বিসর্জন

রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর

দুইটি কোলের ছেলে গেছে পর - পর
বয়স না হতে হতে পুরা দু - বছর ।
এবার ছেলেটি তার জন্মিল যখন
স্বামীরেও হারালো মল্লিকা । বন্ধুজন
বুঝাইল — পূর্বজন্মে ছিল বহু পাপ ,
এ জনমে তাই হেন দারুণ সন্তাপ ।
শোকানলদগ্ধ নারী একান্ত বিনয়ে
অজ্ঞাত জন্মের পাপ শিরে বহি লয়ে
প্রায়শ্চিত্তে দিল মন । মন্দিরে মন্দিরে
যেথা সেথা গ্রামে গ্রামে পূজা দিয়ে ফিরে ,
ব্রত ধ্যান উপবাসে আহ্নিকে তর্পণে
কাটে দিন , ধূপে দীপে নৈবেদ্যে চন্দনে
পূজাগৃহে ; কেশে বাঁধি রাখিল মাদুলি
কুড়াইয়া শত ব্রাহ্মণের পদধূলি ;
শুনে রামায়ণ - কথা ; সন্ন্যাসী সাধুরে
ঘরে আনি আশীর্বাদ করায় শিশুরে ।
বিশ্বমাঝে আপনারে রাখি সর্বনীচে
সবার প্রসন্নদৃষ্টি অভাগী মাগিছে
আপন সন্তান লাগি । সূর্য চন্দ্র হতে
পশুপক্ষী পতঙ্গ অবধি কোনোমতে
কেহ পাছে কোনো অপরাধ লয় মনে ,
পাছে কেহ করে ক্ষোভ , অজানা কারণে
পাছে কারো লাগে ব্যথা — সকলের কাছে
আকুল - বেদনা - ভরে দীন হয়ে আছে ।

যখন বছর দেড় বয়স শিশুর
যকৃতের ঘটিল বিকার ; জ্বরাতুর
দেহখানি শীর্ণ হয়ে আসে । দেবালয়ে
মানিল মানত মাতা , পদামৃত লয়ে
করাইল পান , হরিসংকীর্তন - গানে
কাঁপিল প্রাঙ্গণ । ব্যাধি শান্তি নাহি মানে ।
কাঁদিয়া শুধালো নারী , ‘ ব্রাহ্মণ ঠাকুর ,
এত দুঃখে তবু পাপ নাহি হল দূর ?
দিনরাত্রি দেবতার মেনেছি দোহাই ,
দিয়েছি এত যে পূজা তবু রক্ষা নাই ?
তবু কি নেবেন তাঁরা আমার বাছারে ?
এত ক্ষুধা দেবতার ? এত ভারে ভারে
নৈবেদ্য দিলাম খেতে বেচিয়া গহনা ,
সর্বস্ব খাওয়ানু , তবু ক্ষুধা মিটিল না ? '
ব্রাহ্মণ কহিল , ‘ বাছা , এ যে ঘোর কলি !
অনেক করেছ বটে তবু এও বলি ,
আজকাল তেমন কি ভক্তি আছে কারো ?
সত্যযুগে যা পারিত তা কি আজ পারো ?
দানবীর কর্ণ - কাছে ধর্ম যবে এসে
পুত্রেরে চাহিল খেতে ব্রাহ্মণের বেশে ,
নিজহস্তে সন্তানে কাটিল ; তখনি সে
শিশুরে ফিরিয়া পেল চক্ষের নিমেষে ।
শিবিরাজা শ্যেনরূপী ইন্দ্রের মুখেতে
আপন বুকের মাংস কাটি দিল খেতে ,
পাইল অক্ষয় দেহ । নিষ্ঠা এরে বলে ।
তেমন কি এ কালেতে আছে ভূমনডলে ?
মনে আছে ছেলেবেলা গল্প শুনিয়াছি
মার কাছে — তাঁদের গ্রামের কাছাকাছি
ছিল এক বন্ধ্যা নারী , না পাইয়া পথ
প্রথম গর্ভের ছেলে করিল মানত
মা গঙ্গার কাছে ; শেষে পুত্রজন্ম - পরে
অভাগী বিধবা হল , গেল সে সাগরে ,
কহিল সে নিষ্ঠাভরে মা গঙ্গারে ডেকে ,
মা , তোমারি কোলে আমি দিলাম ছেলেকে —
এ মোর প্রথম পুত্র , শেষ পুত্র এই ,
এ জন্মের তরে আর পুত্র - আশা নেই ।
যেমনি জলেতে ফেলা , মাতা ভাগীরথী
মকরবাহিনী - রূপে হয়ে মূর্তিমতী
শিশু লয়ে আপনার পদ্মকরতলে
মার কোলে সমর্পিল । নিষ্ঠা এরে বলে । '
মল্লিকা ফিরিয়া এল নতশির করে ,
আপনারে ধিক্কারিল — এতদিন ধরে
বৃথা ব্রত করিলাম , বৃথা দেবার্চনা ,
নিষ্ঠাহীনা পাপিষ্ঠারে ফল মিলিল না ।

