প্রতিনায়কের স্বগতোক্তি


বেলাল চৌধুরী

আমার গোপন পাপগুলি এতদিন পর
বিরূপ-বৈরিতায় শস্ত্রপাণি হয়ে উঠেছে
এবার তাদের বজ্রনির্ঘোষ কন্ঠে
উচ্চারিত হলো- আমার কঠোর দন্ডাজ্ঞা
আমার মাথার ওপর উত্তোলিত তীক্ষ্ন কৃপাণ
চোখের সামনে জ্বলন্ত লাল লৌহশলাকা
ওদের চূড়ান্ত সিদ্ধান্তে এবার ওরা অটল
আমার সর্বাঙ্গ ছেঁকে ধরেছে মাছির মতো
বিস্ফোটক দগদগে ঘা পুঁজ আর শটিত গরল
গোপন পাপের শরশয্যায় শুয়ে আমি
নিদারুণ তৃষ্ণায় ছটফট করছি- হায় রে জলধারা
কিন্তু এবার ওরা দৃঢ়প্রতিজ্ঞ- নিষ্কৃতি নেই আমার
নির্বাসনে মৃত্যুদন্ড- ঠান্ডা চোখে দেখছি আমি
নীল কুয়াশায় ঢাকা পড়ছে আমার দেহ ।

ফুলবাজার


শঙ্খ ঘোষ

পদ্ম, তোর মনে পড়ে খালযমুনার এপার ওপার
রহস্যনীল গাছের বিষাদ কোথায় নিয়ে গিয়েছিল?

স্পষ্ট নৌকো, ছৈ ছিল না, ভাঙা বৈঠা গ্রাম হারানো
বন্য মুঠোয় ডাগর সাহস, ফলপুলন্ত নির্জনতা

আড়ালবাঁকে কিশোরী চাল, ছিটকে সরে মুখের জ্যোতি
আমরা ভেবেছিলাম এরই নাম বুঝি বা জন্মজীবন |

কিন্তু এখন তোর মুখে কী মৃণালবিহীন কাগজ-আভা
সেদিন যখন হেসেছিলি সত্যি মুখে ঢেউ ছিল না!

আমিই আমার নিজের হাতে রঙিন ক’রে দিয়ে ছিলাম
ছলছলানো মুখোশমালা, সে কথা তুই ভালই জানিস—

তবু কি তোর ইচ্ছে করে আলগা খোলা শ্যামবাজারে
সবার হাতে ঘুরতে-ঘরতে বিন্দু বিন্দু জীবনযাপন?

বহিরাগত


শঙ্খ ঘোষ

আমার কথা কি বলতে চাও না? নিশ্চিত তুমি বহিরাগত |
উঁচু স্বর তুলে কথা বলে যারা জেনে নাও তারা বহিরাগত |
গাঁয়ে কোণে কোণে গাঁয়ের মানুষ খেতে বা খামারে বহিরাগত |
মরা মানুষের মুখাচ্ছাদন সরিয়ো না, ও তো বহিরাগত |
মাঠে মাঠে ধরে যেটুকু ফসল সেসবও এখন বহিরাগত |
চালার উপরে ঝুঁকে পড়ে চাঁদ বহুদূর থেকে বহিরাগত |
বর্ষাফলকে বিষ মেখে নিয়ে কালো মুখোশের আড়ালে যত
বহিরাগতরা এসে ঠিক ঠিকই বুঝে নেয় কারা বহিরাহত |

শূন্যের ভিতরে ঢেউ


শঙ্খ ঘোষ

বলিনি কখনো?
আমি তো ভেবেছি বলা হয়ে গেছে কবে।
এভাবে নিথর এসে দাঁড়ানো তোমার সামনে
সেই এক বলা
কেননা নীরব এই শরীরের চেয়ে আরো বড়ো
কোনো ভাষা নেই
কেননা শরীর তার দেহহীন উত্থানে জেগে
যতদূর মুছে নিতে জানে
দীর্ঘ চরাচর
তার চেয়ে আর কোনো দীর্ঘতর যবনিকা নেই।
কেননা পড়ন্ত ফুল, চিতার রুপালি ছাই, ধাবমান শেষ ট্রাম
সকলেই চেয়েছে আশ্রয়
সেকথা বলিনি? তবে কী ভাবে তাকাল এতদিন
জলের কিনারে নিচু জবা?
শুন্যতাই জানো শুধু? শুন্যের ভিতরে এত ঢেউ আছে
সেকথা জানো না?

সবিনয় নিবেদন


শঙ্খ ঘোষ

আমি তো আমার শপথ রেখেছি
অক্ষরে অক্ষরে
যারা প্রতিবাদী তাদের জীবন
দিয়েছি নরক করে |
দাপিয়ে বেড়াবে আমাদের দল
অন্যে কবে না কথা
বজ্র কঠিন রাজ্যশাসনে
সেটাই স্বাভাবিকতা |
গুলির জন্য সমস্ত রাত
সমস্ত দিন খোলা
বজ্র কঠিন রাজ্যে এটাই
শান্তি শৃঙ্খলা |
যে মরে মরুক, অথবা জীবন
কেটে যাক শোক করে—
আমি আজ জয়ী, সবার জীবন
দিয়েছি নরক করে |

পুনর্বাসন


শঙ্খ ঘোষ

যা কিছু আমার চার পাশে ছিল
ঘাসপাথর
সরীসৃপ
ভাঙা মন্দির
যা কিছু আমার চার পাশে ছিল
নির্বাসন
কথামালা
একলা সূর্যাস্ত
যা কিছু আমার চার পাশে ছিল
ধ্বংস
তীরবল্লম
ভিটেমাটি
সমস্ত একসঙ্গে কেঁপে ওঠে পশ্চিম মুখে
স্মৃতি যেন দীর্ঘযাত্রী দলদঙ্গল
ভাঙা বাক্স প’ড়ে থাকে আমগাছের ছায়ায়
এক পা ছেড়ে অন্য পায়ে হঠাত সব বাস্তুহীন |

যা কিছু আমার চার পাশে আছে—
শেয়ালদা
ভরদুপুর
উলকি-দেয়াল
যা কিছু আমার চার পাশে আছে—
কানাগলি
স্লোগান
মনুমেন্ট
যা কিছু আমার চার পাশে আছে—
শরশয্যা
ল্যাম্প পোস্ট
লাল গঙ্গা
সমস্ত এক সঙ্গে ঘিরে ধরে মজ্জার অন্ধকার
তার মধ্যে দাঁড়িয়ে বাজে জলতরঙ্গ
চূড়োয় শূণ্য তুলে ধরে হাওড়া ব্রিজ
পায়ের নিচে গড়িয়ে যায় আবহমান |

যা কিছু আমার চার পাশে ঝর্না
উড়ন্ত চুল
উদোম পথ
ঝোড়ো মশাল
যা কিছু আমার চার পাশে স্বচ্ছ
ভোরের শব্ দ
স্নাত শরীর
শ্মশান শিব
যা কিছু আমার চার পাশে মৃত্যু
একেক দিন
হাজার দিন
জন্ম দিন
সমস্ত একসঙ্গে ঘুরে আসে স্মৃতির হাতে
অল্প আলোয় বসে থাকা পথ ভিখারি
যা ছিল আর যা আছে দুই পাথর ঠুকে
জ্বালিয়ে নেয় এতদিনের পুনর্বাসন |

মুখ ঢেকে যায় বিজ্ঞাপনে


শঙ্খ ঘোষ

একলা হয়ে দাঁড়িয়ে আছি
তোমার জন্য গলির কোণে
ভাবি আমার মুখ দেখাব
মুখ ঢেকে যায় বিজ্ঞাপনে।

একটা দুটো সহজ কথা
বলব ভাবি চোখের আড়ে
জৌলুশে তা ঝলসে ওঠে
বিজ্ঞাপনে, রংবাহারে।

কে কাকে ঠিক কেমন দেখে
বুঝতে পারা শক্ত খুবই
হা রে আমার বাড়িয়ে বলা
হা রে আমার জন্মভূমি!

বিকিয়ে গেছে চোখের চাওয়া
তোমার সঙ্গে ওতপ্রোত
নিওন আলোয় পণ্য হলো
যা-কিছু আজ ব্যক্তিগত।

মুখের কথা একলা হয়ে
রইল পড়ে গলির কোণে
ক্লান্ত আমার মুখোশ শুধু
ঝুলতে থাকে বিজ্ঞাপনে।

প্রেম-প্রতিমা

কায়কোবাদ

( ১ )
আমি দেখিতাম শুধু তারে!
মধুর চাঁদনীময়ী                মধুরা যামিনী,
শশধর হাসিত অম্বরে!
সে থখন ধীরে ধীরে,                 এসে এই নদীতীরে,
গাইত প্রেমের গীত মাতায়ে ধরণী ;
তাহার মধুর স্বরে                 মুকুতা পড়িত ঝ'রে
নীরবে বহিয়া যেত আকুলা তটিনী!
আমি দেখিতাম শুধু তারে!

( ২ )
সে আমার সুখে দুঃখে প্রাণের সঙ্গিনী!
তারি তরে বেঁচে আছি ভবে!
জীবন-জলধি-পাড়ে,                 আর কি পাইব তারে
এক দুই করে আমি মাসদিন গণি!
সে চাঁদ ওঠে না আর,                 ঢালে না সে সুধা ধার,
আমি তার সে আমার --- শুধু এই জানি!
সে আসিবে কবে!

( ৩ )
তাহারি চরণ চুমি বনকমলিনী
ফুটিয়া উঠিত থরে থরে!
সে নিতি উন্মুক্ত কেশে,                 ফুলরাণী-বেশে এসে
দাঁড়াইয়া এই সরঃতীরে
গাইত প্রেমের গান,                 আকুল করিয়া প্রাণ
বিহগ শিখিত সেই প্রেমের রাগিনী!
আমি দেখিতাম শুধু তারে!

( ৪ )
সে সদা কুসুম-সাজে এলাইয়া বেণী
আমার এ প্রাণ নিত কেড়ে!
চারিধারে পুষ্প-তরু,                 বায়ু ব'ত ঝুরু ঝুরু
কোকিল তুলিত কত কুহু কুহু ধ্বনি!
হেরি তার রূপরাশি,                 হেরি তার প্রেমহাসি,
পাপিয়া আকুল প্রাণে হ'ত পাগলিনী!
আমি দেখিতাম শুধু তারে!

( ৫ )
তাহারি রূপের ছটা উজলি ধরণী
ঝরিয়া পড়িত চারি ধারে!
আকাশে চন্দ্রমা-তারা,                 তারি প্রেমে মাতোয়ারা
নয়নে খেলিত তার চঞ্চলা দামিনী!
বুকেতে অমৃত-খনি                 কণ্ঠে সুধা-নির্ঝরণী
সৌন্দর্য-সরসে সে যে ফুটন্ত নলিনী!
আমি দেখিতাম শুধু তারে!


কে তুমি

কায়কোবাদ

( ১ )
কে তুমি? --- কে তুমি?
ওগো প্রাণময়ী,
কে তুমি রমণী-মণি!
তুমি কি আমার, হৃদি-পুষ্প-হার
প্রেমের অমিয় খনি!
কে তুমি রমণী-মণি?

( ২ )
কে তুমি?---
তুমি কি চম্পক-কলি?
গোলাপ মতি
তুমি কি মল্লিকা যুথী ফুল্ল কুমুদিনী?
সৌন্দর্যের সুধাসিন্ধু,
শরতের পূর্ণ ইন্দু
আঁধার জীবন মাঝে পূর্ণিমা রজনী!
কে তুমি রমণী-মণি?

( ৩ )
কে তুমি? ---
তুমি কি সন্ধ্যার তারা, সুধাংশু সুধা-ধারা
পারিজাত পুষ্পকলি
বিশ্ব বিমোহিনী
অথবা শিশির স্নাতা, অর্ধস্ফুট, অনাঘ্রাতা
প্রণয়-পীযূষ ভরা,সোনার নলিনী!
কে তুমি রমণী-মণি?

( ৪ )
কে তুমি?---
তুমি কি বসন্ত-বালা, অথবা প্রেমের ডালা,
প্রাণের নিভৃত কুঞ্জে
সুধা-নির্ঝরিনী!
অথবা প্রেমাশ্রু-ধারা, শোকে দুঃখে আত্মহারা
প্রেমের অতীত স্মৃতি,
বিধবা রমণী!
কে তুমি রমণী-মণি?

( ৫ )
কে তুমি?---
তুমি কি আমার সেই
হৃদয়-মোহিনী?
সেই যদি,---কেন দূরে? এস, এই হৃদি-পুরে
এস' প্রিয়ে প্রাণময়ী,
এস' সুহাসিনী!
এস' যাই সেই দেশে,---ফুল ফুটে চাঁদ হাসে
দয়েলা কোয়েলা গায়
প্রাণের রাগিণী!
জরা নাই---মৃত্যু নাই, প্রণয়ে কলঙ্ক নাই
চল যাই সেই দেশে
এস' সোহাগিনী!
কে তুমি রমণী-মণি?

সায়াহ্নে

কায়কোবাদ

হে পান্থ, কোথায় যাও কোন্ দূরদেশে
কার আশে? সে কি তোমা করিছে আহ্বান?
সম্মুখে তামসী নিশা রাক্ষসীর বেশে
শোন না কি চারিদিকে মরণের তান!
সে তোমারে ওহে পান্থ, হাসিমুখে এসে,
সে তোমারে ছলে বলে গ্রাসিবে এখনি |
যেয়োনা একাকী পান্থ, সে দূর বিদেশে,
ফিরে এসো, ওহে পান্থ, ফিরে এসো তুমি |
এ ক্ষুদ্র জীবন লয়ে কেন এত আশা?
জান না কি এ জগত্ নিশার স্বপন?
মায়া মরীচিকী প্রায় স্নেহ ভালবাসা---
জীবনের পাছে ওই রয়েছে মরণ
হে পান্থ হেথায় শুরু আঁধারের স্তর ;
মৃত্যুর উপর মৃত্যু, মৃত্যু তার পর!

বিদায়ের শেষ চুম্বন

কায়কোবাদ

( ১ )
আবার, আবার সেই বিদায়-চুম্বন,
আলেয়ার আলো প্রায়,
আঁধারে ডুবায়ে যায়,
স্মৃতিটি রাখিয়া হায় করিতে দাহন!

( ২ )
বিদায়-চুম্বন,
উভয়েরি প্রাণে করে অগ্নি বরিষণ,
উভয়ে উভয় তরে,
আকুলি ব্যাকুলি করে,
উভয়েরি হৃদিস্তরে যাতনা-ভীষণ!
এমনি কঠোর হায় বিদায়-চুম্বন!

( ৩ )
প্রণয়ের মধুমাখা প্রথম চুম্বনে,
শুধু সুখ সমুল্লাস ;
এতে ঘন হাহুতাশ,
কেবলি যে বহে হায় উভয়েরি মনে!

( ৪ )
সে চুম্বনে এ চুম্বনে কি দিব তুলনা,
সে স্বর্গের পরিমল,
এ মর্তের হলাহল,
তাহাতে উল্লাস, এতে কেবলি যাতনা!

( ৫ )
সে যে শরতের স্নিগ্ধ সুধাংশু-কিরণ,
মুহুর্তে মাতায় ধরা,
এ যে শুধু ক্লেশ ভরা
বৈশাখের ঘন ঘোর ঝটিকা ভীষণ!

প্রণয়ের প্রথম চুম্বন

কায়কোবাদ

( ১ )
মনে কি পড়ে গো সেই প্রথম চুম্বন!
যবে তুমি মুক্ত কেশে,
ফুলরাণী বেশে এসে,
করেছিলে মোরে প্রিয় স্নেহ-আলিঙ্গন!
মনে কি পড়ে গো সেই প্রথম চুম্বন?

( ২ )
প্রথম চুম্বন!
মানব জীবনে আহা শান্তি-প্রস্রবণ!
কত প্রেম কত আশা,
কত স্নেহ ভালবাসা,
বিরাজে তাহায়, সে যে অপার্থিব ধন!
মনে কি পড়ে গো সেই প্রথম চুম্বন!

( ৩ )
হায় সে চুম্বনে
কত সুখ দুঃখে কত অশ্রু বরিষণ!
কত হাসি, কত ব্যথা,
আকুলতা, ব্যাকুলতা,
প্রাণে প্রাণে কত কথা, কত সম্ভাষণ!
মনে কি পড়ে গো সেই প্রথম চুম্বন!

( ৪ )
সে চুম্বন, আলিঙ্গন, প্রেম-সম্ভাষণ,
অতৃপ্ত হৃদয় মূলে
ভীষণ ঝটিকা তুলে,
উন্মত্ততা, মাদকতা ভরা অনুক্ষণ,
মনে কি পড়ে গো সেই প্রথম চুম্বন!

তোমাকে অভিবাদন, বাংলাদেশ

সৈয়দ শামসুল হক

তোমাকে অভিবাদন, বাংলাদেশ,
              তুমি ফিরে এসেছ তোমার মানচিত্রের ভেতরে
              যার ওপর দিয়ে বয়ে যাচ্ছে তেরো শো নদীর ধারা ;
তোমাকে অভিবাদন, বাংলাদেশ,
              তুমি ফিরে এসেছ তোমার করতলে পাঙরাটির বুকে
              যার ডানা এখন রক্ত আর অশ্রুতে ভেজা ;
তোমাকে অভিবাদন, বাংলাদেশ,
              তুমি ফিরে এসেছ তোমার বৃষ্টিভেজা খড়ের কুটিরে
              যার ছায়ায় কত দীর্ঘ অপেক্ষায় আছে সন্তান এবং স্বপ্ন ;
তোমাকে অভিবাদন, বাংলাদেশ,
              তুমি ফিরে এসেছ তোমার তোমার নৌকার গলুইয়ে
              যার গ্রীবা এখন ভবিষ্যতের দিকে কেটে চলেছে স্রোত ;
তোমাকে অভিবাদন, বাংলাদেশ,
              তুমি ফিরে এসেছ তোমার মাছধরা জালের ভেতরে
              যেখানে লেজে মারছে বাড়ি একটা রুপালী চিতল ;
তোমাকে অভিবাদন, বাংলাদেশ,
              তুমি ফিরে এসেছ তোমার হালের লাঙলের ভতরে
              যার ফাল এখন চিরে চলেছে পৌষের নবান্নের দিকে ;
তোমাকে অভিবাদন, বাংলাদেশ,
              তুমি ফিরে এসেছ তোমার নেহাই ও হাতুড়ির সংঘর্ষের ভতরে
              যার একেকটি স্ফুলিঙ্গে এখন আগুন ধরছে অন্ধকারে ;
তোমাকে অভিবাদন, বাংলাদেশ,
              তুমি ফিরে এসেছ তোমার কবিতার উচ্চারণে
              যার প্রতিটি শব্দ এখন হয়ে উঠছে বল্লমের রুপালী ফলা ;
তোমাকে অভিবাদন, বাংলাদেশ,
              তুমি ফিরে এসেছ তোমার দোতারার টান টান তারের ভেতরে
              যার প্রতিটি টঙ্কার এখন ইতিহাসকে ধ্বনি করছে ;
তোমাকে অভিবাদন, বাংলাদেশ,
              তুমি ফিরে এসেছ তোমার লাল সূর্য্ আঁকা পতাকার ভেতরে
              যার আলোয় এখন রঞ্জিত হয়ে উঠছে সাহসী বদ্বীপ ;
তোমাকে অভিবাদন, বাংলাদেশ,
              তুমি ফিরে এসেছ তোমার অনাহারী শিশুটির কাছে
              যার মুঠোর ভেতরে এখন একটি ধানের বীজ ;
তোমাকে অভিবাদন, বাংলাদেশ,
              তুমি ফিরে এসেছ তোমার প্লাবনের পর কোমল পলিমাটিতে
              যেখানে এখন অনবরত পড়ছে কোটি কোটি পায়ের ছাপ ।

বোঝাপড়া

রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর

      মনেরে আজ কহ যে ,
ভালো মন্দ যাহাই আসুক
      সত্যেরে লও সহজে ।
কেউ বা তোমায় ভালোবাসে
      কেউ বা বাসতে পারে না যে ,
কেউ বিকিয়ে আছে , কেউ বা
      সিকি পয়সা ধারে না যে ,
কতকটা যে স্বভাব তাদের
      কতকটা বা তোমারো ভাই ,
কতকটা এ ভবের গতিক—
      সবার তরে নহে সবাই ।
তোমায় কতক ফাঁকি দেবে
      তুমিও কতক দেবে ফাঁকি ,
তোমার ভোগে কতক পড়বে
      পরের ভোগে থাকবে বাকি ,
মান্ধাতারই আমল থেকে
      চলে আসছে এমনি রকম—
তোমারি কি এমন ভাগ্য
      বাঁচিয়ে যাবে সকল জখম !
            মনেরে আজ কহ যে ,
      ভালো মন্দ যাহাই আসুক
            সত্যেরে লও সহজে ।

