়ো লাগে,
অনুর্বরা মৃত্তিকার রুক্ষদহ ভরে গেছে আতাম্র বিরাগে !
তোমায়ে মানায় কি-বা সিন্দুরেতে, কে বা জানে ! হাতে এত কাজ !
বেদনার অপব্যয়ে গড়িব না, ভয় নাই, বিরহের তাজ |
ছিলাম সঙ্কীর্ণ গৃহে, চলে গিয়ে, ফেলে গেলে এত বড়ো ফাঁকা,
আমার কানের কাছে মুহুর্মুহু বেজে চলে মুহূর্তের পাখা |
তোমারে ভুলিয়া গেছি,----কে জানিত এর মাঝে এতো তৃপ্তি আছে,
আমার বক্ষের মাঝে মহাকাশ বাসা বেঁধে যেন বাঁচিয়াছে |

কুটির

অচিন্ত্যকুমার সেনগুপ্ত

ঝিকিমিকি দেখা যায় সোনালি নদীর,
ওইখানে আমাদের পাতার কুটির।
এলোমেলো হাওয়া বয়,
সারা বেলা কথা কয়,
কাশফুলে দুলে ওঠে নদীর দু'পার,
রূপসীর শাড়ি যেন তৈরি রূপার।

কুটিরের কোল ঘেঁষে একটু উঠোন,
নেচে নেচে খেলা করি ছোট দুটি বোন।
পরনে খড়কে-ডুরে,
বেণী নাচে ঘুরে ঘুরে,
পায়ে পায়ে- 'রুনু ঝুনু' হালকা খাড়ুর,
কেন নাচি নাই তার খেয়াল কারুর।

আকাশে গড়িয়া ওঠে মেঘের মিনার,
তারি ফাঁকে দেখা যায় চাঁদের কিনার।
গাছের পাতার ফাঁকে,
আকাশ যে চেয়ে থাকে,
গুনগুন গান গাই, চোখে নাই ঘুম।
চাঁদ যেন আমাদের নিকট কুটুম।...

নৌকারা আসে যায় পাটেতে বোঝাই,
দেখে কী যে খুশি লাগে কী করে বোঝাই।
কত দূর দেশ থেকে,
আসিয়াছে এঁকে বেঁকে,
বাদলে 'বদর' বলে তুলিয়া বাদাম,
হাল দিয়ে ধরে রাখে মেঘের লাগাম।...

দু কদম হেঁটে এস মোদের কুটির,
পিলসুজে বাতি জ্বলে মিটির মিটির।
চাল আছে ঢেঁকি ছাঁটা,
রয়েছে পানের বাটা,
কলাপাতা ভরে দেব ঘরে-পাতা দই,
এই দেখ আছে মোর আয়না কাঁকই।

যদি আস একবার, বলি --মিছা না,
মোদের উঠোনটুকু ঠিক বিছানা।
পিয়াল, পেয়ারা গাছে--
ছায়া করে রহিয়াছে,
ধুঁধুলের ঝাঁকা বেয়ে উঠিতেছে পুঁই,
খড়কুটো খুঁজে ফেরে দুষ্টু চড়ুই।

এস এস আমাদের সোনার কুটির,--
ঝিকিমিকি করে জল নিটোল নদীর।
ঝিঙের শাখার পরে
ফিঙে বসে খেলা করে,
বেলা যে পড়িয়া এল, গায়ে লাগে হিম,
আকাশে সাঁঝের তারা, উঠানে পিদিম।