ঘরে ফিরে এসে দেখে শিশু অচেতন
জ্বরাবেশে । অঙ্গ যেন অগ্নির মতন ।
ঔষধ গিলাতে যায় যত বারবার
পড়ে যায় , কণ্ঠ দিয়া নামিল না আর ।
দন্তে দন্তে গেল আঁটি । বৈদ্য শির নাড়ি
ধীরে ধীরে চলি গেল রোগীগৃহ ছাড়ি ।
সন্ধ্যার আঁধারে শূন্য বিধবার ঘরে
একটি মলিন দীপ , শয়নশিয়রে
একা শোকাতুরা নারী । শিশু একবার
জ্যোতিহীন আঁখি মেলি যেন চারি ধার
খুঁজিল কাহারে । নারী কাঁদিল কাতর ,
‘ ও মানিক , ওরে সোনা , এই - যে মা তোর ,
এই - যে মায়ের কোল , ভয় কী রে বাপ ! '
বক্ষে তারে চাপি ধরি তার জ্বরতাপ
চাহিল কাড়িয়া নিতে অঙ্গে আপনার
প্রাণপণে । সহসা বাতাসে গৃহদ্বার
খুলে গেল , ক্ষীণ দীপ নিবিল তখনি —
সহসা বাহির হতে কলকলধ্বনি
পশিল গৃহের মাঝে । চমকিল নারী ।
দাঁড়ায়ে উঠিল বেগে শয্যাতল ছাড়ি ,
কহিল , ‘ মায়ের ডাক ওই শুনা যায় —
ও মোর দু : খীর ধন , পেয়েছি উপায় ,
তোর মার কোল চেয়ে সুশীতল কোল
আছে ওরে বাছা ! '

জাগিয়াছে কলরোল
অদূরে জাহ্নবীজলে , এসেছে জোয়ার
পূর্ণিমায় । শিশুর তাপিত দেহভার
বক্ষে লয়ে মাতা , গেল শূন্যঘাট - পানে ।
কহিল , ‘ মা , মার ব্যথা যদি বাজে প্রাণে
তবে এ শিশুর তাপ দে গো মা জুড়ায়ে ।
একমাত্র ধন মোর দিনু তোর পায়ে
এক - মনে । ' এত বলি সমর্পিল জলে
অচেতন শিশুটিরে লয়ে করতলে
চক্ষু মুদি । বহুক্ষণ আঁখি মেলিল না ;
ধ্যানে নিরখিল বসি মকরবাহনা
জ্যোতির্ময়ী মাতৃমূর্তি ক্ষুদ্র শিশুটিরে
কোলে ক ' রে এসেছেন , রাখি তার শিরে
একটি পদ্মের দল ; হাসিমুখে ছেলে
অনিন্দিত কান্তি ধরি দেবী - কোল ফেলে
মার কোলে আসিবারে বাড়ায়েছে কর ।
কহে দেবী , ‘ রে দুঃখিনী , এই তুই ধর্‌
তোর ধন তোরে দিনু । ' রোমাঞ্চিতকায়
নয়ন মেলিয়া কহে , ‘ কই মা !... কোথায় ! '
পরিপূর্ণ চন্দ্রালোকে বিহ্বলা রজনী ;
গঙ্গা বহি চলি যায় করি কলধ্বনি ।
চীৎকারী উঠিল নারী , ‘ দিবি নে ফিরায়ে ? '
মর্মরিল বনভূমি দক্ষিণের বায়ে ।

[কাহিনী]

No comments:

Post a Comment