অনেক ঝঞ্ঝা কাটিয়ে বুঝি
      এলে সুখের বন্দরেতে ,
জলের তলে পাহাড় ছিল
      লাগল বুকের অন্দরেতে ,
মুহূর্তেকে পাঁজরগুলো
      উঠল কেঁপে আর্তরবে—
তাই নিয়ে কি সবার সঙ্গে
      ঝগড়া করে মরতে হবে ?
ভেসে থাকতে পার যদি
      সেইটে সবার চেয়ে শ্রেয় ,
না পার তো বিনা বাক্যে
      টুপ করিয়া ডুবে যেয়ো ।
এটা কিছু অপূর্ব নয় ,
      ঘটনা সামান্য খুবই—
শঙ্কা যেথায় করে না কেউ
      সেইখানে হয় জাহাজ - ডুবি ।
            মনেরে তাই কহ যে ,
      ভালো মন্দ যাহাই আসুক
            সত্যেরে লও সহজে ।

তোমার মাপে হয় নি সবাই
      তুমিও হও নি সবার মাপে ,
তুমি মর কারো ঠেলায়
      কেউ বা মরে তোমার চাপে—
তবু ভেবে দেখতে গেলে
      এমনি কিসের টানাটানি ?
তেমন করে হাত বাড়ালে
      সুখ পাওয়া যায় অনেকখানি ।
আকাশ তবু সুনীল থাকে ,
      মধুর ঠেকে ভোরের আলো ,
মরণ এলে হঠাৎ দেখি
      মরার চেয়ে বাঁচাই ভালো ।
যাহার লাগি চক্ষু বুজে
      বহিয়ে দিলাম অশ্রুসাগর
তাহারে বাদ দিয়েও দেখি
      বিশ্বভুবন মস্ত ডাগর ।
            মনেরে তাই কহ যে ,
      ভালো মন্দ যাহাই আসুক
            সত্যেরে লও সহজে ।

নিজের ছায়া মস্ত করে
      অস্তাচলে বসে বসে
আঁধার করে তোল যদি
      জীবনখানা নিজের দোষে ,
বিধির সঙ্গে বিবাদ করে
      নিজের পায়েই কুড়ুল মার ,
দোহাই তবে এ কার্যটা
      যত শীঘ্র পার সারো ।
খুব খানিকটে কেঁদে কেটে
      অশ্রু ঢেলে ঘড়া ঘড়া
মনের সঙ্গে এক রকমে
      করে নে ভাই , বোঝাপড়া ।
তাহার পরে আঁধার ঘরে
      প্রদীপখানি জ্বালিয়ে তোলো—
ভুলে যা ভাই , কাহার সঙ্গে
      কতটুকুন তফাত হল ।
            মনেরে তাই কহ যে ,
      ভালো মন্দ যাহাই আসুক
            সত্যেরে লও সহজে ।

সাত সাগরের মাঝি

ফররুখ আহমদ

কত যে আঁধার পর্দা পারায়ে ভোর হল জানি না তা ।
নারঙ্গি বনে কাঁপছে সবুজ পাতা ।
দুয়ারে তোমার সাত সাগরের জোয়ার এনেছে ফেনা।
তবু জাগলে না ? তবু, তুমি জাগলে না ?

মানা

সিকান্দার আবু জাফর

কালের কলস

আল মাহমুদ

অনিচ্ছায় কতকাল মেলে রাখি দৃশ্যপায়ী তৃষ্ণার লোচন
ক্লান্ত হয়ে আসে সব, নিসর্গও ঝরে যায় বহুদূর অতল আঁধারে
আর কী থাকলো তবে হে নীলিমা, হে অবগুণ্ঠন
আমার কাফন আমি চাদরের মতো পরে কতদিন আন্দোলিত হবো
কতকাল কতযুগ ধরে
দেখবো, দেখার ভারে বৃষের স্কন্ধের মতো নুয়ে আসে রাত্রির আকাশ?
কে ধারালো বর্শা হেনে অসংখ্য ক্ষতের সৃষ্টি করে সেই কৃষ্ণকায়
ষাঁড়ের শরীরে
আর সে আঘাত থেকে কী-যে ঝরে পড়ে ঠিক এখনো বুঝি না
একি রক্ত, মেদ, অগ্নি কিম্বা শ্বেত আলো ঝরে যায়
অবিরাম অহোরাত্র প্রাণ আর কিমাকার ভূগোলে কেবলই–
ঝরে যায় ঝরে যেতে থাকে।

ক্রমে তাও শেষ হলে সে বন্য বৃষভ যেন গলে যায় নিসর্গশোভায়।
তুমি কি সোনার কুম্ভ ঠেলে দিয়ে দৃশ্যের আড়ালে দাঁড়াও
হে নীলিমা, হে অবগুণ্ঠন?
আকাশে উবুড় হয়ে ভেসে যেতে থাকে এক আলোর কলস
অথচ দেখে না কেউ, ভাবে না কনককুম্ভ পান করে কালের জঠর;
ভাবে না, কারণ তারা প্রতিটি প্রভাতে দেখে ভেসে ওঠে আরেক আধার
ছলকায়, ভেসে যায়, অবিশ্রাম ভেসে যেতে থাকে।

কেমন নিবদ্ধ হয়ে থাকে তারা মৃত্তিকা, সন্তান আর শস্যের ওপরে
পুরুষের কটিবন্ধ ধরে থাকে কত কোটি ভয়ার্ত যুবতী
ঢাউস উদরে তারা কেবলই কি পেতে চায় অনির্বাণ জন্মের আঘাত।
মাংসের খোড়ল থেকে একে একে উড়ে আসে আত্মার চড়ুই
সমস্ত ভূগোল দ্যাখো কী বিপন্ন শব্দে ভরে যায়
ভরে যায়, পূর্ণ হতে থাকে।

এ বিষণ্ণ বর্ণনায় আমি কি অন্তত একটি পংক্তিও হবো না
হে নীলিমা, হে অবগুণ্ঠন?
লোকালয় থেকে দূরে, ধোঁয়া অগ্নি মশলার গন্ধ থেকে দূরে
এই দলকলসের ঝোপে আমার কাফন পরে আমি কতকাল
কাত হয়ে শুয়ে থেকে দেখে যাবো সোনার কলস আর বৃষের বিবাদ?

ত্যাগে দুঃখে

আল মাহমুদ

আজকাল চোখে আর অন্য কোনো স্বপ্নই জাগে না।
কবিতার কথা বুঝি, কবিতার জন্য বহুদূর একাকী গিয়েছি
পদচারণার স্মৃতি সারাদিন দুঃখবোধ ঐকান্তিক সখ্যতা ভেঙেছে
ত্যাগে দুঃখে ভরে আছে সামান্য পড়ার ঘর
সন্তানসহ দুঃখী সঙ্গিনীর মুখ।

অবোধ বাল্যেও নাকি একটা ছোট কাপও ভাঙিনি–
আমার আম্মা প্রায়ই আমার বোনের কাছে শৈশব শোনান।
সুন্দর ফ্লাওয়ার ভাসে জ্যান্ত পাখির ডানা কবিতার ছন্দ ইত্যাদি
কেন জানি বহু চেষ্টা সত্বেও আমি
কিছুতেই ভাঙতে পারি না।

ক্রিশেনথিমাম নাকি ইতস্তত ছড়িয়ে লাগালে
অবশেষে উদ্যান বড় সুন্দর দেখায়। কই, আমি তো এখনও
আমার উদ্ভিদগুলো সাজিয়ে লাগাই।

পলাতকা

কাজী নজরুল ইসলাম

কোন্‌ সুদূরের চেনা বাঁশীর ডাক শুনেছিস্‌ ওরে চখা?
ওরে আমার পলাতকা!
তোর প'ড়লো মনে কোন্‌ হারা-ঘর,
স্বপন-পারের কোন্‌ অলকা?
ওরে আমার পলাতকা!
তোর জল ভ'রেছে চপল চোখে,
বল্‌ কোন্‌ হারা-মা ডাকলো তোকে রে?
ঐ গগন-সীমায় সাঁঝের ছায়ায়
হাতছানি দেয় নিবিড় মায়ায়-
উতল পাগল! চিনিস্‌ কি তুই চিনিস্‌ ওকে রে?
যেন বুক-ভরা ও গভীর স্নেহে ডাক দিয়ে যায়, "আয়,
ওরে আয় আয় আয়,
কেবল আয় যে আমার দুষ্টু খোকা!
ওরে আমার পলাতকা!"
দখিন্‌ হাওয়ায় বনের কাঁপনে-
দুলাল আমার! হাত-ইশারায় মা কি রে তোর
ডাক দিয়েছে আজ?
এতকদিনে চিন্‌লি কি রে পর ও আপনে!
নিশিভোরেই তাই কি আমার নামলো ঘরে সাঁঝ!
ধানের শীষে, শ্যামার শিসে-
যাদুমণি! বল্‌ সে কিসে রে,
তুই শিউরে চেয়ে ছিঁড়লি বাঁধন!
চোখ-ভরা তোর উছলে কাঁদন রে!
তোরে কে পিয়ালো সবুজ স্নেহের কাঁচা বিষে রে!
যেন আচম্‌কা কোন্‌ শশক-শিশু চ'ম্‌কে ডাকে হায়,
"ওরে আয় আয় আয়
আয় রে খোকন আয়,
বনে আয় ফিরে আয় বনের চখা!
ওরে চপল পলাতকা"||

আমি যদি বাবা হতাম, বাবা হত খোকা

কাজী নজরুল ইসলাম

আমি যদি বাবা হতুম, বাবা হত খোকা,
না হলে তার নামতা,
মারতাম মাথায় টোকা ||
রোজ যদি হত রবিবার !
কি মজাটাই হত যে আমার !
কেবল ছুটি ! থাকত নাক নামতা লেখা জোকা !
থাকত না কো যুক্ত অক্ষর, অংকে ধরত পোকা ||

ঝরোকা

ফররুখ আহমদ

সকল রুদ্ধ ঝরোকা খুলে দাও
খুলে দাও সকল রুদ্ধ দরোজা।
আসুক সাত আকাশের মুক্ত আলো
আর উচ্ছল আনন্দের মত
বাগে এরেমের এক ঝাঁক মৌমাছি .. ..
যেন এই সব পাথরের ফুলের মাঝখান থেকে
আমি চিনে নিতে পারি
রক্তমনির চেয়েও লাল সুনভিত
একটি তাজা রক্ত গোলাপ;

আমার ব্যথিত আত্মা আর্তনাদ করে উঠলো
দাউদের পুত্র সোলায়মানের মতো
কেননা দ্বিধা-দ্বন্দ্বের আকাশ আছে পৃথিবীতে
চিরন্তন শুধু সত্যের অন্বেষা।

একদিন এই দেহ ঘাস

জীবনানন্দ দাশ

একদিন এই দেহ ঘাস থেকে ধানের আঘ্রাণ থেকে এই বাংলায়
জেগেছিল; বাঙালী নারীর মুখ দেখে রূপ চিনেছিলো দেহ একদিন;
বাংলার পথে পথে হেঁটেছিলো গাংচিল শালিখের মতন স্বাধীন;
বাংলার জল দিয়ে ধূয়েছিল ঘাসের মতন স্ফুট দেহখানি তার;
একদিন দেখেছিল ধূসর বকের সাথে ঘরে চলে আসে অন্ধকার
বাংলার; কাঁচা কাঠ জ্বলে ওঠে - নীল ধোঁয়া নরম মলিন
বাতাসে ভাসিয়া যায় কুয়াশার করুণ নদীর মতো ক্ষীণ;
ফেনসা ভাতের গন্ধে আম - মুকুলের গন্ধ মিশে যায় যেন বার - বার;

এই সব দেখেছিল রূপ যেই স্বপ্ন আনে - স্বপ্নে যেই রক্তাক্ততা আছে,
শিখেছিল, সেই সব একদিন বাংলার চন্দ্রমালা রূপসীর কাছে;
তারপর বেত বনে, জোনাকি ঝিঝির পথে হিজল আমের অন্ধকারে
ঘুরেছে সে সৌন্দর্যের নীল স্বপ্ন বুকে করে, - রূঢ় কোলাহলে গিয়ে তারে –
ঘুমন - কন্যারে সেই - জাগাতে যায়নি আর - হয়তো সে কন্যার হৃদয়
শঙ্খের মতন রুক্ষ, অথবা পদ্মের মতো - ঘুম তবু ভাঙিবার নয়।

আমার সন্তান

আহসান হাবীব

তাকে কেন দুদিনেই এমন অচেনা মনে হয় !

সন্ধ্যায় পড়ার ঘরে একা বসতে ভয় পেত। নিজেই নিজের
ছায়া দেখে কেঁপে উঠত। কনিষ্ঠকে সঙ্গী পেলে তবেই নির্ভয়ে
বসত সে পড়ার ঘরে।

আমার সন্তান
যে আমার হাতের মুঠোয়
হাত রেখে তবে
নিশ্চিন্তে এ-পাড়া
ও-পাড়া ঘুরেছে, গেছে মেলায়
এবং নানা প্রশ্নে
ব্যতিব্যস্ত করেছে আমাকে
আজ
তাকে কেন দুদিনেই এমন অচেনা মনে হয় !

কোথায় বেরিয়ে যায় একা একা ব্যস্ত পায়ে
একা একা
ক্লান্ত হয়ে ফেরে, তার
কোথায় কী কাজ, তার কেন ক্লান্তি?

যখন বাড়িতে
কেন সে দুধের সর না পেলেও এখন একবার
ক্ষুব্ধ দৃষ্টি মেলে দিয়ে তাকায় না মার চোখে চোখে?
যা পায় তা খায় কেন মুখ বুজে
কেন সে হঠাৎ
এমন উত্কর্ণ হয়ে বাইরে চোখ ফেরায়। খোকন
কিছু যেন শুনতে চায়। ঘরে নয় বাইরে কিছু শুনবে বলে
কান পাতে। কখনো না খেয়ে
হঠাৎ বেরিয়ে যায়
কোথায়, কোথায়?

কী ভাবনায় আমার খোকন
দুদিনেই এমন গম্ভীর হয়ে গেল
এমন বিষন্ন কেন
দীর্ণবুক দুঃখী মানুষের মতো হাঁটে কেন
এমন বয়স্ক কেন মনে হয় আমার খোকাকে।

কেন সে আমাকে
কিছুই বলে না আর
আমাকে আমার
পূর্বপুরুষের ছেঁড়া মাদুরে বসিয়ে রেখে অসহায়
হেঁটে যায় একাকী এমন রাজদর্পে
এবং তখন তার রাজবেশে আহা
সারা পথ এমন উজ্জ্বল হয়ে
জ্বলে ওঠে কেন।
আর তার কিশোর দেহের কী আশ্চর্য মহিমা। দু চোখে
প্রজ্ঞার আগুন যেন
কণ্ঠস্বর যেন
স্বর্গীয় সংকেতে ঋদ্ধ শব্দাবলি ছড়ায় দুপাশে।
দেখে দেখে মনে হয় কোনো নব পয়গম্বর যেন।

আমার সন্তান যায়
হেঁটে যায়
সামনে যায়
দেহ তার দীর্ঘতর হয়। আরো দীর্ঘ
সন্তানের দেহ
পিতার গর্বিত বুক উঁচু কাঁধ প্রশস্ত ললাট
ছাড়িয়ে সে আরো দীর্ঘ দীর্ঘতর হয়ে
আমার হাতের
নিশ্চিত আশ্রয় ছেড়ে ছুটে যায়।

আসন্ন সন্ধ্যায়
অন্ধকারে ভয় পেয়ে বুকফাটা চিত্কারে পখন
জানতে চাই, এই অন্ধকারে কোথায় সে যেতে চায়, বলে
সামনে যাব।
সামনে কী ভয়াল অন্ধকার। বলে
অন্ধকার পেরোলেই আলো। বলি তাকে
ওপথে অনেক
হিংস্র জন্তুর তীক্ষ্ণ নখর তোমাকে চায়
উত্তরে খোকন
নিচু হাত ঊর্ধ্বে তুলে ঘোরায় তলোয়ার।

ওপথে নিশ্চিত মৃত্যু বলে আমি যখন আবার
অসহায় শিশুর মতোই কাঁদতে থাকি
তখন বয়স্ক কোনো পিতার কণ্ঠস্বরে খোকা বলে
‘মৃত্যুই জীবন’| এবং সে আরো বলে
তুমি আর হাতের আড়ালে রেখো না আমার হাত
ভয়ের কাফনে জড়িয়ে রেখো না আর
অন্ধকার ছড়িয়ে রেখো না
আমার দু চোখে পিতা
তোমার চারপাশে বড় অন্ধকার তাই
সামনে যাব
আরো সামনে
সূর্যোদয়ে যাব।

ইতিহাস আয়োজিত সাজানো মেলায়
আলোয় দাঁড়াবো বলে
যখন খোকন যায় আরো দূরে
যতদূরে আমার দুর্বল দৃষ্টি চলে না, তখন
কেঁদে বলি, তুই চলে গেলে
অন্ধকার অপমান নিঃসঙ্গতা এইসব রেখে
তুই চলে গেলে খোকা
আমার কী থাকে বল
যখন কান্নায় ভেঙ্গে পড়ি
হঠাৎ তখন
সন্তানের সেই দৃষ্টি ফেরায় আমার চোখে, বলে
'পিতার গৌরব !'

বিংশ শতাব্দী

নাজিম হিকমত

' চলো ঘুমোতে যাই, প্রিয় আমার,
ওঠা যাবে আবার একশো বছর পরে।…'

না,
আমি বেইমান নই,
এ শতাব্দী আমার বিভীষিকা নয়।
ছন্নছাড়া আমার শতাব্দী
লজ্জায় আরক্তিম
দৃপ্ত আমার এই শতাব্দী
মহামহিমান্বিত
রথী।

বড় বেশি আগে জন্মেছি ব’লে কখনও বিলাপ করিনি,
আমি বিংশ শতাব্দীর মানুষ।
আমার গর্ব
আমি আছি।
আমার দেশের মানুষের মাঝখানে
নতুন পৃথিবীর মুখ চেয়ে আমি লড়ছি
আবার কী চাই…’

‘একশো বছর পরে, প্রিয় আমার…
‘না, বেশি দেরি নেই
সব কিছু সত্ত্বেও
আমার শতাব্দী প্রতি মুহূর্তে মরে গিয়ে
আবার নতুন জন্ম নিচ্ছে
আমার শতাব্দীর শেষের দিনগুলো বড় সুন্দর হবে
সূর্যলোকে ঠিকরে পড়বে আমার শতাব্দী, আমার প্রিয়,
ঠিক তোমার চোখের মত।’

পল রবসন

নাজিম হিকমত

ওরা ভয় পেয়েছে রবসন
ভয় রাত্রি প্রভাত হবার
ভয় রূপের, ভয় শব্দের, ভয় স্পর্শের।

ওরা আমাদের গান গাইতে দেয়না পল রবসন
তীব্র নিখাদে গাওয়া নিগ্রো ভাই আমার
আমরা আমাদের গান গাই ওরা চায়না
ভালবাসায় ওদের আতঙ্ক
বীজ আর মাটিতে আতঙ্ক
আতঙ্ক স্রোতের জলে।

আর কোন বন্ধুর হাতের স্মৃতি
যা চায়না কোন সুদ, কোন দস্তুরে।
যে হাত তাদের মনিবন্ধে দু’দন্ড
পাখির মত কোনদিন বসেনি।
আমাদের গান ওদের আতঙ্ক।।

বিষন্নতার স্বাধীনতা

নাজিম হিকমত

তুমি তোমার চোখ দুটোকে নষ্ট করেছো
নষ্ট করেছো তোমার লাবণ্যময় হাত দুটো
হাজার রুটির জন্যে ময়দার ময়ান করেছো
যার একটুকরো তোমার মুখে জোটেনি
তুমি স্বাধীন অন্যের দাসত্ব করার জন্যে
তুমি স্বাধীন অন্যকে ধনী থেকে ধনীতর করার জন্যে
যে মুহূর্তে তুমি জন্ম নিয়েছো
তারা তোমার চারপাশে রোপণ করেছে
জীবনভর মিথ্যার জাল
যে মিথ্যা উৎপাদিত হয় মিলগুলোতে
তুমি জীবনভর স্বাধীনতার বাসনা করে চলেছো
মন্দিরে প্রার্থনা করেছো
স্বাধীনভাবে ভাবতে চেয়েছো
তুমি ঘাড় নুয়ে থেকেছো
হাতদুটো ঝুলিয়ে
অলসভঙ্গিতে ঘুরেছো মুক্তির আশায়
তুমি মুক্ত
মুক্ত তুমি বেকারত্বের জালে
তুমি তোমার দেশকে ভালোবেসেছো
পৃথিবীর সব থেকে মূল্যবান রত্নটির মতো
কিন্তু হঠাৎ একদিন (উদাহরণস্বরূপ)
দেশটিকে তারা আমেরিকার কাছে স্বত্বপ্রদান করে দিলো
এবং সেই সঙ্গে তুমি এবং তোমার স্বাধীনতাকেও
স্বাধীনতা পেলে বিমান-ঘাঁটি হবার
তুমি প্রচার করলে মানুষ বেঁচে থাকবে
যন্ত্রবত নয়, নয় কোনো সংখ্যা বা সংযুক্তি হিসেবে
থাকবে বেঁচে মানুষ হিসেবে
ঠিক তখন তোমাকে হাতকড়া পরিয়ে দেবে ওরা
তুমি বন্দিত্বের জন্যে মুক্ত হয়ে গেলে
মুক্ত হলে কারাগারে বা এমনকি মৃত্যুদন্ডে দন্ডিত হয়ে
মানুষের জীবনে নেই কোনো লোহা বা কাষ্ঠবত
এমনকি সূক্ষ্ম কারুকাজপূর্ণ পর্দা
জীবনে স্বাধীনতা চাইবার কোনো প্রয়োজন নেই
তুমি মুক্ত
আকাশের তারার নিচে বিষন্ন স্বাধীনতার মতো মুক্ত।

জেলখানার চিঠি

নাজিম হিকমত

অনুবাদ : সুভাষ মুখোপাধ্যায়

প্রিয়তমা আমার
তোমার শেষ চিঠিতে
তুমি লিখেছ ;
মাথা আমার ব্যথায় টন্ টন্ করছে
দিশেহারা আমার হৃদয়।

তুমি লিখেছ ;
যদি ওরা তেমাকে ফাঁসী দেয়
তোমাকে যদি হারাই
আমি বাঁচব না।

তুমি বেঁচে থাকবে প্রিয়তমা বধু আমার
আমার স্মৃতি কালো ধোঁয়ার মত হাওয়ায় মিলিয়ে যাবে
তুমি বেঁচে থাকবে, আমার হৃদয়ের রক্তকেশী ভগিনী,
বিংশ শতাব্দীতে
মানুষের শোকের আয়ূ
বড় জোর এক বছর।

মৃত্যু……
দড়ির এক প্রান্তে দোদুল্যমান শবদেহ
আমার কাম্য নয় সেই মৃত্যু।
কিন্তু প্রিয়তমা আমার, তুমি জেনো
জল্লাদের লোমশ হাত
যদি আমার গলায়
ফাসীর দড়ি পরায়
নাজিমের নীল চোখে
ওরা বৃথাই খুঁজে ফিরবে
ভয়।

অন্তিম ঊষার অস্ফুট আলোয়
আমি দেখব আমার বন্ধুদের,তোমাকে দেখব
আমার সঙ্গে কবরে যাবে
শুধু আমার
এক অসমাপ্ত গানের বেদনা।


বধু আমার
তুমি আমার কোমলপ্রাণ মৌমাছি
চোখ তোমার মধুর চেয়েও মিষ্টি।
কেন তোমাকে আমি লিখতে গেলাম
ওরা আমাকে ফাঁসী দিতে চায়
বিচার সবে মাত্র শুরু হয়েছে
আর মানুষের মুন্ডুটা তো বোঁটার ফুল নয়
ইচ্ছে করলেই ছিঁড়ে নেবে ।

ও নিয়ে ভেবনা
ওসব বহু দূরের ভাবনা
হাতে যদি টাকা থাকে
আমার জন্যে কিনে পাঠিও গরম একটা পাজামা
পায়ে আমার বাত ধরেছে।
ভুলে যেও না
স্বামী যার জেলখানায়
তার মনে যেন সব সময় ফুর্তি থাকে

বাতাস আসে, বাতাস যায়
চেরির একই ডাল একই ঝড়ে
দুবার দোলে না।

গাছে গাছে পাখির কাকলি
পাখাগুলো উড়তে চায়।
জানলা বন্ধ:
টান মেরে খুলতে হবে।

আমি তোমাকে চাই ;তোমার মত রমনীয় হোক জীবন
আমার বন্ধু,আমার প্রিয়তমার মত……..।

আমি জানি,দুঃখের ডালি
আজও উজাড় হয়নি
কিন্তু একদিন হবে।


নতজানু হয়ে আমি চেয়ে আছি মাটির দিকে
উজ্জল নীল ফুলের মঞ্জরিত শাখার দিকে আমি তাকিয়ে
তুমি যেন মৃন্ময়ী বসন্ত,আমার প্রিয়তমা
আমি তোমর দিকে তাকিয়ে।

মাটিতে পিঠ রেখে আমি দেখি আকাশকে
তুমি যেন মধুমাস,তুমি আকাশ
আমি তোমাকে দেখছি প্রিয়তমা।

রাত্রির অন্ধকারে,গ্রামদেশে শুকনো পাতায় আমি জ্বালিয়েছিলাম আগুন
আমি স্পর্শ করছি সেই আগুন
নক্ষত্রের নিচে জ্বালা অগ্নিকুন্ডের মত তুমি
আমার প্রিয়তমা, তোমাকে স্পর্শ করছি।

আমি আছি মানুষের মাঝখানে,ভালবাসি আমি মানুষকে
ভালবাসি আন্দোলন,
ভালবাসি চিন্তা করতে,
আমার সংগ্রামকে আমি ভালবাসি
আমার সংগ্রামের অন্তস্থলে মানুষের আসনে তুমি আসীন
প্রিয়তমা আমার আমি তোমাকে ভালবাসি।


রাত এখন ন’টা
ঘন্টা বেজে গেছে গুমটিতে
সেলের দরোজা তালা বন্ধ হবে এক্ষুনি।
এবার জেলখানায় একটু বেশি দিন কাঁটল
আট্টা বছর।

বেঁচে থাকায় অনেক আশা,প্রিয়তমা
তোমাকে ভালবাসার মতই একাগ্র বেঁচে থাকা।
কী মধুর কী আশায় রঙ্গীন তোমার স্মৃতি….।
কিন্তু আর আমি আশায় তুষ্ট নই,
আমি আর শুনতে চাই না গান।
আমার নিজের গান এবার আমি গাইব।

আমাদের ছেলেটা বিছানায় শয্যাগত
বাপ তার জেলখানায়
তোমার ভারাক্রান্ত মাথাটা ক্লান্ত হাতের ওপর এলানো
আমরা আর আমাদের এই পৃথিবী একই সুচ্যগ্রে দাঁড়িয়ে।
দুঃসময় থেকে সুসময়ে
মানুষ পৌঁছে দেবে মানুষকে
আমাদের ছেলেটা নিরাময় হয়ে উঠবে
তার বাপ খালাস পাবে জেল থেকে
তোমার সোনালী চোখে উপচে পড়বে হাসি
আমার আর আমাদের এই পৃথিবী একই সুচ্যগ্রে দাঁড়িয়ে !


যে সমুদ্র সব থেকে সুন্দর
তা আজও আমরা দেখিনি।
সব থেকে সুন্দর শিশু
আজও বেড়ে ওঠে নি
আমাদের সব থেকে সুন্দর দিনগুলো
আজও আমরা পাইনি।
মধুরতম যে-কথা আমি বলতে চাই।
সে কথা আজও আমি বলি নি।

কাল রাতে তোমাকে আমি স্বপ্ন দেখলাম
মাথা উঁচু করে
ধুসর চোখে তুমি আছো আমার দিকে তাকিয়ে
তোমার আদ্র ওষ্ঠাধর কম্পমান
কিন্তু তোমার কণ্ঠস্বর শুনতে পেলাম না।

কৃষ্ণপক্ষ রাত্রে কোথাও আনন্দ সংবাদের মত ঘড়ির টিক্ টিক্ আওয়াজ
বাতাসে গুন্ গুন্ করছে মহাকাল
আমার ক্যানারীর লাল খাঁচায়
গানের একটি কলি,
লাঙ্গল-চষা ভূঁইতে
মাটির বুক ফুঁড়ে উদগত অঙ্কুরের দুরন্ত কলরব
আর এক মহিমান্বিত জনতার বজ্রকণ্ঠে উচ্চারিত ন্যায্য অধিকার
তোমার আদ্র ওষ্ঠাধর কম্পু
কিন্তু তোমার কণ্ঠস্বর শুনতে পেলাম না।

আশাভঙ্গে অভিশাপ নিয়ে জেগে উঠলাম।
ঘুমিয়ে পড়েছিলাম বইতে মুখ রেখে।
অতগুলো কণ্ঠস্বরের মধ্যে
তোমার স্বরও কি আমি শুনতে পাই নি ?

আমি জেলে যাবার পর

নাজিম হিকমত

অনুবাদ : সুভাষ মুখোপাধ্যায়

জেলে এলাম সেই কবে
তার পর গুণে গুণে দশ-বার সূর্যকে প্রদক্ষিণ করেছে পৃথিবী।
পৃথিবীকে যদি বলো, বলবে -
‘কিছুই নয়,
অণুমাত্র কাল।’
আমি বলব -
‘না , আমার জীবনের দশটা বছর।’

যে বছর জেলে এলাম
একটা পেন্সিল ছিল
লিখে লিখে ক্ষইয়ে ফেলতে এক হাপ্তাও লাগেনি।
পেন্সিলকে জিজ্ঞেস করলে বলবে :
‘একটা গোটা জীবন।’
আমি বলব :
‘এমন আর কী, মোটে তো একটি সপ্তাহ।’

যখন জেলে এলাম
খুনের আসামী ওসমান
কিছুকাল যেতেই ছাড়া পেল
তারপর চোরাই চালানের দায়ে
ঘুরে এসে ছ-মাস কয়েদ খাটল
আবার খালাস হল।
কাল তার চিঠি পেলাম বিয়ে হয়েছে তার
এই বসন্তেই ছেলের মুখ দেখবে।

আমি জেলে আসবার সময়
যে সন্তানেরা জননীর গর্ভে ছিল
আজ তারা দশ বছরের বালক।
সেদিনকার রোগা ল্যাংপেঙে ঘোড়ার বাচ্চাগুলো
এখন রীতিমত নিতম্বিনী।
কিন্তু জলপাইয়ের জঙ্গল আজও সেই জঙ্গল
আজও তারা তেমনি শিশু।

আমি জেলে যাবার পর
দূরবর্তী আমার শহরে জেগেছে নতুন নতুন পার্ক
আর আমার বাড়ির লোকে
এখন উঠে গেছে অচেনা রাস্তায়
সে বাড়ি আমি চোখেও দেখিনি।

যে বছর আমি জেলে এসেছিলাম
রুটি ছিল তুলোর মত সাদা
তারপর মাথাপিছু বরাদ্দের যুগ
এখানে এই জেলখানায়
লোকগুলো মুঠিভর রুটির জন্যে হন্যে হল
আজ আবার অবাধে কিনতে পারো।

কিন্তু কালো বিস্বাদ সেই রুটি।

যে বছর আমি জেলে এলাম
দ্বিতীয় যুদ্ধের সবে শুরু
দাচাউ-এর শ্মশানচুল্লী তখনও জ্বলেনি
তখনও পারমাণবিক বোমা পড়েনি হিরোশিমায়।

টুঁটি-টিপে-ধরা শিশুর রক্তের মত সময় বয়ে গেল
তারপর সমাপ্ত সেই অধ্যায়।

আজ মার্কিন ডলারে শোনো তৃতীয় মহাযুদ্ধের বোল।

কিন্তু আমি জেলে যাবার পর
আগের চেয়ে ঢের উজ্জ্বল হয়েছে দিন।
আর অন্ধকারের কিনার থেকে
ফুটপাথে ভারী ভারী হাতের ভর দিয়ে
অর্ধেক উঠে দাঁড়িয়েছে মানুষ।

আমি জেলে যাবার পর
সূর্যকে গুণে গুণে দশ-বার প্রদক্ষিণ করেছে পৃথিবী
আর আমি বারংবার সেই একই কথা বলছি
জেলখানায় কাটানো দশটা বছরে
যা লিখেছি
সব তাদেরই জন্যে
যারা মাটির পিঁপড়ের মত
সমুদ্রের মাছের মত
আকাশের পাখির মত
অগণন,
যারা ভীরু, যারা বীর
যারা নিরক্ষর,
যারা শিক্ষিত
যারা শিশুর মত সরল
যারা ধবংস করে
যারা সৃষ্টি করে

কেবল তাদেরই জীবনকথা মুখর আমার গানে।

আর যা কিছু
-ধরো, আমার জেলের দশটা বছর-
ওসব তো কথার কথা ।

মুখোশ, মুখোশ শুধু

পবিত্র মুখোপাধ্যায়

মুখোশ, মুখোশ শুধু, চারিদিকে মুখোশের ভিড়;
আমাকে অস্থির
ক’রে তোলে, নিরুপায় হয়ে তুলি হাত
আকাশে,… খটখটে মেঘ-রোদ্দুরের অনির্বচনীয়
সুন্দর নির্মাণ করে চিরায়ত
আর এক পৃথিবী;
আমি চেয়ে থাকি নির্নিমেষ।

এখন মুখোশ যুদ্ধে কেউই পরে না ছদ্মবেশ,
স্বাভাবিক দেখে ভাবি- আড়ালে
নেকড়ের চোখ জ্বলে;
ধারালো নখের লক্ষ্য ঢেকেছে আস্তিনে।
আমি অক্ষরের যাদুবলে
মুখোশের আড়ালে যে মুখ, তাকে চিনে
নিতে গিয়ে দেখি, তাও
প্লাস্টিক সার্জারী করা, অন্য আগন্তুক।

ছেলেবেলাকার সেই চোখ-নাক-মসৃণ চিবুক
কিশোর, যুবক আজ নেই,
পণ্যভার বহনের ভারে ক্লিষ্ট প্রাণ
মানুষ হয়ে ছদ্মবেশী
যুগের অস্থির অভিনেতা
আজ সকলেই।

মুখ ও মুখোশে আজ ভেদ নেই, কোন ভেদ নেই।

আমি ওই ফুলগুলির কাছে যাবো

পবিত্র মুখোপাধ্যায়

একা থাকতে পারছি না
একা হলেই রক্তমাখা নিহত ফুলগুলো দুলে ওঠে
অন্ধকার ছিঁড়ে দুলছে ওই আহত নিহত ফুলগুলি
মাটি ঢেকে যাচ্ছে শুকনো ফুলে বীজে
আর দ্যাখো : মুহূর্তেই জ্বলে উঠছে রক্তচাপা শ্মশানচাপা

আর ঘুমুতে পারছি না
ফুলগুলি হাত বাড়িয়ে ধরতে চায় মুক্তি
কাঁটাতার ছিঁড়ে আছড়ে পড়ছে বাতাসে
ছিঁড়ে যাচ্ছে পাপড়ি আর
ঝরে পড়ছে রক্তরাঙা ফুলের রেণু

ওখানে কে? ওই অন্ধকারে কার হিংস্র থাবা?
ওরা শয়তান, নখে ওদের উদ্যত মৃত্যু
ওরা উপহার দেয় মরণ আর বরণ করে ঘৃণা
ওরা উপহার দেয় মুক্তি আর বরণ করে অভিশাপ
আমি ওই ফুলগুলির কাছে যাবো আর সরিয়ে দেবো অন্ধকার
ঘাতকের মুখে ছুঁড়ে দেবো পাপড়ি আর রেণুর দাহ
ঝলসে যাবে ওদের মুখ ওই রক্তপিপাসুদের ঘৃণ্য দৃষ্টি
দুলে উঠবে হাওয়ায় প্রজ্বলন্ত রক্তচাপা ওই শ্মশান চাপা
আমিও ফুল হয়ে দুলতে থাকব ওদের পাশে
আমৃত্যু ওই জ্বলন্ত ফুলেদের পাশে আনন্দে।।

রুমির ইচ্ছা

নরেশ গুহ

আমি যদি হই ফুল,        হই ঝুঁটি-বুলবুল   হাঁস
        মৌমাছি হই একরাশ,
তবে আমি উড়ে যাই,        বাড়ি ছেড়ে দূরে যাই,
ছেড়ে যাই ধারাপাত,        দুপুরের ভূগোলের  ক্লাস।
তবে আমি টুপটুপ,            নীল-হ্রদে দিই ডুব  রোজ
        পায় না আমার কেউ খোঁজ।
তবে আমি উড়ে-উড়ে        ফুলেদের পাড়া ঘুরে
        মধু এনে দিই এক ভোজ।
হোক আমার এলো চুল,        তবু আমি হই ফুল   লাল
        ভরে দিই ডালিমের ডাল।
ঘড়িতে দুপুর বাজে;        বাবা ডুবে যান কাজে;
        তবু আর ফুরোয় না আমার সকাল।

শৈশব

সাজ্জাদ হুসাইন

রূপকথা, ছড়া আর
অদেখা ঠাকুরমার-
ঝুলি ভরা গল্পের, কল্পের বই-সব-

কিছু নেই
তাকাতেই পিছু-ভাবি কই-সব
ফেলে আসা
ভাসা-ভাসা, স্মৃতি জুড়ে শৈশব!

ভরা-গাঙে লাফ-ঝাঁপ
বরষার টুপটাপ
পুকুরের তাজা কই, উনুনের খই-সব-

কিছু নেই
তাকাতেই পিছু-ভাবি কই-সব
ফেলে আসা
ভাসা-ভাসা, স্মৃতি জুড়ে শৈশব!

খেজুরের মধু-রস
পাকা আম টসটস
এলোমেলো হাঁটা-পথ, খাঁটি মাঠা-দই সব-

কিছু নেই
তাকাতেই পিছু-ভাবি কই-সব
ফেলে আসা
ভাসা-ভাসা, স্মৃতি জুড়ে শৈশব!

প্রজাপতি সেই মন
ছুটে চলা প্রতিক্ষণ
বড় হওয়া মাছে-ভাতে, গাছে ওঠা মই-সব-

কিছু নেই
তাকাতেই পিছু-ভাবি কই-সব
ফেলে আসা
ভাসা-ভাসা, স্মৃতি জুড়ে শৈশব!

জোছনায় ভেজা-রাত
কত ফাঁকি, অজুহাত
হাসি-খুশি থইথই, প্রিয় হইচই-সব-

কিছু নেই
তাকাতেই পিছু-ভাবি কই-সব
ফেলে আসা
ভাসা-ভাসা, স্মৃতি জুড়ে শৈশব!

ও মেঘ

সাজ্জাদ হুসাইন

ও মেঘ ! আমায় সত্যি করে
তোর ঠিকানা বল-
কোত্থেকে তুই পাসরে এতো
স্নিগ্ধ-শীতল জল ?

মিষ্টি পায়ে তোর কি আছে
নূপুর, হীরের মল-
তোর বাড়িতে বাস করে কি
নৃত্য-মেয়ের দল ?

বিজলি পেলো কোথায় অমন
রঙিন আলোর ঢল-
আমায় দে-না তোর পরিচয়
করিসনে আর ছল।

তোর কথা আজ যতই ভাবি
পাই না খুঁজে তল-
মেঘ ; আমাকে বিষ্টি করে
সঙ্গে নিয়ে চল।

বিদায়

অনঙ্গমোহিনী দেবী

চিরতরে চলে গেছে হৃদয়ের রাজ,
অতল বিষাদে মোরে ডুবাইয়ে আজ!
নিয়ে গেছে সুখ সাধ সুখের বাসনা,
রেখে গেছে জন্ম শোধ হৃদয় বেদনা!
সে মম পুষ্পিত শুভ্র বসন্ত জীবন,
গেছে যবে, সাথে গেছে আমার ভূবন!
নিশীথের সুখময় জোছনা মগন,
মধ্যাহ্নের আলোময় উজ্জ্বল গগন ;
প্রভাতের মৃদু মন্দ মলয় বাতাস,
ধূসর রক্তিম চারু সন্ধ্যার আকাশ ;
কুসুমিত সুবাসিত নিকুঞ্জ কানন,
ভ্রমর গুঞ্জিত সদা সুখের সদন!
এ সকলি গেছে চলে তারি সাথে সাথে
এবে নিশা দেখা দেয় জীবন-প্রভাতে!
নিবে গেছে জীবনের শুভ্র দীপ্তি আলো,
প্রাণে শুধু নেমে আসে ঘোর ছায়া কালো!
গিয়েছে সকলি মম কিছু নাহি আর,
রয়েছে কেবল স্মৃতি আর অশ্রুধার!

পেয়েছি

অনঙ্গমোহিনী দেবী

তোমারে আমি রেখেছি বুকে
               সুখের তরে নয়,
তোমারে আমি পেয়েছি দুখে
               দুখেরে করি জয়!

                               আকাশ ছেপে তোমার প্রীতি
                                               বাতাস সম আসে
                               শীতলি’ মম চিত্ত নিতি
                                               বিচরে প্রাণ-বাসে!

আসে গো সুখ, দুঃখ দলি
               চাহিনে আমি তারে ;
বিকাশে নব প্রীতির কলি
               সুরভি মধ্য-ভারে।

                               এ দেহ প্রাণ, তোমার কাছে
                                               দিয়াছি সঁপে আমি,
                               আমার গানে জড়ায়ে আছে
                                               তোমার সুর স্বামী!

এপারে কভু পাবনা আমি!
               যেদিন মম সাঁঝে---
ওপারে যাব, জীবন স্বামী!
               উদিবে হৃদিমাঝে।

                               দোঁহের প্রীতি-অভিজ্ঞানে
                                               চিনিব দোঁহে ত্বরা,
                               তৃপ্ত মোরা হইব, পানে
                                               অমৃত চিত-ভরা!

মরণ

অনঙ্গমোহিনী দেবী

["প্রীতি" কাব্য, ১৯১০, থেকে নেওয়া]

এস ওগো, এস এস আমার মরণ!
এস হো সুন্দর সৌম্য, সুনীল বরণ!
বাজিয়া উঠিছে শঙ্খ সন্ধ্যার আরতি!
তুমি এস হৃদিতলে মন্দগতি।
শ্যামস্নিগ্ধ গোধূলিতে করিব বরণ,
এস সখা, বরবেশে মন্থর-চরণ।
আমরা দু’জন যাত্রী অনন্ত পথের,
বাজিছে অধীরে ভেরী তোমার রথের।
হৃদি-অন্তঃপুর হতে পরাণ-বধূরে
অলক্ষ্যে লইয়া যাও অনন্ত সুদূরে!
দেখিবে না, জানিবে না, কেহ কভু আর
পাবে না উদ্দেশ খুঁজি এ জগতে তার!
ফুটিয়া উঠিছে তারা রঙীন আকাশে,
পতাকা চঞ্চল তব সন্ধ্যার বাতাসে।
শিথিলিত হয়ে আসে জীবন-বন্ধন---
নিমীলিত হয়ে আসে অবস নয়ন!

জ্যোৎস্নায় তুমি কথা বলছো না কেন

আবুল হাসান

প্রতিটি নতুন কথা বলাটাই হলো আমাদের প্রেম,
প্রতিটি নতুন শব্দই হলো শিল্পকলার সীমাঃ
              হে অসীমা তুমি কথা বলছো না কেন ?
ওষ্ঠে কাঁপন ধরানোই হলো
              নিবিড় নিহিত আবেগের চুম্বন।
এসো তবে ঠোঁটে কাঁপন ধরাই
দু’জনের ঠোঁটে দূরের কুজন, হাওয়া শনশন্ চুম্বন গড়ে তুলি।
একাকী থেকেও এখন আমরা এসো দু’জনের মুগ্ধতা আনি মুখে
কপালে কাঁপাই ভ্রূযুগল অনুভূতি।
বাতাসে বহাই চক্ষুর সম্মতি।
এসো সতী মেয়ে আবার আমরা শুয়ে পড়ি, সেতু বাঁধি
              দুই শরীরের মিলনে ঐকতান,
সংরাগে দেই সুন্দর করতালিঃ
আমাদের দুটি হৃদয়ে আজকে প্রথম ধরেছে কলি,
এসো উদ্যানে পুষ্প পবনে অঙ্গার হয়ে জ্বলি।
সূর্যে তারায় শত শনশন সবুজ ডেরায় আমি তুলি ঝঙ্কার
              কান পেতে তুমি তাই শোনো মৃত্তিকা,
এসো সুন্দর, এসো হে শহরতলী,
আমাকে বানাও ঘন সবুজের শিখা,
              তুমি তো বনস্থলী,
তোমাকে কে চেনে আর
আমি ছাড়া আর কে জানে তোমার কেন এ অহঙ্কার,
কেন নিশ্চুপ, কথা বলছো না হৃদয়ে পূর্ণিমার
জ্যোৎস্নায় তুমি কথা বলছো না কেন।

স্রোতে রাজহাঁস আসছে

আবুল হাসান

পুনর্বার স্রোতে ভাসছে হাঁস, ভাসতে দাও
                  কোমল জলের ঘ্রাণ মাখুক হাঁসেরা;
বহুদিন পর ওরা জলে নামছে, বহুদিন পর ওরা কাটছে সাঁতার
                  স্রোতে রাজহাঁস আসছে, আসতে দাও,

বহুদিন পর যেনো রোদ আসছে, আসতে দাও
                 নত হতে দাও আকাশকে,
                 আর একটু নত হোক আলো
                 আর একটু নির্জন হোক অন্ধকার !

আর তুমি পরে নাও তোমার গহনা, দুল
তোমার আঙ্গুল হোক হেমন্তের ফুল,
                  আমি শুঁকি, শুঁকতে দাও !

বহুদিন পর যেনো শুঁকছি বকুল !
বহুদিন তোমার ভিতরে যাইনা, বহুদিন বকুল ফুলের ঘ্রাণ
                  পাইনা এ মনে !

মনে করতে দাও তবু কোনখানে বকুলবাগান ছিল
                   গেরস্থের হাজার দুয়ারী ঘরবাড়ি
                   উঁচু আসন, সিংহাসন
মনে করো, মনে কোরে নাও
আমাদেরও সিংহাসন আছে আজও
আমাদের হাজার দুয়ারী বাড়ি আছে

মাটির ময়ূর, ঠোঁটে ঠোঁট, ফুলে ফুল
লুকোনো ডাকবাকস আছে সবুজের কাছে
মনে করো আমাদেরও ভালোবাসা আছে
খাগের কলমে লেখা তাদের অক্ষরগুলি
ধানের শীষের মতো টলমলায় সেখানে শরীরে

তুমি মনে করো, মনে করে নাও
তোমার শরীরে শাড়ি,
গেরস্থের হাজার দুয়ারী ঘরবাড়ি
আলো আর অন্ধকার মনে করো, মনে করে নাও
আমরা নৌকার জলে ভাসতে ভাসতে যেনো প্রতীকের হাঁস
                   ঐ রাজহাঁস
জল থেকে আরো জলে,
ঢেউ থেকে আরো ঢেউয়ে ছড়াতে ছড়াতে
                   পৌঁছে যাবো আগে।

শেষ মুহূর্তের কবিতা

রেজাউদ্দিন স্টালিন

শেষ মুহূর্তে মিথ্যে লিখবো
আমার মৃত্যুর জন্য কেউ দায়ী নয়
প্রকৃতপক্ষে আমার মৃত্যুর জন্য তুমিই দায়ী

অসম্ভব ঘন কাঁচের ভেতর থেকে তোমাকে দেখতে
পাত্র ভর্তি পারদের ভেতর থেকে বিরল স্পর্শ করতে
স্বপ্নের ভেতরে একসাথে আকাশে-আকাশে শঙ্খচিল হতে

পৃথিবীর জন্যে একটা মৃত্যু তেমন কিছু নয়
কিন্তু মানুষের জন্যে একটা মৃত্যু সাংঘাতিক শূন্যতা
ঘাসের চোখ থেকে শিশির শুকিয়ে যাওয়ার মতো
সুর সৃষ্টিতে পরাজিত মার্সিয়াসের শরীর থেকে
চামড়া ছাড়িয়ে নেয়ার মতো
পেগাসাস পঙ্খীরাজের পেছনে একটা ডাসকে
লেলিয়ে দেয়ার মতো

অপেক্ষায় আছি এই আত্মবোধন থেকে আমাকে বাঁচাবে
উদ্যত নৃশংস ক্রুরছুরির অন্তিম আলোয় জাপটে ধরবে হাত
অনন্তকাল আমার দিকে তীব্র তাকিয়ে থাকবে
যত ইচ্ছা আমি তোমাকে বাতাসের মতো স্পর্শ করবো
আষাঢ়ের মেঘমন্দ্রের মতো অনবরত তোমার কণ্ঠস্বর শুনবো
আভারনাস-হ্রদের আকাশে শঙ্খচিল হবো

কখনো-কখনো মৃত্যু একটা বেলেহাঁসের পালকের চেয়েও হালকা
কখনো-কখনো আলপসের চেয়ে ভারি
কিন্তু আমার আত্মমৃত্যু পৃথিবীর মতো বিবর্তমান
আমার এখনো অনেক কিছু দেখা হয়নি
পৃথিবীর বড় বড় সভ্যতা ও সমুদ্র
নেমেসিসের শবাধার, সক্রেটিসের সৌন্দর্য, হোমারের অন্ধত্ব
তোমার চোখের মতো চিল্কার হ্রদের আস্ত আকাশ
এমনকি দান্তের নরকের একটা হিংস্র চিতাবাঘ

তবু এই অসম্পূর্ণতার মধ্যেই মেনে নিচ্ছি মৃত্যু
লিখতে হচ্ছে আমার মৃত্যুর জন্যে কেউ দায়ী নয়

তুমিই শুধু তুমি

সৈয়দ শামসুল হক

তোমার দেহে লতিয়ে ওঠা ঘন সবুজ শাড়ি।
কপালে ওই টকটকে লাল টিপ।

আমি কি আর তোমাকে ছেড়ে
কোথাও যেতে পারি?
তুমি আমার পতাকা, আমার কৃষির বদ্বীপ।

করতলের স্বপ্ন-আমন ধানের গন্ধ তুমি
তুমি আমার চিত্রকলার তুলি।
পদ্য লেখার ছন্দ তুমি−সকল শব্দভুমি।
সন্তানের মুখে প্রথম বুলি।

বুকে তোমার দুধের নদী সংখ্যা তেরো শত।
পাহাড় থেকে সমতলে যে নামি−

নতুন চরের মতো তোমার চিবুক জাগ্রত−
তুমি আমার, প্রেমে তোমার আমি।

এমন তুমি রেখেছ ঘিরে−এমন করে সব−
যেদিকে যাই−তুমিই শুধু−তুমি!
অন্ধকারেও নিঃশ্বাসে পাই তোমার অনুভব,
ভোরের প্রথম আলোতেও তো তুমি!

একুশের কবিতা

সৈয়দ শামসুল হক

সভ্যতার মণিবন্ধে সময়ের ঘড়ি
শিশুর জন্ম থেকে জরাদেহ ক্ষীণশ্বাস মানবের অবলুপ্তির সীমারেখায়
বলে গেল সেই কথা। সেই কথা বলে গেল অনর্গল–

তপ্তশ্বাস হাহুতাশ পাতাঝরা বিদীর্ণ বৈশাখীর জ্বালাকর দিগন্তে
আষাঢ়ের পুঞ্জীভূত কালো মেঘ আসবেই ঠিক।
সাগরের লোনাজলে স্নিগ্ধ মাটীর দ্বীপ
শ্যামলী স্বপ্নের গান বুকে পুষে
নবীন সূর্য্যেরে তার দৃঢ় অঙ্গীকার জানাবেই।
সংখ্যাহীন প্রতিবাদ ঢেউয়েরা আসুক, তুমি স্থির থেকো।
প্রাকৃতিক ঝঞ্ঝাবাত অবহেলা করি
সঞ্চয় করে যাও মুঠো মুঠো গৈরিক মাটী:
সবুজ গন্ধবাহী সোনালী সূর্য্যের দিশা
অকস্মাৎ উদ্ভাসিত কোরে দেবে তোমার চলার পথ।

সভ্যতার মণিবন্ধে সময়ের ঘড়ি
শিশুর জন্ম থেকে জরাদেহ ক্ষীণশ্বাস মানবের অবলুপ্তির সীমারেখায়
বলে গেল সেই কথা। সেই কথা বলে গেল অনর্গল–
পৃথিবীর জিজীবিষু আত্মার আছে। ঘনীভূত জনতার হৃদয়ে হৃদয়ে
উজ্জ্বল শিখা সেই অমর সংবাদে ঢেউ তুলে দিয়ে গেল।।

এখন মধ্যরাত

সৈয়দ শামসুল হক

এখন মধ্যরাত।
তখন দুপুরে রাজপথে ছিলো মানুষের পদপাত।
মিছিলে মিছিলে টলমল ছিলো সারাদিন রাজধানী।
এখন কেবল জননকূল ছল বুড়িগঙ্গার পানি
শান্ত নীরব
নিদ্রিত সব।
ওই একজন জানালায় রাখে তার বিনিদ্র হাত

ছিলো একদিন তার
উজ্জ্বল দিন, ছিলো যৌবন ছিলো বহু চাইবার।
সারা রাত চষে ফিরেছে শহর খুঁজেছে সে ভালোবাসা।
পেতেছে সে হাত জীবনের কাছে ছিলো তারও প্রত্যাশা পাওয়া না পাওয়ার
প্রশ্নে হাওয়ার
বাষ্পরুদ্ধ কণ্ঠে এখন সারারাত হাহাকার।

পথে ওড়ে ধুলো, ছাই ওড়ে শুধু পথে যে আগুন ছিলো
একদা সে জ্বেলে ছিলো।
হৃদয়ে এখন সৌধের ভাঙা টুকরো আছাড় খায়।
আলো নিভে যায়, নিভে যায় আলো একে একে জানালায়।
থেমে যায় গান
তারপরও প্রাণ
বাঁশিটির মতো বেজে চলে যেন সবই আছে সবই ছিলো।

আমার পরিচয়

সৈয়দ শামসুল হক

আমি জন্মেছি বাংলায়
আমি বাংলায় কথা বলি।
আমি বাংলার আলপথ দিয়ে, হাজার বছর চলি।
চলি পলিমাটি কোমলে আমার চলার চিহ্ন ফেলে।
তেরশত নদী শুধায় আমাকে, কোথা থেকে তুমি এলে ?

আমি তো এসেছি চর্যাপদের অক্ষরগুলো থেকে
আমি তো এসেছি সওদাগরের ডিঙার বহর থেকে।
আমি তো এসেছি কৈবর্তের বিদ্রোহী গ্রাম থেকে
আমি তো এসেছি পালযুগ নামে চিত্রকলার থেকে।

এসেছি বাঙালি পাহাড়পুরের বৌদ্ধবিহার থেকে
এসেছি বাঙালি জোড়বাংলার মন্দির বেদি থেকে।
এসেছি বাঙালি বরেন্দ্রভূমে সোনা মসজিদ থেকে
এসেছি বাঙালি আউল-বাউল মাটির দেউল থেকে।

আমি তো এসেছি সার্বভৌম বারোভূঁইয়ার থেকে
আমি তো এসেছি ‘কমলার দীঘি’ ‘মহুয়ার পালা’ থেকে।
আমি তো এসেছি তিতুমীর আর হাজী শরীয়ত থেকে
আমি তো এসেছি গীতাঞ্জলি ও অগ্নিবীণার থেকে।

এসেছি বাঙালি ক্ষুদিরাম আর সূর্যসেনের থেকে
এসেছি বাঙালি জয়নুল আর অবন ঠাকুর থেকে।
এসেছি বাঙালি রাষ্ট্রভাষার লাল রাজপথ থেকে
এসেছি বাঙালি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর থেকে।

আমি যে এসেছি জয়বাংলার বজ্রকণ্ঠ থেকে
আমি যে এসেছি একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধ থেকে।
এসেছি আমার পেছনে হাজার চরণচিহ্ন ফেলে
শুধাও আমাকে ‘এতদূর তুমি কোন প্রেরণায় এলে ?

তবে তুমি বুঝি বাঙালি জাতির ইতিহাস শোনো নাই-
‘সবার উপরে মানুষ সত্য, তাহার উপরে নাই।’
একসাথে আছি, একসাথে বাঁচি, আজো একসাথে থাকবোই
সব বিভেদের রেখা মুছে দিয়ে সাম্যের ছবি আঁকবোই।

পরিচয়ে আমি বাঙালি, আমার আছে ইতিহাস গর্বের-
কখনোই ভয় করিনাকো আমি উদ্যত কোনো খড়গের।
শত্রুর সাথে লড়াই করেছি, স্বপ্নের সাথে বাস;
অস্ত্রেও শান দিয়েছি যেমন শস্য করেছি চাষ;
একই হাসিমুখে বাজায়েছি বাঁশি, গলায় পরেছি ফাঁস;
আপোষ করিনি কখনোই আমি- এই হ’লো ইতিহাস।

এই ইতিহাস ভুলে যাবো আজ, আমি কি তেমন সন্তান ?
যখন আমার জনকের নাম শেখ মুজিবুর রহমান;
তারই ইতিহাস প্রেরণায় আমি বাংলায় পথ চলি-
চোখে নীলাকাশ, বুকে বিশ্বাস পায়ে উর্বর পলি।

একেই বুঝি মানুষ বলে


সৈয়দ শামসুল হক

নষ্ট জলে পা ধুয়েছো এখন উপায় কি?
আচ্ছাদিত বুকের বোঁটা চুমোয় কেটেছি।
কথার কোলে ইচ্ছেগুলো বাৎসায়নের রতি,
মানে এবং অন্য মানে দুটোই জেনেছি।
নষ্ট জলে ধুইয়ে দেবে কখন আমার গা,
তোমার দিকে হাঁটবে কখন আমার দুটো পা?
সেই দিকে মন পড়েই আছে, দিন তো হলো শেষ;
তোমার মধ্যে পবিত্রতার একটি মহাদেশ
এবং এক জলের ধারা দেখতে পেয়েছি-
একেই বুঝি মানুষ বলে, ভালোবেসেছি।

আমি একটুখানি দাঁড়াব


সৈয়দ শামসুল হক


আমি একটুখানি দাঁড়াব এবং দাঁড়িয়ে চলে যাব;
শুধু একটু থেমেই আমি আবার এগিয়ে যাব;
না, আমি থেকে যেতে আসিনি;
এ আমার গন্তব্য নয়;

চে গুয়েভারার প্রতি

সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়

চে, তোমার মৃত্যু আমাকে অপরাধী করে দেয়
আমার ঠোঁট শুকনো হয়ে আসে, বুকের ভেতরটা ফাঁকা
আত্মায় অভিশ্রান্ত বৃষ্টিপতনের শব্দ
শৈশব থেকে বিষণ্ন দীর্ঘশ্বাস
চে, তোমার মৃত্যু আমাকে অপরধী করে দেয়-
বোলিভিয়ার জঙ্গলে নীল প্যান্টালুন পরা
তোমার ছিন্নভিন্ন শরীর
তোমার খোলা বুকের মধ্যখান দিয়ে
নেমে গেছে
শুকনো রক্তের রেখা
চোখ দুটি চেয়ে আছে
সেই দৃষ্টি এক গোলার্ধ থেকে চুটে আসে অন্য গোলার্ধে
চে, তোমার মৃত্যু আমাকে অপরাধী করে দেয়।

শৈশব থেকে মধ্য যৌবন পর্যন্ত দীর্ঘ দৃষ্টিপাত-
আমারও কথা ছিল হাতিয়ার নিয়ে তোমার পাশে দাঁড়াবার
আমারও কথা ছিল জঙ্গলে কাদায় পাথরের গুহায়
লুকিয়ে থেকে
সংগ্রামের চরম মুহূর্তটির জন্য প্রস্তুত হওয়ার
আমারও কথা ছিল রাইফেলের কুঁদো বুকে চেপে প্রবল হুঙ্কারে
ছুটে যাওয়ার
আমারও কথা ছিল ছিন্নভিন্ন লাশ ও গরম রক্তের ফোয়ারার মধ্যে
বিজয়-সঙ্গীত শোনাবার-
কিন্তু আমার অনবরত দেরি হয়ে যাচ্ছে!

এতকাল আমি এক, আমি অপমান সয়ে মুখ নিচু করেছি
কিন্তু আমি হেরে যাই নি, আমি মেনে নিই নি
আমি ট্রেনের জানলার পাশে, নদীর নির্জন রাস্তায়, ফাঁকা
মাঠের আলপথে, শ্মশানতলায়
আকাশের কাছে, বৃষ্টির কাছে বৃক্ষের কাছে, হঠাৎ-ওঠা
ঘূর্ণি ধুলোর ঝড়ের কাছে
আমার শপথ শুনিয়েছি, আমি প্রস্তুত হচ্ছি, আমি
সব কিছুর নিজস্ব প্রতিশোধ নেবো
আমি আমার ফিরে আসবো
আমার হাতিয়অরহীন হাত মুষ্টিবদ্ধ হয়েছে, শক্ত হয়েছে চোয়াল,
মনে মনে বারবার বলেছি, ফিরে আসবো!
চে, তোমার মৃত্যু আমাকে অপরাধী করে দেয়-
আমি এখনও প্রস্তুত হতে পারি নি, আমার অনবরত
দেরি হয়ে যাচ্ছে
আমি এখনও সুড়ঙ্গের মধ্যে আধো-আলো ছায়ার দিকে রয়ে গেছি,
আমার দেরি হয়ে যাচ্ছে
চে, তোমার মৃত্যু আমাকে অপরাধী করে দেয়!

নিজের কানে কানে

সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়

এক এক সময় মনে হয়, বেঁচে থেকে আর লাভ নেই
এক এক সময় মনে হয়
পৃথিবীটাকে দেখে যাবো শেষ পর্যন্ত!
এক এক সময় মানুষের ওপর রেগে উঠি
অথচ ভালোবাসা তো কারুকে দিতে হবে
জন্তু-জানোয়ার গাছপালাদের আমি ওসব
দিতে পারি না
এক এক সময় ইচ্ছে হয়
সব কিছু ভেঙেচুরে লন্ডভন্ড করে ফেলি
আবার কোনো কোনো বিরল মুঞূর্তে
ইচ্ছে হয় কিছু এককটা তৈরি করে গেলে মন্দ হয় না।

হঠাৎ কখনো দেখতে পাই সহস্র চোখ মেলে
তাকিয়ে আছে সুন্দর
কেউ যেন ডেকে বলছে, এসো এসো,
কতক্ষণ ধরে বসে আমি তোমার জন্য
মনে পড়ে বন্ধুদের মুখ, যারা শত্রুদের, যারাও হয়তো কখনো
আবার বন্ধু হবে
নদীর বিনারে গিয়ে মনে পড়ে নদীর চেয়েও উত্তাল সুগভীর নারীকে
সন্ধের আকাশ কী অকপট, বাতাসে কোনো মিথ্যে নেই,
তখন খুব আস্তে, ফিসফিস করে, প্রায়
নিজেরই কানে-কানে বলি,
একটা মানুষ জন্ম পাওয়া গেল, নেহাৎ অ-জটিল কাটলো না!

অপরিচিতি

আবুল হাসান

যেখানেই যাই আমি সেখানেই রাত!

স্টেডিয়ামে খোলা আকাশের নিচে রেস্তোরাঁয়
অসীমা যেখানে তার অত নীল চোখের ভিতর
ধরেছে নিটোল দিন নিটোল দুপুর
সেখানে গেলেও তবু আমার কেবলই রাত
আমার কেবলই শুধু রাত হয়ে যায়!

ঘুমের আগে

আহসান হাবীব

জানো মা, পাখিরা বড় বোকা, ওরা কিছুই জানেনা।
যত বলি, কাছে এসো, শোনো শোনো, কিছুতেই মানেনা।

মিছেমিছি কেন ওরা ভয় পায়, ভয়ের কি আছে ?
বোঝেনা বোকারা, আমি ভালোবাসি তাই ডাকি কাছে।
দেখোনা, যখন কাল আমাদের আমবাগানের
পুবধারে ওরা সব বসিয়েছে আসর গানের-
আমি গিয়ে চুপ চুপে কিছু দূরে বসেছি যখন,
গান ভুলে বোকাগুলো একসাথে পালালো তখন।
ওরা কি জানেনা, আমি গান বড় ভালোবাসি, তাই
যখনি ওদের দেখি চুপে চুপে কাছে চলে যাই !

আচ্ছা মা, বলো দেখি কি করে কাটাব এই ভয়,
কি পেলে তখন ওরা সবচেয়ে বেশি খুশি হয় ?
সাদা কড়ি ওদের কি ভাল লাগে ? আমার যেমন
ছোট লাল ঘুড়ি আছে, মাজা সূতো, ওদের তেমন
আছে না কি ? কিছু নেই ? বেশ কথা, না-ই যদি থাকে
বোকারা নিজেরা এসে বলে যেতে পারে ত আমাকে,
আমি ত দিতেই চাই, বোকারা যে কখনো আসে না।
জানি, ওরা পাখি কি-না, মানুষকে ভালোই বাসে না।

বলোনা মা, কি করলে পাখিরাও খুব ভালোবাসে,
কি করলে পাখিরাও ভালোবেসে খুব কাছে আসে।

এই খানে নিরঞ্জনা

আহসান হাবীব

এইখানে নিরঞ্জনা নদী ছিলো
এই ঘাটে হাজার গৌতম
স্নান করে শুদ্ধ হয়েছেন।
নদী আছে ঘাট আছে
সেই শুদ্ধ জলের অভাব

অশুদ্ধ মানুষ খুব বেড়ে গেছে
সারিবদ্ধ স্নানার্থী মানুষ
মরানদী মরাস্রোত ছাড়িয়ে এখন _
বলে দাও
যেতে হবে অন্য কোনো নিরঞ্জনা নদীর সন্ধানে।

একবার বলেছি তোমাকে

আহসান হাবীব

একবার বলেছি, তোমাকে আমি ভালোবাসি।
একবার বলেছি, তোমাকে আমি, তোমাকেই ভালোবাসি।
বল
এখন সে কথা আমি ফেরাব কেমনে !
আমি একবার বলেছি তোমাকে …

এখন তোমাকে আমি ঘৃণা করি।
এখন তোমার
দৃষ্টির কবলে এলে ক্ষতস্থান জ্বলে জ্বলে ওঠে।
তোমার সান্নিধ্যে এলে তুমি উষ্ণ নাভিমূল থেকে
বাতাসে ছড়াও তীব্র সাপিনীর তরল নিঃস্বাস। আমি
যতবার ছুটতে চাই, তোমার দৃষ্টির বাইরে যেতে চাই, তুমি
দু চোখে কী ইন্দ্রজাল মেলে রাখ ! আমি ছুটতেও পারি না
আমি ফেরাতে পারি না কথা
আমি একবার বলেছি, তোমাকে …

সম্রাজ্ঞীর বেশে আছ। নতজানু আমি
দাসানুদাসের ভঙ্গি করপুটে, দেখি
তোমার মুখের রেখা অবিচল, স্থির জঙ্ঘা তোলে না টঙ্কার,
তুমি পবিত্রতা পবিত্রতা বলে
অস্পষ্ট চিত্কার কর, তুমি
কেবলি মালিন্য দেখ, অশ্লীলতা, ক্রমান্বয়ে ঘৃণা
ক্রোধ বাড়ে, উত্তেজনা বাড়ে
নামে উষ্ণ জলস্রোত। তুমি
এইভাবে প্রবল ঘৃণায়
আমাকে ভাসিয়ে দিয়ে অহঙ্কার রাখতে চাও অটুট। তবুও
পৃথিবীতে আছে কিছু মানুষের অবস্থান, তারা
অপমানে ধন্য হয়
উপেক্ষায় ঋজু;
তারা স্বভাব-কাঙাল ! যদি
একবার বলে তবে ফেরাতে পারে না। আমি
ফেরাতে পারি না। আমি
একবার বলেছি, তোমাকে আমি ভালোবাসি।

ভালোবাসা ভালোবাসা ভালোবাসা
ভালোবাসা ! সে কেমন, কোন দীপ্র স্বর্গীয় প্রতাপ
যার মৃত্যু নেই
জন্মান্তর নেই?

দোতলার ল্যান্ডিং মুখোমুখি দুজন

আহসান হাবীব

মুখোমুখি ফ্ল্যাট
একজন সিঁড়িতে, একজন দরজায়

: আপনারা যাচ্ছেন বুঝি ?
: চলে যাচ্ছি, মালপত্র উঠে গেছে সব ।
: বছর দুয়েক হল, তাই নয় ?
: তারো বেশী । আপনার ডাক নাম শানু, ভালো নাম ?
: শাহানা, আপনার ?
: মাবু ।
: জানি ।
: মাহবুব হোসেন । আপনি খুব ভালো সেলাই জানেন ।
: কে বলেছে । আপনার তো অনার্স ফাইন্যাল, তাই নয় ?
: এবার ফাইন্যাল ।
: ফিজিক্স-এ অনার্স ।
: কী আশ্চর্য ! আপনি কেন ছাড়লেন হঠাৎ ?
: মা চান না । মানে ছেলেদের সঙ্গে বসে…
: সে যাক গে, পা সেরেছে ?
: কী করে জানলেন ?
: এই আর কি ! সেরে গেছে ?
: ও কিছুনা , প‌্যাসেজটা পিছলে ছিল মানে…
: সত্যি নয় । উচুঁ থেকে পড়ে গিয়ে…
: ধ্যাৎ । খাবার টেবিলে রোজ মাকে অতো জ্বালানো কি ভালো ?
: মা বলেছে ?
: শুনতে পাই । বছর দুয়েক হল, তাই নয় ?
: তারো বেশী । আপনার টবের গাছে ফুল এসেছে ?
: নেবেন ? না থাক । রিকসা এল, মা এলেন , যাই ।
: আপনি সন্ধ্যে বেলা ওভাবে কখনও পড়বেন না,
চোখ যাবে, যাই ।
: হলুদ শার্টের মাঝখানে বোতাম নেই, লাগিয়ে নেবেন, যাই ।
: যান, আপনার মা আসছেন । মা ডাকছেন, যাই ।

নকশী কাঁথার মাঠ – ১৪

জসীমউদদীন

চৌদ্দ

উইড়া যায়রে হংস পক্ষি পইড়া রয়রে ছায়া ;
দেশের মানুষ দেশে যাইব—কে করিবে মায়া |
                                  -মুর্শিদা গান

আজো এই গাঁও অঝোরে চাহিয়া ওই গাঁওটির পানে,
নীরবে বসিয়া কোন্ কথা যেন কহিতেছে কানে কানে |
মধ্যে অথই শুনো মাঠখানি ফাটলে ফাটলে ফাটি,
ফাগুনের রোদে শুকাইছে যেন কি ব্যথারে মূক মাটি!
নিঠুর চাষীরা বুক হতে তার ধানের বসনখানি,
কোন্ সে বিরল পল্লীর ঘরে নিয়ে গেছে হায় টানি !

বাতাসের পায়ে বাজেনা আজিকে ঝল মল মল গান,
মাঠের ধূলায় পাক খেয়ে পড়ে কত যেন হয় ম্লান!
সোনার সীতারে হরেছে রাবণ, পল্লীর পথ পরে,
মুঠি মুঠি ধানে গহনা তাহার পড়িয়াছে বুঝি ঝরে!
মাঠে মাঠে কাঁদে কলমীর লতা, কাঁদে মটরের ফুল,
এই একা মাঠে কি করিয়া তারা রাখিবেগো জাতি-কুল |
লাঙল আজিকে হয়েছে পাগল, কঠিন মাটিরে চিরে,
বুকখানি তার নাড়িয়া নাড়িয়া ঢেলারে ভাঙিবে শিরে |
তবু এই-গাঁও রহিয়াছে চেয়ে, ওই-গাঁওটির পানে,
কতদিন তারা এমনি কাটাবে কেবা তাহা আজ জানে |
মধ্যে লুটায় দিগন্ত-জোড়া নক্সী-কাঁথার মাঠ ;
সারা বুক ভরি কি কথা সে লিখি, নীরবে করিছে পাঠ!
এমন নাম ত শুনিনি মাঠের? যদি লাগে কারো ধাঁধাঁ,
যারে তারে তুমি শুধাইয়া নিও, নাই কোন এর বাঁধা |

সকলেই জানে সেই কোন্ কালে রূপা বলে এক চাষী,
ওই গাঁর এক মেয়ের প্রেমেতে গলায় পড়িল ফাঁসি |
বিয়েও তাদের হয়েছিল ভাই, কিন্তু কপাল-লেখা,
খন্ডাবে কেবা? দারুণ দুঃখ ভালে এঁকে গেল রেখা |
রূপা একদিন ঘর-বাড়ি ছেড়ে চলে গেল দূর দেশে,
তারি আশা-পথে চাহিয়া চাহিয়া বউটি মরিল শেষে |
মরিবার কালে বলে গিয়েছিল — তাহার নক্সী-কাঁথা,
কবরের গায়ে মেলে দেয় যেন বিরহিণী তার মাতা!

বহুদিন পরে গাঁয়ের লোকেরা গভীর রাতের কালে,
শুনিল কে যেন বাজাইছে বাঁশী বেদনার তালে তালে |
প্রভাতে সকলে দেখিল আসিয়া সেই কবরের গায়,
রোগ পাণ্ডডুর একটি বিদেশী মরিয়া রয়েছে হায়!
শিয়রের কাছে পড়ে আছে তার কখানা রঙীন শাড়ী,
রাঙা মেঘ বেয়ে দিবসের রবি যেন চলে গেছে বাড়ি!

সারা গায় তার জড়ায়ে রয়েছে সেই নক্সী-কাঁথা,—
আজও গাঁর লোকে বাঁশী বাজাইয়া গায় এ করুণ গাথা |

কেহ কেহ নাকি গভীর রাত্রে দেখেছে মাঠের পরে,—
মহা-শূণ্যেতে উড়িয়াছে কেবা নক্সী-কাথাটি ধরে ;
হাতে তার সেই বাঁশের বাঁশীটি বাজায় করুণ সুরে,
তারি ঢেউ লাগি এ-গাঁও ও-গাঁও গহন ব্যথায় ঝুরে |
সেই হতে গাঁর নামটি হয়েছে নক্সী-কাঁথার মাঠ,
ছেলে বুড়ো গাঁর সকলেই জানে ইহার করুণ পাঠ |

                   -শেষ-

নকশী কাঁথার মাঠ – ১৩

জসীমউদদীন

তেরো

বিদ্যাশেতে রইলা মোর বন্ধুরে |
বিধি যদি দিত পাখা,
উইড়া যাইয়া দিতাম দেখা ;
আমি উইড়া পড়তাম সোনা বন্ধুর দেশেরে |
আমরা ত অবলা নারী,
তরুতলে বাসা বান্ধিরে ;
আমার বদন চুয়ায়া পড়ে ঘামরে |
বন্ধুর বাড়ী গঙ্গার পার
গেলে না আসিবা আর ;
আমার না জান বন্ধু, না জানে সাঁতাররে |
বন্ধু যদি আমার হও
উইড়া আইসা দেখা দাও
তুমি দাও দেখা জুড়াক পরাণরে |
                       -রাখালী গান

একটি বছর হইয়াছে সেই রূপাই গিয়াছে চলি,
দিনে দিনে নব আশা লয়ে সাজুরে গিয়াছে ছলি |
কাইজায় যারা গিয়াছিল গাঁয়, তারা ফিরিয়াছে বাড়ী,
শহরের জজ, মামলা হইতে সবারে দিয়াছে ছাড়ি |
স্বামীর বাড়ীতে একা মেয়ে সাজু কি করে থাকিতে পারে,
তাহার মায়ের নিকটে সকলে আনিয়া রাখিল তারে |
একটি বছর কেটেছে সাজুর একটি যুগের মত,
প্রতিদিন আসি, বুকখানি তার করিয়াছে শুধু ক্ষত |

ও-গাঁয়ে রূপার ভাঙা ঘরখানি মেঘ ও বাতাসে হায়,
খুঁটি ভেঙে আজ হামাগুড়ি দিয়ে পড়েছে পথের গায় |
প্রতি পলে পলে খসিয়া পড়িছে তাহার চালের ছানি,
তারও চেয়ে আজি জীর্ণ শীর্ণ সাজুর হৃদয়খানি |
রাত দিন দুটি ভাই বোন যেন দুখেরই বাজায় বীণ |
কৃষাণীর মেয়ে, এতটুকু বুক, এতটুকু তার প্রাণ,
কি করিয়া সহে দুনিয়া জুড়িয়া অসহ দুখের দান!
কেন বিধি তারে এত দুখ দিল, কেন, কেন, হায় কেন,
মনের-মতন কাঁদায় তাহারে “পথের কাঙালী” হেন ?

সোঁতের শেহলা ভাসে সোঁতে সোঁতে, সোঁতে সোঁতে ভাসে পানা,
দুখের সাগরে ভাসিছে তেমনি সাজুর হৃদয়খানা |
কোন্ জালুয়ার মাছ সে খেয়েছে নাহি দিয়ে তায় কড়ি,
তারি অভিশাপ ফিরেছে কি তার সকল পরাণ ভরি !
কাহার গাছের জালি কুমড়া সে ছিঁড়েছিল নিজ হাতে,
তাহারি ছোঁয়া কি লাগিয়াছে আজ তার জীবনের পাতে !
তোর দেশে বুঝি দয়া মায়া নাই, হা-রে নিদারুণ বিধি
কোন্ প্রাণে তুই কেড়ে নিয়ে গেলি তার আঁচলের নিধি |
নয়ন হইতে উড়ে গেছে হায় তার নয়নের তোতা,
যে ব্যাথারে সাজু বহিতে পারে না, আজ তা রাখিবে কোথা ?

এমনি করিয়া কাঁদিয়া সাজুর সারাটি দিবস কাটে,
আমেনে কভু একা চেয়ে রয় দীঘল গাঁয়ের বাটে |
কাঁদিয়া কাঁদিয়া সকাল যে কাটে—দুপুর কাটিয়া যায়,
সন্ধ্যার কোলে দীপ নিবু-নিবু সোনালী মেঘের নায়ে |
তবু ত আসে না ! বুকখানি সাজু নখে নখে আজ ধরে,
পারে যদি তবে ছিঁড়িয়া ফেলায় সন্ধ্যার কাল গোরে |
মেয়ের এমন দশা দেখে মার সুখ নাই কোন মনে,
রূপারে তোমরা দেখেছ কি কেউ, শুধায় সে জনে জনে |
গাঁয়ের সবাই অন্ধ হয়েছে, এত লোক হাটে যায়,
কোন দিন কিগো রূপাই তাদের চক্ষে পড়ে নি হায় !
খুব ভাল করে খোঁজে যেন তারে, বুড়ী ভাবে মনে মনে,
রূপাই কোথাও পলাইয়া আছে হয়ত হাটের কোণে |
ভাদ্র মাসেতে পাটের বেপারে কেউ কেউ যায় গাঁরষ
নানা দেশে তারা নাও বেয়ে যায় পদ্মানদীর পার |
জনে জনে বুড়ী বলে দেয়, “দেখ, যখন যখানে যাও,
রূপার তোমরা তালাস লইও, খোদার কছম খাও |”
বর্ষার শেষে আনন্দে তারা ফিরে আসে নায়ে নায়ে,
বুড়ী ডেকে কয়, “রূপারে তোমরা দেখ নাই কোন গাঁয়ে !”
বুড়ীর কথার উত্তর দিতে তারা নাহি পায় ভাষা,
কি করিয়া কহে, আর আসিবে না যে পাখি ছেড়েছে বাসা |

চৈত্র মাসেতে পশ্চিম হতে জন খাটিবার তরে,
মাথাল মাথায় বিদেশী চাষীরা সারা গাঁও ফেলে ভরে |
সাজুর মায়ে যে ডাকিয়া তাদের বসায় বাড়ির কাছে,
তামাক খাইতে হুঁকো এনে দ্যায়, জিজ্ঞাসা করে পাছে ;
“তোমরা কি কেউ রূপাই বলিয়া দেখেছ কোথাও কারে,
নিটল তাহার গঠন গাঠন, কথা কয় ভারে ভারে |”
এমনি করিয়া বলে বুড়ী কথা, তাহারা চাহিয়া রয়,—
রুপারে যে তারা দেখে নাই কোথা, কেমন করিয়া কয় !
যে গাছ ভেঙেছে ঝড়িয়া বাতাসে কেমন করিয়া হায়,
তারি ডালগুলো ভেঙে যাবে তারা কঠোর কুঠার-ঘায় ?

কেউ কেউ বলে, “তাহারি মতন দেখেছিন একজনে,
আমাদের সেই ছোট গাঁয় পথে চলে যেতে আনমনে |”
“আচ্ছা তাহারে সুধাও নি কেহ, কখন আসিবে বাড়ী,
পরদেশে সে যে কোম্ প্রাণে রয় আমার সাজুরে ছাড়ি ?”
গাঙে-পড়া-লোক যেমন করে তৃণটি আঁকড়ি ধরে,
তেমনি করিয়া চেয়ে রয় বুড়ী তাদের মুখের পরে |
মিথ্যা করেই তারা বলে, “সে যে আসিবে ভাদ্র মাসে,
খবর দিয়েছে, বুড়ী যেন আর কাঁদে না তাহার আশে |”
এত যে বেদনা তবু তারি মাঝে একটু আশার কথা,
মুহুর্তে যেন মুছাইয়া দেয় কত বরষের ব্যথা |
মেয়েরে ডাকিয়া বার বার কহে, “ভাবিস না মাগো আর,
বিদেশী চাষীরা কয়ে গেল মোর—খবর পেয়েছে তার |”
মেয়ে শুধু দুটি ভাষা-ভরা আঁখি ফিরাল মায়ের পানে ;
কত ব্যথা তার কমিল ইহাতে সেই তাহা আজ জানে |
গণিতে গণিতে শ্রাবণ কাটিল, আসিল ভাদ্র মাস,
বিরহী নারীর নয়নের জলে ভিজিল বুকের বাস |

আজকে আসিবে কালকে আসিবে, হায় নিদারুণ আশা,
ভোরের পাখির মতন শুধুই ভোরে ছেড়ে যায় বাসা |
আজকে কত না কথা লয়ে যেন বাজিছে বুকের বীনে,
সেই যে প্রথম দেখিল রূপারে বদনা-বিয়ের দিনে |
তারপর সেই হাট-ফেরা পথে তারে দেখিবার তরে,
ছল করে সাজু দাঁড়ায়ে থাকিত গাঁয়ের পথের পরে |
নানা ছুতো ধরি কত উপহার তারে যে দিত আনি,
সেই সব কথা আজ তার মনে করিতেছে কানাকানি |
সারা নদী ভরি জাল ফেলে জেলে যেমনি করিয়া টানে,
কখন উঠায়, কখন নামায়, যত লয় তার প্রাণে ;
তেমনি সে তার অতীতেরে আজি জালে জালে জড়াইয়া টানে,
যদি কোন কথা আজিকার দিনে কয়ে যায় নব-মানে |

আর যেন তার কোন কাজ নাই, অতীত আঁধার গাঙে,
ডুবারুর মত ডুবিয়া ডুবিয়া মানক মুকুতা মাঙে |
এতটুকু মান, এতটুকু স্নেহ, এতটুকু হাসি খেলা,
তারি সাথে সাজু ভাসাইতে চায় কত না সুখের ভেলা !
হায় অভাগিনী ! সে ত নাহি জানে আগে যারা ছিল ফুল,
তারাই আজিকে ভুজঙ্গ হয়ে দহিছে প্রাণের মূল |
যে বাঁশী শুনিয়া ঘুমাইত সাজু, আজি তার কথা স্মরি,
দহন নাগের গলা জড়াইয়া একা জাগে বিভাবরী |

মনে পড়ে আজ সেই শেষ দিনে রূপার বিদায় বাণী—
“মোর কথা যদি মনে পড়ে তবে পরিও সিঁদুরখানি |”
আরও মনে পড়ে, “দীন দুঃখীর যে ছাড়া ভরসা নাই,
সেই আল্লার চরণে আজিকে তোমারে সঁপিয়া যাই |”

হায় হায় পতি, তুমি ত জান না কি নিঠুর তার মন ;
সাজুর বেদনা সকলেই শোনে, শোনে না সে একজন |
গাছের পাতারা ঝড়ে পরে পথে, পশুপাখি কাঁদে বনে,
পাড়া প্রতিবেশী নিতি নিতি এসে কেঁদে যায় তারি সনে |
হায় রে বধির, তোর কানে আজ যায় না সাজুর কথা ;
কোথা গেলে সাজু জুড়াইবে এই বুক ভরা ব্যথা |
হায় হায় পতি, তুমি ত ছাড়িয়া রয়েছ দূরের দেশে,
আমার জীবন কি করে কাটিবে কয়ে যাও কাছে এসে !
দেখে যাও তুমি দেখে যাও পতি তোমার লাই-এর লতা,
পাতাগুলি তার উনিয়া পড়েছে লয়ে কি দারুণ ব্যথা |
হালের খেতেতে মন টিকিত না আধা কাজ ফেলি বাকি,
আমারে দেখিতে বাড়ি যে আসিতে করি কতরূপ ফাঁকি |
সেই মোরে ছেড়ে কি করে কাটাও দীর্ঘ বরষ মাস,
বলিতে বলিতে ব্যথার দহনে থেমে আসে যেন শ্বাস |

নক্সী-কাঁথাটি বিছাইয়া সাজু সারারাত আঁকে ছবি,
ও যেন তাহার গোপন ব্যথার বিরহিয়া এক কবি |
অনেক সুখের দুঃখের স্মৃতি ওরি বুকে আছে লেখা,
তার জীবনের ইতিহাসখানি কহিছে রেখায় রেখা |
এই কাঁথা যবে আরম্ভ করে তখন সে একদিন,
কৃষাণীর ঘরে আদরিনী মেয়ে সারা গায়ে সুখ-চিন |
স্বামী বসে তার বাঁশী বাজায়েছে, সিলাই করেছে সেজে ;
গুন গুন করে গান কভু রাঙা ঠোঁটেতে উঠেছে বেজে |

সেই কাঁথা আজো মেলিয়াছে সাজু যদিও সেদিন নাই,
সোনার স্বপন আজিকে তাহার পুড়িয়া হয়েছে ছাই |

খুব ধরে ধরে আঁকিল যে সাজু রূপার বিদায় ছবি,
খানিক যাইয়া ফিরে ফিরে আসা, আঁকিল সে তার সবি |
আঁকিল কাঁথায়—আলু থালু বেশে চাহিয়া কৃষাণ-নারী,
দেখিছে তাহার স্বামী তারে যায় জনমের মত ছাড়ি |
আঁকিতে আঁকিতে চোখে জল আসে, চাহনি যে যায় ধুয়ে,
বুকে কর হানি, কাঁথার উপরে পড়িল যে সাজু শুয়ে |
এমনি করিয়া বহুদিন যায়, মানুষে যত না সহে,
তার চেয়ে সাজু অসহ্য ব্যথা আপনার বুকে বহে |
তারপর শেষে এমনি হইল, বেদনার ঘায়ে ঘায়ে,
এমন সোনার তনুখানি তার ভাঙিল ঝরিয়া-বায়ে |
কি যে দারুণ রোগেতে ধরিল, উঠিতে পারে না আর ;
শিয়রে বসিয়া দুঃখিনী জননী মুছিল নয়ন-ধার |
হায় অভাগীর একটি মানিক ! খোদা তুমি ফিরে চাও,
এরে যদি নিবে তার আগে তুমি মায়েরে লইয়া যাও !
ফিরে চাও তুমি আল্লা রসুল ! রহমান তব নাম,
দুনিয়ায় আর কহিবে না কেহ তারে যদি হও বাম !

মেয়ে কয়, “মাগো ! তোমার বেদনা আমি সব জানি,
তার চেয়ে যেগো অসহ্য ব্যথা ভাঙে মোর বুকখানি !
সোনা মা আমার ! চক্ষু মুছিয়া কথা শোন, খাও মাথা,
ঘরের মেঝেয় মেলে ধর দেখি আমার নক্সী-কাঁথা !
একটু আমারে ধর দেখি মাগো, সূঁচ সুতা দাও হাতে,
শেষ ছবি খানা এঁকে দেখি যদি কোন সুখ হয় তাতে |”
পাণ্ডুর হাতে সূঁচ লয়ে সাজু আঁকে খুব ধীরে ধীরে,
আঁকিয়া আঁকিয়া আঁখিজল মুছে দেখে কত ফিরে ফিরে |

কাঁথার উপরে আঁকিল যে সাজু তাহার কবরখানি,
তারি কাছে এক গেঁয়ো রাখালের ছবিখানি দিল টানি ;
রাত আন্ধার কবরের পাশে বসি বিরহী বেশে,
অঝোরে বাজায় বাঁশের বাঁশীটি বুক যায় জলে ভেসে |
মনের মতন আঁকি এই ছবি দেখে বার বার করি,
দুটি পোড়া চোখ বারবার শুধু অশ্রুতে উঠে ভরি |
দেখিয়া দেখিয়া ক্লান্ত হইয়া কহিল মায়েরে ডাকি,
“সোনা মা আমার! সত্যিই যদি তোরে দিয়ে যাই ফাঁকি ;
এই কাঁথাখানি বিছাইয়া দিও আমার কবর পরে,
ভোরের শিশির কাঁদিয়া কাঁদিয়া এরি বুকে যাবে ঝরে !
সে যদি গো আর ফিরে আসে কভু, তার নয়নের জল,
জানি জানি মোর কবরের মাটি ভিজাইবে অবিরল |
হয়ত আমার কবরের ঘুম ভেঙে যাবে মাগো তাতে,
হয়ত তাহারে কাঁদাইতে আমি জাগিব অনেক রাতে |
এ ব্যথা সে মাগো কেমনে সহিবে, বোলো তারে ভালো করে,
তার আঁখি জল ফেলে যেন এই নক্সী-কাঁথার পরে |
মোর যত ব্যথা, মোর যত কাঁদা এরি বুকে লিখে যাই,
আমি গেলে মোর কবরের গায়ে এরে মেলে দিও তাই !
মোর ব্যথা সাথে তার ব্যথাখানি দেখে যেন মিল করে,
জনমের মত সব কাঁদা আমি লিখে গেনু কাঁথা ভরে |”
বলিতে বলিতে আর যে পারে না, জড়াইয়া আসে কথা,
অচেতন হয়ে পড়িল যে সাজু লয়ে কি দারুণ ব্যথা |

কানের কাছেতে মুখ লয়ে মাতা ডাক ছাড়ি কেঁদে কয়,
“সাজু সাজু ! তুই মোরে ছেড়ে যাবি এই তোর মনে লয় ?”
“আল্লা রসুল ! আল্লা রসুল !” বুড়ী বলে হাত তুলে,
“দীন দুঃখীর শেষ কান্না এ, আজিকে যেয়ো না ভুলে !”
দুই হাতে বুড়ী জড়াইতে চায় আঁধার রাতের কালি,
উতলা বাতাস ধীরে ধীরে বয়ে যায়, সব খালি ! সব খালি !!
“সোনা সাজুরে, মুখ তুলে চাও, বলে যাও আজ মোরে,
তোমারে ছাড়িয়া কি করে যে দিন কাটিবে একেলা ঘরে !”

দুখিনী মায়ের কান্নায় আজি খোদার আরশ কাঁপে,
রাতের আঁধার জড়াজড়ি করে উতল হাওয়ার দাপে |

******************
জালুয়া = জেলে

নকশী কাঁথার মাঠ – ১২

জসীমউদদীন

বার

রাইত তুই যা রে পোহাইয়ে |
বেলা গে ল সন্ধ্যা হৈল—ও হৈলরে! গৃহে জ্বালাও বাতি,
না জানি অবলার বন্ধু আসবেন কত রাতিরে!
রাইত তুই—যা পোহাইয়ে
রাইত না এক পরের হৈল, ও হৈলরে! তারায় জ্বলে বাতি ;
রান্ধিয়া বাড়িয়া অন্ন জাগ্ ব কত রাতিরে ;
রাইত তুই যারে—যা পোহাইয়ে |
রাইত না দুই পরের হৈল ও হৈলরে, ডালে ডাকে শুয়া
অঞ্চল বিছায়া নারী কাটে চেকন গুয়ারে |
রাইত তুই যারে—যা পোহাইয়ে |
রাইত না প্রভাত হৈল—ও হৈলরে, কোকিল করে কুয়া,
খুইলে দাও মন্দিরার কেওয়াড় লাগুক শিতল হাওয়ারে |
রাইত তুই যারে—যা পোহাইয়ে |
                     -রাখালী গান

রূপাই গিয়াছে ‘কাইজা’ করিতে সেই ত সকাল বেলা,
বউ সারাদিন পথ পানে চেয়ে, দেখেছে লোকার মেলা |
কত লোক আসে কত লোক যায়, সে কেন আসে না আজ,
তবে কি তাহার নসিব মন্দ, মাথায় ভাঙিবে বাজ!
বালাই, বালাই, ওই যে ওখানে কালো গাঁর পথ দিয়া,
আসিছে লোকটি, ওই কি রূপাই ? নেচে ওঠে তার হিয়া |
এলে পরে তারে খুব বকে দিবে, মাথায় ছোঁয়াবে হাত,
কিরা করাইবে লড়ায়ের নামে হবে না সে আর মাৎ |

আঁচলে চোখেরে বার বার মাজে, নারে না সে ত ও নয়,
আজকে তাহার কপালে কি আছে, কে তাহা ভাঙিয়া কয় |
লোহুর সাগরে সাতার কাটিয়া দিবস শেষের বেলা,
রাত্র-রাণীর কালো আঁচলেতে মুছিল দিনের খেলা |
পথে যে আঁধার পড়িল সাজুর মনে তার শত গুণ,
রাত এসে তা ব্যথার ঘায়েতে ছিটাইল যেন নুন!

ঘরের মেঝেতে সপটি ফেলায়ে বিছায়ে নক্সী-কাঁথা,
সেলাই করিতে বসিল যে সাজু একটু নোয়ায়ে মাথা |
পাতায় পাতায় খস্ খস্ খস্, শুনে কান খাড়া করে,
যারে চায় সে ত আসেনাক শুধু ভুল করে করে মরে |
তবু যদি পাতা খানিক না নড়ে, ভাল লাগেনাক তার ;
আলো হাতে লয়ে দূর পানে চায়, বার বার খুলে দ্বার |
কেন আসে নারে! সাজুর যদি গো পাখা আজ বিধি,
উড়িয়া যাইয়া দেখিয়া আসিত তাহার সোনার নিধি |
নক্সী-কাঁথায় আঁকিল যে সাজু অনেক নক্সী-ফুল,
প্রথমে যেদিন রূপারে সে দেখে, সে খুশির সমতুল |
আঁকিল তাদের বিয়ের বাসর, আঁকিল রূপার বাড়ি,
এমন সময় বাহিরে কে দেখে আসিতেছে তাড়াতাড়ি |

দুয়ার খুলিয়া দেখিল সে চেয়ে—রূপাই আসিছে বটে,
”এতক্ষণে এলে ? ভেবে ভেবে যেগো প্রাণ নাই মোর ঘটে |
আর জাইও না কাইজা করিতে, তুমি যাহাদের মারো,
তাদের ঘরে ত আছে কাঁচা বউ, ছেলেমেয়ে আছে কারো |”
রূপাই কহিল কাঁদিয়া, “বউগো ফুরায়েছে মোর সব,
রাতে ঘুম যেতে শুনিবে না আর রূপার বাঁশীর রব |
লড়ায়ে আজিকে কত মাথা আমি ভাঙিয়াছি দুই হাতে,
আগে বুঝি নাই তোমারো মাথার সিঁদুর ভেঙেছে তাতে |
লোহু লয়ে আজ সিনান করেছি, রক্তে ভেসেছে নদী,
বুকের মালা যে ভেসে যাবে তাতে আগে জানিতাম যদি!
আঁচলের সোনা খসে যাবে পথে আগে যদি জানতাম,
হায় হায় সখি, নারিনু বলিতে কি যে তবে করিতাম !”

বউ কেঁদে কয়, “কি হয়েছে বল, লাগিয়াছে বুঝি কোথা,
দেখি ! দেখি !! দেখি !!! কোথায় আঘাত, খুব বুঝু তার ব্যথা !”
“লাগিয়াছে বউ, খুব লাগিয়াছে, নহে নহে মোর গায়,
তোমার শাড়ীর আঁচল ছিঁড়েছে, কাঁকন ভেঙেছে হায়!
তোমার পায়ের ভাঙিয়াছে খাড়ু ছিঁড়েছে গলার হার,
তোমার আমার এই শেষ দেখা, বাঁশী বাজিবে না আর |
আজ ‘কাইজায়’ অপর পক্ষে খুন হইয়াছে বহু |
এই দেখ মোর কাপড়ে এখনো লাগিয়া রহিছে লহু |
থানার পুলিশ আসিছে হাঁকিয়া পিছে পিছে মোর ছুটি,
খোঁজ পেলে পরে এখনি আমার ধরে নিয়ে যাবে টুঁটি |
সাথীরা সকলে যে যাহার মত পালায়েছে যথা-তথা,
আমি আসিলাম তোমার সঙ্গে সেরে নিতে সব কথা |
আমার জন্য ভাবিনাক আমি, কঠিন ঝড়িয়া-বায়,
যে গাছ পড়িল, তাহার লতার কি হইবে আজি হায়!
হায় বনফুল, যেই ডালে তুই দিয়েছিলি পাতি বুক,
সে ডালেরি সাথে ভাঙিয়া পড়িল তোর সে সকল সুখ |
ঘরে যদি মোর মা থাকিত আজ তোমারে সঙ্গে করি,
বিনিদ্র রাত কাঁদিয়া কাটাত মোর কথা স্মরি স্মরি!

ভাই থাকিলেও ভাইয়ের বউরে রাখিত যতন করি,
তোমার ব্যথার আধেকটা তার আপনার বুকে ভরি |
আমি যে যাইব ভাবিনাক, সাথে যাইবে কপাল-লেখা,
এযে বড় ব্যথা! তোমারো কপালে এঁকে গেনু তারি রেখা!”
সাজু কেঁদে কয়, “সোনার পতিরে তুমি যে যাইবে ছাড়ি,
হয়ত তাহাতে মোর বুকখানা যাইতে চাহিবে ফাড়ি |
সে দুখেরে আমি ঢাকিয়া রাখিব বুকের আঁচল দিয়া,
এ পোড়া রূপেরে কি দিয়া ঢাকিব—ভেবে মরে মোর হিয়া |
তুমি চলে গেলে পাড়ার লোকে যে চাহিবে ইহার পানে,
তোমার গলার মালাখানি আমি লুকাইব কোন্ খানে!”

রূপা কয়, “সখি দীন দুঃখীর যারে ছাড়া কেহ নাই,
সেই আল্লার হাতে আজি আমি তোমারে সঁপিয়া যাই |
মাকড়ের আঁশে হস্তী যে বাঁধে, পাথর ভাসায় জলে,
তোমারে আজিকে সঁপিয়া গেলাম তাঁহার চরণ তলে |”

এমন সময় ঘরের খোপেতে মোরগ উঠিল ডাকি,
রূপা কয়, “সখি! যাই—যাই আমি—রাত বুঝি নাই বাকি!”
পায়ে পায়ে পায়ে কতদূর যায় ; সাজু কয়, “ ওগো শোন,
আর কি গো নাই মোর কাছে তব বলিবার কথা কোন ?
দীঘল রজনী—দীঘল বরষ—দীঘল ব্যথার ভার,
আজ শেষ দিনে আর কোন কথা নাই তব বলিবার ?”
রূপা ফিরে কয়, “না কাঁদিয়া সখি, পারিলামনাক আর,
ক্ষমা কর মোর চোখের জলের নিশাল দেয়ার ধার |”

“এই শেষ কথা!” সাজু কহে কেঁদে, “বলিবে না আর কিছু ?”
খানিক চলিয়া থামিল রূপাই, কহিল চাহিয়া পিছু,
“মোর কথা যদি মনে পড়ে সখি, যদি কোন ব্যথা লাগে,
দুটি কালো চোখ সাজাইয়া নিও কাল কাজলের রাগে |
সিন্দুরখানি পরিও ললাটে—মোরে যদি পড়ে মনে,
রাঙা শাড়ীখানি পরিয়া সজনি চাহিও আরশী-কোণে |
মোর কথা যদি মনে পড়ে সখি, যতনে বাঁধিও চুল,
আলসে হেলিয়া খোপায় বাঁধিও মাঠের কলমী ফুল |
যদি একা রাতে ঘুম নাহি আসে—না শুনি আমার বাঁশী,
বাহুখানি তুমি এলাইও সখি মুখে মেখে রাঙা হাসি |
চেয়ো মাঠ পানে—গলায় গলায় দুলিবে নতুন ধান ;
কান পেতে থেকো, যদি শোনো কভু সেখায় আমার গান |
আর যদি সখি, মোরে ভালবাস মোর তরে লাগে মায়া,
মোর তরে কেঁদে ক্ষয় করিও না অমন সোনার কায়া!”

ঘরের খোপেতে মোরগ ডাকিল, কোকিল ডাকিল ডালে,
দিনের তরণী পূর্ব-সাগরে দুলে উঠে রাঙা পালে |
রূপা কহে, “তবে যাই যাই সখি, যেটুকু আধার বাকি,
তারি মাঝে আমি গহন বনেতে নিজেরে ফেলিব ঢাকি |”
পায়ে পায়ে পায়ে কতদূর যায়, তবু ফিরে ফিরে চায় ;
সাজুর ঘরেতে দীপ নিবু নিবু ভোরের উতল বায় |

. ******************
নিশাল = অবিরাম

নকশী কাঁথার মাঠ – ১১

জসীমউদদীন

এগার

সাজ সাজ বলিয়ারে শহরে পৈল সাড়া,
সাত হাজার বাজে ঢোল চৌদ্দ হাজার কাড়া |
প্রথমে সাজিল মর্দ আহ্লাদি ডগরি,
পাঁচ কাঠে ভুঁই জুইড়া বসে মর্দ এয়সা ভারি |
তারপরে সাজিল মর্দ তুরক আমানি,
সমুদ্দুরে নামলে তার হৈল আঁটুপানি |
তারপরে সাজিল মর্দ নামে লোহাজুড়ী,
আছড়াইয়া মারত সে হাতীর শুঁড় ধরি |
তারপরে নামিল মর্দ নামে আইন্দ্যা ছাইন্দ্যা,
বাইশ মণ তামাক নেয় তার লেংটির মধ্যে বাইন্ধ্যা |
তারপরে সাজিল মর্দ নামে মদন ঢুলি,
বাইশ মণ পিতল তার ঢোলের চারটা খুলী |
আতালী পাতালী সাজে গগনেরি ঠাটা,
মেঘনাল সাজিয়া আইল তাম তুরুকের বেটা |
তুগুলি মুগুলি সাজে তারা দুই ভাই,
ঐরাবতে সাইজা আইল আজদাহা সেপাই |
বন্দুকি বন্দুকি চলে কামানে কামান,
ময়ূর ময়ুরী চলে ধরিয়া পয়গাম |
                  -মহরমের জারী

“ও রূপা তুই করিস কিরে? এখনো তুই রইলি শুয়ে?
বন-গেঁয়োরা ধান কেটে নেয় গাজনা-চরের খামার ভূঁয়ে |”

নকশী কাঁথার মাঠ – ১০

জসীমউদদীন

দশ

বড় ঘর বান্দাছাও মোনাভাই বড় করছাও আশা
রজনী প্রভাতের কালে পঙ্খী ছাড়বে বাসা |
                                  -মুর্শীদা গান

নতুন চাষা ও নতুন চাষাণী পাতিল নতুন ঘর,
বাবুই পাখিরা নীড় বাঁধে যথা তালের গাছের পর |
মাঠের কাজেতে ব্যস্ত রূপাই, নয়া বউ গেহ কাজে,
দুইখান হতে দুটি সুর যেন এ উহারে ডেকে বাজে |
ঘর চেয়ে থাকে কেন মাঠ পানে, মাঠ কেন ঘর পানে,
দুইখানে রহি দুইজন আজি বুঝিছে ইহার মানে |

আশ্বিন গেল, কার্তিক মাসে পাকিল খেতের ধান,
সারা মাঠ ভরি গাহিতেছে কে যেন হল্ দি-কোটার গান |
ধানে ধান লাগি বাজিছে বাজনা, গন্ধ উড়িছে বায়,
কলমীলতায় দোলন লেগেছে, হেসে কূল নাহি পায় |
আজো এই গাঁও অঝোরে চাহিয়া ওই গাঁওটির পানে,
মাঝে মাঠখানি চাদর বিছায়ে হলুদ বরণ ধানে |

আজকে রূপার বড় কাজ—কাজ—কোন অবসর নাই,
মাঠে যেই ধান ধরেনাক আজি ঘরে দেবে তারে ঠাঁই |
সারা মাঠে ধান, পথে ঘাটে ধান উঠানেতে ছড়াছড়ি,
সারা গাঁও ভরি চলেছে কে কবি ধানের কাব্য পড়ি |

আজকে রূপার মনে পড়েনাক শাপলার লতা দিয়ে,
নয়া গৃহিনীর খোঁপা বেঁধে দিত চুলগুলি তার নিয়ে |
সিঁদুর লইয়া মান হয়নাক বাজে না বাঁশের বাঁশী,
শুধু কাজ—কাজ, কি যাদু-মন্ত্র ধানেরা পড়িছে আসি |

সারাটি বরষা কে কবি বসিয়া বেঁধেছে ধানের গান,
কত সুদীর্ঘ দিবস রজনী করিয়া সে অবসান |
আজকে তাহার মাঠের কাব্য হইয়াছে বুঝি সারা,
ছুটে গেঁয়ো পাখি ফিঙে বুলবুল তারি গানে হয়ে হারা |

কৃষাণীর গায়ে গহনা পরায় নতুন ধানের কুটো ;
এত কাজ তবু হাসি ধরেনাক, মুখে ফুল ফুটো ফুটো!
আজকে তাহার পাড়া-বেড়ানর অবসর মোটে নাই,
পার খাড়ুগাছি কোথা পড়ে আছে, কেবা খোঁজ রাখে ছাই!

অর্ধেক রাত উঠোনেতে হয় ধানের মলন মলা,
বনের পশুরা মানুষের কাজে মিশায় গলায় গলা |
দাবায় শুইয়া কৃষাণ ঘুমায়, কৃষাণীর কাজ ভারি,
ঢেকির পারেতে মুখর করিছে একেলা সারাটি বাড়ি |
কোন দিন চাষী শুইয়া শুইয়া গাহে বিরহের গান,
কৃষাণের নারী ঘুমাইয়া পড়ে, ঝাড়িতে ঝাড়িতে ধান |
হেমন্ত চাঁদ অর্ধেক হেলি জ্যোত্স্নার জাল পাতি,
টেনে টেনে তারে হয়রান হয়ে ডুবে যায় রাতারাতি |

এমনি করিয়া ধানের কাব্য হইয়া আসিল সারা,
গানের কাব্য আরম্ভ হল সারাটা কৃষাণ পাড়া!
রাতেরে উহারা মানিবে না যেন, নতুন গলার গানে,
বাঁশী বাজাইয়া আজকে রাতের করিবে নতুন মানে |

আজিকে রূপার কোন কাজ নাই, ঘুম হতে যেন জাগি,
শিয়রে দেখিছে রাজার কুমারী তাহারই ব্যথার ভাগী |

সাজুও দেখিছে কোথাকার যেন রাজার কুমার আজি,
ঘুম হতে তারে সবে জাগায়েছে অরুণ-আলোয় সাজি |

নতুন করিয়া আজকে উহারা চাহিছে এ ওর পানে,
দীর্ঘ কাজের অবসর যেন কহিছে নতুন মানে!
নতুন চাষার নতুন চাষাণী নতুন বেঁধেছে ঘর,
সোহাগে আদরে দুটি প্রাণ যেন করিতেছে নড়নড়!
বাঁশের বাঁশীতে ঘুণ ধরেছিল, এতদিন পরে আজ,
তেলে জলে আর আদরে তাহার হইল নতুন সাজ |
সন্ধ্যার পরে দাবায় বসিয়া রূপাই বাজায় বাঁশী,
মহাশূণ্যের পথে সে ভাসায় শূণ্যের সুররাশি!
ক্রমে রাত বাড়ে, বউ বসে দূরে, দুটি চোখ ঘুমে ভার,
“পায়ে পড়ি ওগো চলো শুতে যাই, ভাল লাগে নাক আর |”
রূপা ত সে কথা শোনেই নি যেন, বাঁশী বাজে সুরে সুরে,
“ঘরে দেখে যারে সেই যেন আজি ফেরে ওই দূরে দূরে |”
বউ রাগ করে, “দেখ, বলে রাখি, ভাল হবেনাক পরে,
কালকের মত কর যদি তবে দেখিও মজাটি করে |
ওমনি করিয়া সারারাত আজি বাজাইবে যদি বাঁশী,
সিঁদুর আজিকে পরিব না ভালে, কাজল হইবে বাসি |
দেখ, কথা শোন, নইলে এখনি খুলিব কানের দুল,
আজকে ত আমি খোঁপা বাঁধিব না, আলগা রহিবে চুল |”
বেচারী রূপাই বাঁশী বাজাইতে এমনি অত্যাচার,
কৃষাণের ছেলে! অত কিবা বোঝে, তখনই মানিল হার |

কহে জোড় করে, “শোন গো হুজুর, অধম বাঁশীর প্রতি,
মৌন থাকার কঠোর দণ্ড অন্যায় এ যে অতি |
আজকে ও-ভালে সিঁদুর দিবে না, খুলিবে কানের দুল,
সন্ধ্যে হবে না সিঁদুরে রঙের—ভোরে হাসিবে না ফুল!
এক বড় কথা! আচ্ছা দেখাই, ওরে ও অধম বাঁশী,
এই তরুণীর অধরের গানে তোমার হইবে ফাঁসী!”
হাতে লয়ে বাঁশী বাজাইল রূপা মাঠের চিকন সুরে,
কভু দোলাইয়া বউটির ঠোঁটে কভু তারে ঘুরে ঘুরে |
বউটি যেন গো হেসে হয়রান, কহে ঠোঁটে ঠোঁট চাপি,
“বাঁশীর দণ্ড হইল, কিন্তু যে বাজাল সে পাপী?”
পুনঃ জোর করে রূপা কহে, “এই অধমের অপরাধ,
ভয়ানক যদি, দণ্ড তাহার কিছু কম নিতে সাধ!”
রূপার বলার এমনি ভঙ্গী বউ হেসে কুটি কুটি,
কখনও পড়িছে মাটিতে ঢলিয়া, কভু গায়ে পড়ে লুটি |
পরে কহে, “দেখো, আরও কাছে এসো, বাঁশীটি লও তো হাতে,
এমনি করিয়া দোলাও ত দেখি নোলক দোলার সাথে!”

বাঁশী বাজে আর নোলক যে দোলে, বউ কহে আর বার,
“আচ্ছা আমার বাহুটি নাকিগো সোনালী লতার হার?
এই ঘুরালেম, বাজাও ত দেখি এরি মত কোন সুর,”
তেমনি বাহুর পরশের মত বাজে বাঁশী সুমধুর!
দুটি করে রাঙা ঠোঁটখানি টেনে কহে বউ, “এরি মত,
তোমার বাঁশীতে সুর যদি থাকে বাজাইলে বেশ হত |”
চলে মেঠো বাঁশী দুটি ঠোঁট ছুঁয়ে কলমী ফুলের বুকে,
ছোট চুমু রাখি চলে যেন বাঁশী, চলে সে যে কোন লোকে

এমনি করিয়া রাত কেটে যায় ; হাসে রবি ধীরি ধীরি,
বেড়ার ফাঁকেতে উঁকি মেরে দেখি দুটি খেয়ালীর ছিরি |
সেদিন রাত্রে বাঁশী শুনে শুনে বউটি ঘুমায়ে পড়ে,
তারি রাঙা মুখে বাঁশী-সুরে রূপা বাঁকা চাঁদ এনে ধরে |
তারপরে খুলে চুলের বেণীটি বার বার করে দেখে,
বাহুখানি দেখে নাড়িয়া নাড়িয়া বুকের কাছেতে রেখে |
কুসুম-ফুলেতে রাঙা পাও দুটি দেখে আরো রাঙা করি,
মৃদু তালে তালে নিঃশ্বাস লয়, শুনে মুখে মুখ ধরি |
ভাবে রূপা, ও-যে দেহ ভরি যেন এনেছে ভোরের ফুল,
রোদ উঠিলেই শুকাইয়া যাবে, শুধু নিমিষের ভুল!
হায় রূপা, তুই চোখের কাজলে আঁকিলি মোহন ছবি,
এতটুকু ব্যথা না লাগিতে যেরে ধুয়ে যাবে তোর সবি!

ওই বাহু আর ওই তনু-লতা ভাসিছে সোঁতের ফুল,
সোঁতে সোঁতে ও যে ভাসিয়া যাইবে ভাঙিয়া রূপার কূল!
বাঁশী লয়ে রূপা বাজাতে বসিল বড় ব্যথা তার মনে,
উদাসীয়া সুর মাথা কুটে মরে তাহার ব্যথার সনে |

ধারায় ধারায় জল ছুটে যায় রূপার দুচোখ বেয়ে,
বইটি তখন জাগিয়া উঠিল তাহার পরশ পেয়ে |
“ওমা ওকি? তুমি এখনো শোওনি! খোলা কেন মোর চুল?
একি! দুই পায়ে কে দেছে ঘষিয়া রঙিন কুসুম ফুল?
ওকি! ওকি!! তুমি কাঁদছিলে বুঝি! কেন কাঁদছিলে বল?”
বলিতে বলিতে বউটির চোখ জলে করে ছল ছল!
বাহুখানা তার কাঁধ পরে রাখি রূপা কয় মৃদু সুরে,
“শোন শোন সই, কে যেন তোমায় নিয়ে যেতে চায় দূরে!”

“সে দূর কোথায়?” “অনেক—অনেক—দেশ যেতে হয় ছেড়ে,
সেথা কেউ নাই শুধু আমি তুমি আর সেই সে অচেনা ফেরে |
তুমি ঘুমাইলে সে এসে আমায় কয়ে যায় কানে কানে,
যাই—যাই—ওরে নিয়ে যাই আমি আমার দেশের পানে
বল, তুমি সেথা কখনও যাবে না, সত্যি করিয়া বল!”
“নয়! নয়! নয়!” বউ কহে তার চোখ দুটি ছল ছল |

রূপা কয় “শোন সোনার বরণি, আমার এ কুঁড়ে ঘর,
তোমার রূপের উপহাস শুধু করে সারা দিনভর |
তুমি ফুল! তব ফুলের গায়েতে বহে বিহানের বায়ু,
আমি কাঁদি সই রোদ উঠিলে যে ফুরাবে রঙের আয়ু |
আহা আহা সখি, তুমি যাহা কর, মোর মনে লয় তাই,
তোমার ফুলের পরাণে কেবল দিয়া যায় বেদনাই |”
এমন সময় বাহির হইতে বছির মামুর ডাকে,
ধড়মড় করি উঠিয়া রূপাই চাহিল বেড়ার ফাঁকে |

নকশী কাঁথার মাঠ – ০৯

জসীমউদদীন

নয়

মত্স চেনে গহিন গম্ভ পঙ্খী চেনে ডাল ;
মায় সে জানে বিটার দরদ যার কলিজার শ্যাল!
নানান বরণ গাভীরে ভাই একই বরণ দুধ ;
জগৎ ভরমিয়া দেখলাম একই মায়ের পুত |
                                   -গাজীর গান

আষাঢ় মাসে রূপীর মায়ে মরল বিকার জ্বরে,
রূপা সাজু খায়নি খানা সাত আট দিন ধরে |
লালন পালন যে করিত “ঠোঁটের” আধার দিয়া,
সেই মা আজি মরে রূপার ভাঙল সুখের হিয়া |
ঘামলে পরে যে তাহারে করত আবের পাখা ;
সেই শাশুড়ী মরে, সাজুর সব হইল ফাঁকা |
সাজু রূপা দুই জনেতে কান্দে গলাগলি ;
গাছের পাতা যায় যে ঝরে, ফুলের ভাঙে কলি |
এত দুখের দিনও তাদের আস্তে হল গত,
আবার তারা সুখেরি ঘর বাঁধল মনের মত |

নকশী কাঁথার মাঠ – ০৮

জসীমউদদীন

আট

“কি কর দুল্যাপের মালো ; বিভাবনায় বসিয়া,
আসত্যাছে বেটির দামান ফুল পাগড়ি উড়ায়া নারে |”
“আসুক আসুক বেটির দামান কিছু চিন্তা নাইরে,
আমার দরজায় বিছায়া থুইছি কামরাঙা পাটি মারে |
সেই ঘরেতে নাগায়া খুইছি মোমের সস্র বাতি,
বাইর বাড়ি বান্দিয়া থুইছি গজমতি হাতি নারে |”
              -মুসলমান মেয়েদের বিবাহের গান

বিয়ের কুটুম এসেছে আজ সাজুর মায়ের বাড়ি,
কাছারী ঘর গুম্-গুমা-গুম্ , লোক হয়েছে ভারি |

নকশী কাঁথার মাঠ – ০৭

জসীমউদদীন

সাত

“ঘটক চলিল চলিল সূর্য সিংহের বাড়িরে” |
                  -আসমান সিংহের গান

কান্-কানা-কান্ ছুটল কথা গুন্-গুনা-গুন তানে,
শোন্-শোনা-শোন সবাই শোনে, কিন্তু কানে কানে |
“কি করগো রূপার মাতা? খাইছ কানের মাথা?
ও-দিক যে তোর রূপার নামে রটছে গাঁয়ে যা তা!
আমরা বলি রূপাই এমন সোনার কলি ছেলে,
তার নামে হয় এমন কথা দেখব কি কাল গেলে?”
এই বলিয়া বড়াই বুড়ি বসল বেড়ি দোর,
রূপার মা কয়, “বুঝিনে বোন কি তোর কথার ঘোর!”
বুড়ি যেন আচমকা হায় আকাশ হতে পড়ে,
“সবাই জানে তুই না জানিস যে কথা তোর ঘরে?”
ও-পাড়ার ও ডাগর ছুঁড়ী, সেখের বাড়ির “সাজু”
তারে নাকি তোর ছেলে সে গড়িয়ে দেছে বাজু |
ঢাকাই শাড়ী কিন্যা দিছে, হাঁসলী দিছে নাকি,
এত করে এখন কেন শাদীর রাখিস বাকি?”
রূপার মা কয়, “রূপা আমার এক-রত্তি ছেলে,
আজও তাহার মুখ শুঁকিলে দুধের ঘিরাণ মেলে |
তার নামে যে এমন কথা রটায় গাঁয়ে গাঁয়ে,
সে যেন তার বেটার মাথা চিবায় বাড়ি যায় |”

রূপার মায়ের রুঠা কথায় উঠল বুড়ীর কাশ,
একটু দিলে তামাক পাতা, নিলেন বুড়ী শ্বাস |
এমন সময় ওই গাঁ হতে আসল খেঁদির মাতা,
টুনির ফুপু আসল হাতে ডলতে তামাক পাতা |
ক’জনকে আর থামিয়ে রাখে? বুঝল রূপার মা ;
রূপা তাহার সত্যি করেই এতটুকুন না |
বুঝল মায়ে কেন ছেলে এমন উদাস পারা,
হেথায় হোথায় কেবল ঘোরে হয়ে আপন হারা |
ও পাড়ার ও দুখাই মিয়া ঘটকালিতে পাকা,
সাজুর সাথেই জুড়ুর বিয়ে যতকে লাগুক টাকা |

শেখ বাড়িতে যেয়ে ঘটক বেকী-বেড়ার কাছে,
দাঁড়িয়ে বলে, “সাজুর মাগো, একটু কথা আছে |”
সাজুর মায়ে বসতে তারে এনে দিলেন পিঁড়ে,
ডাব্বা হুঁকা লাগিয়ে বলে, “আস্তে টান ধীরে |”
ঘটক বলে, “সাজুর মাগো মেয়ে তোমার বড়,
বিয়ের বয়স হল এখন ভাবনা কিছু কর |”
সাজুর মা কয় “তোমরা আছ ময়-মুরুব্বি ভাই,
মেয়ে মানুষ অত শত বুঝি কি আর ছাই!
তোমরা যা কও ঠেলতে কি আর সাধ্য আছে মোর?”
ঘটক বলে, “এই ত কথা, লাগবে না আর ঘোর |
ও-পাড়ার ও রূপারে ত চেনই তুমি বোন্,
তার সাথে দাও মেয়ের বিয়ে ঠিক করিয়ে মন |”
সাজুর মা কয়, “জান ত ভাই! রটছে গাঁয়ে যাতা,
রূপার সাথে বিয়ে দিলে থাকবে না আর মাথা |”

ঘটক বলে, “কাঁটা দিয়েই তুলতে হবে কাঁটা,
নিন্দা যারা করে তাদের পড়বে মুখে ঝাঁটা |
রূপা ত আর নয় এ গাঁয়ে যেমন তেমন ছেলে,
লক্ষ্মীরে দেই বউ বানায়ে অমন জামাই পেলে!”
ঠাটে ঘটক কয় গো কথা ঠোঁট-ভরাভর হাসে ;
সাজুর মায়ের পরাণ তারি জোয়ার-জলে ভাসে |
“দশ খান্দা জমি রূপার, তিনটি গরু হালে,
ধানের-বেড়ী ঠেকে তাহার বড় ঘরের চালে |”
সাজু তোমার মেয়ে যেমন, রূপাও ছেলে তেমন,
সাত গেরামের ঘটক আমি জোড় দেখিনি এমন |”

তার পরেতে পাড়ল ঘটক রূপার কুলের কথা,
রূপার দাদার নাম গুনে লোক কাঁপত যথা তথা |
রূপার নানা সোয়েদ-ঘেঁষা, মিঞাই বলা যায়—
কাজী বাড়ির প্যায়দা ছিল কাজল-তলার গাঁয় |
রূপার বাপের রাখত খাতির গাঁয়ের চৌকিদারে,
আসেন বসেন মুখের কথা—গান বজিত তারে |
রূপার চাচা অছিমদ্দী, নাম শোন নি তার?
ইংরেজী তার বোল শুনিলে সব মানিত হার |
কথা ঘটক বলল এঁটে, বলল কখন ঢিলে,
সাজুর মায়ে সবগুলি তার ফেলল যেন গিলে |

মুখ দেখে বুঝল ঘটক—লাগছে অষুধ হাড়ে,
বলল, “তোমার সাজুর বিয়া ঠিক কর এই বারে |”
সাজুর মা কয়, ” যা বোঝ ভাই, তোমরা গ্যা তাই কর,
দেখ যেন কথার আবার হয় না নড়চড় |”

“আউ ছি ছি!” ঘটক বলে, “শোনই কথা বোন,
তোমার সাজুর বিয়া দিতে লাগবে কত পণ?
পোণে দিব কুড়ি দেড়েক বায়না দেব তেরো,
চিনি সন্দেশ আগোড়-বাগোড় এই গে ধর বারো |
সবদ্যা হল দুই কুড়ি এ নিতেই হবে বোন,
চাইলে বেশী জামাইর তোমার বেজার হবে মন!”
সাজুর মা কয়, “ও-সব কথার কি-ইবা আমি জানি,
তোমরা যা কও তাইত খোদার গুকুর বলে মানি |”
সাধে বলে দুখাই ঘটক ঘটকালিতে পাকা,
আদ্য মধ্য বিয়ের কথা সব করিল ফাঁকা |

চল্-চলা-চল্ চলল দুখাই পথ বরাবর ধরি,
তাগ্-ধিনা-ধিন্ নাচে যেন গুন্ গুনা গান করি |
দুখাই ঘটক নেচে চলে নাচে তাহার দাড়ি,
বুড়োর বটের শিকড় যেন চলছে নাড়ি নাড়ি ;
লম্ফে লম্ফে চলে ঘটক দম্ভ করে চায়,
লুটের মহল দখল করে চলছে যেন গাঁয়!
ঘটকালিরই টাকা যেন ঝন্-ঝনা-ঝন্ বাজে,
হন্-হানা-হন্ চলল ঘটক একলা পথের মাঝে |
ধানের জমি বাঁয় ফেলিয়া ফেলিয়া, ডাইনে ঘন পাট,
জলীর বিলে নাও বাঁধিয়া ধরল গাঁয়ের বাট |
“কি কর গো রূপার মাতা, ভবছ বসি কিবা,
সাজুর সাথেই ঠিক কইরাছি তোমার ছেলের বিবা |
সহজে কি হয় সে রাজি, একশ টাকা পণ,
এর কমেতে বসেইনাক সাজুর মায়ের মন |

আমিও আবার কুড়ি তিনেক উঠিনে তার পরে,
সাজুর মায়ও নাছোড়-বান্দা, দিলাম তখন ধরে ;
আরেক কুড়ি, তয় সে কথা কইল হাসি হাসি,
আমি ভাবি, বিয়ার বুঝি বাজল সানাই বাঁশী |
এখন বলি রূপার মাতা, আড়াই কুড়ি টাকা,
মোর কাছেতে দিবা, কথা হয় না যেন ফাঁকা!
আসব দিয়ে গোপনে তায়, নইলে গাঁয়ের লোকে,
মেজবানী দাও বলে তারে ধরবে চীনে জোঁকে |
বিয়ের দিনে নিবে সে তাই তিরিশ টাকা যেচে,
যারে তারে বলতে পার এই কথাটি নেচে |
চিনি সন্দেশ আগোড়-বাগোড় তার লাগিবে ষোলো,
এই ধরগ্যা রূপার বিয়া আজই যেন হল |”

রূপার মায়ের আহ্লাদে প্রাণ ধরেইনাক আর,
ইচ্ছে করে নেচে নেচে বেড়ায় বারে বার |
“ও রূপা তুই কোথায় গেলি? ভাবিসনাক মোটে,
কপাল গুণি বিয়ে যে তোর সাজুর সাথেই জোটে!”
এই বলিয়া রূপার মাতা ছুটল গাঁয়ের পানে,
ঘটক গেল নিজের বাড়ি গুন্-গুনা-গুন্ গানে |

*****
ফুপু = পিসী, বাপের বোন;দাদা = ঠাকুরদাদা
সবদ্যা = সব দিয়া;বিবা = বিবাহ
তয় = তবে
মেজবানী = নিমন্ত্রণ দেওয়া

নকশী কাঁথার মাঠ – ০৬


জসীমউদদীন

ছয়

ও তুই ঘরে রইতে দিলি না আমারে |
                            -রাখালী গান

ঘরেতে রূপার মন টেকে না যে, তরলা বাঁশীর পারা,
কোন বাতাসেতে ভেসে যেতে চায় হইয়া আপন হারা |
কে যেন তার মনের তরীরে ভাটির করুণ তানে,
ভাটিয়াল সোঁতে ভাসাইয়া নেয় কোন্ সে ভাটার পানে |
সেই চিরকেলে গান আজও গাহে, সুরখানি তার ধরি,
বিগানা গাঁয়ের বিরহিয়া মেয়ে আসে যেন তরি!
আপনার গানে আপনার প্রাণ ছিঁড়িয়া যাইতে চায়,
তবু সেই ব্যথা ভাল লাগে যেন, একই গান পুনঃ গায় |
খেত-খামারেতে মন বসেনাকো ; কাজে কামে নাই ছিরি,
মনের তাহার কি যে হল আজ ভাবে তাই ফিরি ফিরি |
গানের আসরে যায় না রূপাই সাথীরা অবাক মানে,
সারাদিন বসি কি যে ভাবে তার অর্থ সে নিজে জানে!
সময়ের খাওয়া অসময় খায়, উপোসীও কভু থাকে,
“দিন দিন তোর কি হল রূপাই” বার বার মায় ডাকে |
গেলে কোনখানে হয়তো সেথাই কেটে যায় সারা দিন,
বসিলে উঠেনা উঠিলে বসেনা, ভেবে ভেবে তনু ক্ষীণ |
সবে হাটে যায় পথ বরাবর রূপা যায় ঘুরে বাঁকা,
খালার বাড়ির কাছ দিয়ে পথ, বাঁশ-পাতা দিয়ে ঢাকা |

পায়ে-পায় ছাই বাঁশ-পাতাগুলো মচ্ মচ্ করে বাজে ;
কেউ সাথে নেই, তবু যে রূপাই মরে যায় যেন লাজে |
চোরের মতন পথে যেতে যেতে এদিক ওদিক চায়,
যদিবা হঠাৎ সেই মেয়েটির দুটি চোখে চোখ যায় |
ফিরিবার পথে খালার বাড়ির নিকটে আসিয়া তার,
কত কাজ পড়ে, কি করে রূপাই দেরি না করিয়া আর |
কোনদিন কহে, “খালামা, তোমার জ্বর নাকি হইয়াছে,
ও-বাড়ির ওই কানাই আজিকে বলেছে আমার কাছে |
বাজার হইতে আনিয়াছি তাই আধসেরখানি গজা |”
“বালাই! বালাই! জ্বর হবে কেন? রূপাই, করিলি মজা ;
জ্বর হলে কিরে গজা খায় কেহ?” হেসে কয় তার খালা,
“গজা খায়নাক, যা হোক এখন কিনে ত হইল জ্বালা ;
আচ্ছা না হয় সাজুই খাইবে |” ঠেকে ঠেকে রূপা কহে,
সাজু যে তখন লাজে মরে যায়, মাথা নিচু করে রহে |

কোন দিন কহে, “সাজু কই ওরে, শোনো কিবা মজা, খালা!
আজকের হাটে কুড়ায়ে পেয়েছি দুগাছি পুঁতির মালা ;
এক ছোঁড়া কয়, “রাঙা সূতো” নেবে? লাগিবে না কোন দাম ;
নিলে কিবা ক্ষতি, এই ভেবে আমি হাত পেতে রইলাম |
এখন ভাবছি, এসব লইয়া কিবা হবে মোর কাজ,
ঘরেতে থাকিলে ছোট বোনটি সে ইহাতে করিত সাজ |
সাজু ত আমার বোনেরই মতন, তারেই না দিয়ে যাই,
ঘরে ফিরে যেতে একটু ঘুরিয়া এ-পথে আইনু তাই |”

এমনি করিয়া দিনে দিনে যেতে দুইটি তরুণ হিয়া,
এ উহারে নিল বরণ করিয়া বিনে-সূতী মালা দিয়া |

এর প্রাণ হতে ওর প্রাণে যেয়ে লাগিল কিসের ঢেউ,
বিভোর কুমার, বিভোর কুমারী, তারা বুঝিল না কেউ |
—তারা বুঝিল না, পাড়ার লোকেরা বুঝিল অনেকখানি,
এখানে ওখানে ছেলে বুড়ো মিলে শুরু হল কানাকানি |

সেদিন রূপাই হাট-ফেরা পথে আসিল খালার বাড়ি,
খালা তার আজ কথা কয়নাক, মুখখানি যেন হাঁড়ি |
“রূপা ভাই এলে?” এই বলে সাজু কাছে আসছিল তাই,
মায় কয়, “ওরে ধাড়ী মেয়ে, তোর লজ্জা শরম নাই?”
চুল ধরে তারে গুড়ুম গুড়ুম মারিল দু’তিন কিল,
বুঝিল রূপাই এই পথে কোন হইয়াছে গরমিল |

মাথার বোঝাটি না-নামায়ে রূপা যেতেছিল পথ ধরি,
সাজুর মায়ে যে ডাকিল তাহারে হাতের ইশারা করি ;
“শোন বাছা কই, লোকের মুখেতে এমন তেমন শুনি,
ঘরে আছে মোর বাড়ন্ত মেয়ে জ্বলন্ত এ আগুনি |
তুমি বাপু আর এ-বাড়ি এসো না |” খালা বলে রোষে রোষে,
“কে কি বলে? তার ঘাড় ভেঙে দেব!” রূপা কহে দম কসে |
“ও-সবে আমার কাজ নাই বাপু, সোজা কথা ভালবাসি,
সারা গাঁয়ে আজ ঢিঢি পড়ে গেছে,মেয়ে হল কুল-নাশী |”

সাজুর মায়ের কথাগুলি যেন বঁরশীর মত বাঁকা,
ঘুরিয়া ঘুরিয়া মনে দিয়ে যায় তীব্র বিষের ধাকা |
কে যেন বাঁশের জোড়-কঞ্চিতে তাহার কোমল পিঠে,
মহারোষ-ভরে সপাং সপাং বাড়ি দিল গিঠে গিঠে |
টলিতে টলিতে চলিল রূপাই একা গাঁর পথ ধরি,
সম্মুখ হতে জোনাকীর আলো দুই পাশে যায় সরি |

রাতের আঁধারে গালি-ভরা বিষে জমাট বেঁধেছে বুঝি,
দুই হাতে তাহা ঠেলিয়া ঠেলিয়া চলে রূপা পথ খুঁজি |
মাথার ধামায় এখনও রয়েছে দুজোড়া রেশমী চুরী,
দুপায়ে তাহারে দলিয়া রূপাই ভাঙিয়া করিল গুঁড়ি |
টের সদাই জলীর বিলেতে দুহাতে ছুঁড়িয়া ফেলি,
পথ থুয়ে রূপা বেপথে চলিল, ইটা খেতে পাও মেলি |
চলিয়া চলিয়া মধ্য মাঠেতে বসিয়া কাঁদিল কত,
অষ্টমী চাঁদ হেলিয়া হেলিয়া ওপারে হইল গত |

প্রভাতে রূপাই উঠিল যখন মায়ের বিছানা হতে,
চেহারা তাহার আধা হয়ে গেছে, চেনা যায় কোন মতে |
মা বলে, “রূপাই কি হলরে তোর?” রূপাই কহে না কথা
দুখিনী মায়ের পরাণে আজিকে উঠিল দ্বিগুণ ব্যথা |
সাত নয় মার পাঁচ নয় এক রুপাই নয়ন তারা,
এমনি তাহার দশা দেখে মায় ভাবিয়া হইল সারা |
শানাল পীরের সিন্নি মানিল খেতে দিল পড়া-পানি,
হেদের দৈন্য দেখিল জননী, দেখিলনা প্রাণখানি |
সারা গায়ে মাতা হাত বুলাইল চোখে মুখে দিল জল,
বুঝিল না মাতা বুকের ব্যথার বাড়ে যে ইহাতে বল |

আজকে রূপার সকলি আঁধার, বাড়া-ভাতে ওড়ে ছাই,
কলঙ্ক কথা সবে জানিয়াছে, কেহ বুঝি বাকি নাই |
জেনেছে আকাশ, জেনেছে বাতাস, জেনেছে বনের তরু ;
উদাস-দৃষ্টি য়ত দিকে চাহে সব যেন শূনো মরু |

চারিদিক হতে উঠিতেছে সুর, ধিক্কার! ধিক্কার!!
শাঁখের করাত কাটিতেছে তারে লয়ে কলঙ্ক ধার |
ব্যথায় ব্যথায় দিন কেটে গেল, আসিল ব্যথার সাঁজ,
পূবে কলঙ্কী কালো রাত এল, চরণে ঝিঁঝির ঝাঁজ!
অনেক সুখের দুখের সাক্ষী বাঁশের বাঁশীটি নিয়ে,
বসিল রূপাই বাড়ির সামনে মধ্য মাঠেতে গিয়ে |

মাঠের রাখাল, বেদনা তাহার আমরা কি অত বুঝি ;
মিছেই মোদের সুখ-দুখ দিয়ে তার সুখ-দুখ খুঁজি |
আমাদের ব্যথা কেতাবেতে লেখা, পড়িলেই বোঝা যায় ;
যে লেখে বেদনা বে-বুঝ বাঁশীতে কেমন দেখাব তায়?
অনন্তকাল যাদের বেদনা রহিয়াছে শুধু বুকে,
এ দেশের কবি রাখে নাই যাহা মুখের ভাষায় টুকে ;
সে ব্যথাকে আমি কেমনে জানাব? তবুও মাটিতে কান ;
পেতে রহি কভু শোনা যায় কি কহে মাটির প্রাণ!
মোরা জানি খোঁজ বৃন্দাবনেতে ভগবান করে খেলা,
রাজা-বাদশার সুখ-দুখ দিয়ে গড়েছি কথার মালা |
পল্লীর কোলে নির্ব্বাসিত এ ভাইবোনগুলো হায়,
যাহাদের কথা আধ বোঝা যায়, আধ নাহি বোঝা যায় ;
তাহাদেরই এক বিরহিয়া বুকে কি ব্যথা দিতেছে দোল,
কি করিয়া আ দেখাইব তাহা, কোথা পাব সেই বোল?
—সে বন-বিহগ কাঁদিতে জানে না, বেদনার ভাষা নাই,
ব্যাধের শায়ক বুকে বিঁধিয়াছে জানে তার বেদনাই |

বাজায় রূপাই বাঁশীটি বাজায় মনের মতন করে,
যে ব্যথা সে বুকে ধরিতে পারেনি সে ব্যথা বাঁশীতে ঝরে

“আমি কেনে বা পিরীতিরে করলাম |
( আমার ভাবতে জনম গেলরে,
আমার কানতে জনম গেলরে | )
সে ত সিন্তার সিন্দুর নয় তারে আমি কপালে পরিব,
সে ত ধান নয় চাউল নয় তারে আমি ডোলেতে ভরিবরে,
আমি কেনেবা পিরীতিরে করলাম |
আগে যদি জানতাম আমি প্রেমের এত জ্বালা,
ঘর করতাম কদম্বতলা, রহিতাম একেলারে ;
আমি কেনেবা পিরীতিরে করলাম |”
— মুর্শিদা গান

বাজে বাঁশী বাজে, তারি সাথে সাথে দুলিছে সাঁজের আলো ;
নাচে তালে তালে জোনাকীর হারে কালো মেঘে রাত-কালো |
বাজাইল বাঁশী ভাটিয়ালী সুরে বাজাল উদাস সুরে,
সুর হতে সুর ব্যথা তার চলে যায় কোন দূরে!
আপনার ভাবে বিভোল পরাণ, অনন্ত মেঘ-লোকে,
বাঁশী হতে সুরে ভেসে যায় যেন, দেখে রূপা দুই চোখে |
সেই সুর বয়ে চলেছে তরুণী, আউলা মাথার চুল,
শিথিল দুখান বাহু বাড়াইয়াছিঁড়িছে মালার ফুল |
রাঙা ভাল হতে যতই মুছিছে ততই সিঁদুর জ্বলে ;
কখনও সে মেয়ে আগে আগে চলে, কখনও বা পাছে চলে |
খানিক চলিয়া থামিল করুণী আঁচলে ঢাকিয়া চোখ,
মুছিতে মুছিতে মুছিতে পারে না, কি যেন অসহ শোক!
করুণ তাহার করুণ কান্না আকাশ ছাইয়া যায়,
কি যে মোহের রঙ ভাসে মেঘে তাহার বেদনা-ঘায় |
পুনরায় যেন খিল খিল করে একগাল হাসি হাসে,
তারি ঢেউ লাগি গগনে গগনে তড়িতের রেখা ভাসে |

কখনও আকাশ ভীষণ আঁধার, সব গ্রাসিয়াছে রাহু,
মহাশূণ্যের মাঝে ভেসে উঠে যেন দুইখানি বাহু!
দোলে-দোলে-বাহু তারি সাথে যেন দোলে-দোলে কত কথা,
“ঘরে ফিরে যাও, মোর তরে তুমি সহিও না আর ব্যথা |”
মুহূর্ত পরে সেই বাহু যেন শূণ্যে মিলায় হায়—
রামধনু বেয়ে কে আসে ও মেয়ে, দেখে যেন চেনা যায়!
হাসি হাসি মুখ গলিয়া গলিয়া হাসি যায় যেন পড়ে,
সার গায়ে তার রূপ ধরেনাক, পড়িছে আঁচল ঝরে |
কণ্ঠে তাহার মালার গন্ধে বাতাস পাগল পারা,
পায়ে রিনি ঝিনি সোনার নূপুর বাজিয়া হইছে সারা ;

হঠাৎ কে এল ভীষণ দস্যু—ধরি তার চুল মুঠি,
কোন্ আন্ধার গ্রহপথ বেয়ে শূণ্যে সে গেল উঠি |
বাঁশী ফেলে দিয়ে ডাক ছেড়ে রূপা আকাশের পানে চায়,
আধা চাঁদখানি পড়িছে হেলিয়া সাজুদের ওই গাঁয় |
শুনো মাঠে রূপা গড়াগড়ি যায়, সারা গায়ে ধূলো মাখে,
দেহেরে ঢাকিছে ধূলো মাটি দিয়ে, ব্যথারে কি দিয়ে ঢাকে!

*****
সদাই = সওদা
ইটা খেত = চষা খেত
শানাল = পূর্ববঙ্গের বিখ্যাত পীর শাহলাল