রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
অন্ধ ভূমিগর্ভ হতে শুনেছিলে সূর্যের আহ্বান
প্রাণের প্রথম জাগরণে , তুমি বৃক্ষ , আদিপ্রাণ ;
ঊর্ধ্বশীর্ষে উচ্চারিলে আলোকের প্রথম বন্দনা
ছন্দোহীন পাষাণের বক্ষ- ' পরে ; আনিলে বেদনা
নিঃসাড় নিষ্ঠুর মরুস্থলে ।
সেদিন অম্বর-মাঝে
শ্যামে নীলে মিশ্রমন্ত্রে স্বর্গলোকে জ্যোতিষ্কসমাজে
মর্তের মাহাত্ম্যগান করিলে ঘোষণা । যে জীবন
মরণতোরণদ্বার বারংবার করি উত্তরণ
যাত্রা করে যুগে যুগে অনন্তকালের তীর্থপথে
নব নব পান্থশালে বিচিত্র নূতন দেহরথে ,
তাহারি বিজয়ধ্বজা উড়াইলে নিঃশঙ্ক গৌরবে
অজ্ঞাতের সম্মুখে দাঁড়ায়ে । তোমার নিঃশব্দ রবে
প্রথম ভেঙেছে স্বপ্ন ধরিত্রীর , চমকি উল্লসি
নিজেরে পড়েছে তার মনে — দেবকন্যা দুঃসাহসী
কবে যাত্রা করেছিল জ্যোতিঃস্বর্গ ছাড়ি দীনবেশে
পাংশুম্লান গৈরিকবসন-পরা , খণ্ড কালে দেশে
অমরার আনন্দেরে খণ্ড খণ্ড ভোগ করিবারে ,
দুঃখের সংঘাতে তারে বিদীর্ণ করিয়া বারে বারে
নিবিড় করিয়া পেতে ।
মৃত্তিকার হে বীর সন্তান ,
সংগ্রাম ঘোষিলে তুমি মৃত্তিকারে দিতে মুক্তিদান
মরুর দারুণ দুর্গ হতে ; যুদ্ধ চলে ফিরে ফিরে ;
সন্তরি সমুদ্র-ঊর্মি দুর্গম দ্বীপের শূন্য তীরে
শ্যামলের সিংহাসন প্রতিষ্ঠিলে অদম্য নিষ্ঠায় ,
দুস্তর শৈলের বক্ষে প্রস্তরের পৃষ্ঠায় পৃষ্ঠায়
বিজয়-আখ্যানলিপি লিখি দিলে পল্লব-অক্ষরে
ধূলিরে করিয়া মুগ্ধ , চিহ্নহীন প্রান্তরে প্রান্তরে
ব্যাপিলে আপন পন্থা ।
বাণীশূন্য ছিল একদিন
জলস্থল শূন্যতল , ঋতুর উৎসবমন্ত্রহীন —
শাখায় রচিলে তব সংগীতের আদিম আশ্রয় ,
যে গানে চঞ্চল বায়ু নিজের লভিল পরিচয় ,
সুরের বিচিত্র বর্ণে আপনার দৃশ্যহীন তনু
রঞ্জিত করিয়া নিল , অঙ্কিল গানের ইন্দ্রধনু
উত্তরীর প্রান্তে প্রান্তে । সুন্দরের প্রাণমূর্তিখানি
মৃত্তিকার মর্তপটে দিলে তুমি প্রথম বাখানি
টানিয়া আপন প্রাণে রূপশক্তি সূর্যলোক হতে ,
আলোকের গুপ্তধন বর্ণে বর্ণে বর্ণিলে আলোতে ।
ইন্দ্রের অপ্সরী আসি মেঘে হানিয়া কঙ্কণ
বাষ্পপাত্র চূর্ণ করি লীলানৃত্যে করেছে বর্ষণ
যৌবন - অমৃতরস , তুমি তাই নিলে ভরি ভরি
আপনার পুত্রপুষ্পপুটে , অনন্তযৌবনা করি
সাজাইলে বসুন্ধরা ।
হে নিস্তব্ধ , হে মহাগম্ভীর ,
বীর্যেরে বাঁধিয়া ধৈর্যে শান্তিরূপ দেখালে শক্তির ;
তাই আসি তোমার আশ্রয়ে শান্তিদীক্ষা লভিবারে ,
শুনিতে মৌনের মহাবানী ; দুশ্চিন্তার গুরুভারে
নতশীর্ষ বিলুণ্ঠিতে শ্যামসৌম্যচ্ছায়াতলে তব —
প্রাণের উদার রূপ , রসরূপ নিত্য নব নব ,
বিশ্বজয়ী বীররূপ ধরণীর , বাণীরূপ তার
লভিতে আপন প্রাণে । ধ্যানবলে তোমার মাঝার
গেছি আমি , জেনেছি , সূর্যের বক্ষে জ্বলে বহ্নিরূপে
সৃষ্টিযজ্ঞে যেই হোম , তোমার সত্তায় চুপে চুপে
ধরে তাই শ্যাম স্নিগ্ধরূপ ; ওগো সূর্যরশ্মিপায়ী ,
শত শত শতাব্দীর দিনধেনু দুহিয়া সদাই
যে তেজে ভরিলে মজ্জা , মানবেরে তাই করি দান
করেছ জগৎজয়ী ; দিলে তারে পরম সম্মান ;
হয়েছে সে দেবতার প্রতিস্পর্ধী — সে অগ্নিচ্ছটায়
প্রদীপ্ত তাহার শক্তি বিশ্বতলে বিস্ময় ঘটায়
ভেদিয়া দুঃসাধ্য বিঘ্নবাধা । তব প্রাণে প্রাণবান ,
তব স্নেহচ্ছায়ায় শীতল , তব তেজে তেজীয়ান ,
সজ্জিত তোমার মাল্যে যে মানব , তারি দূত হয়ে
ওগো মানবের বন্ধু , আজি এই কাব্য-অর্ঘ্য ল'য়ে
শ্যামের বাঁশির তানে মুগ্ধ কবি আমি
অর্পিলাম তোমায় প্রণামী ।
অন্ধ ভূমিগর্ভ হতে শুনেছিলে সূর্যের আহ্বান
প্রাণের প্রথম জাগরণে , তুমি বৃক্ষ , আদিপ্রাণ ;
ঊর্ধ্বশীর্ষে উচ্চারিলে আলোকের প্রথম বন্দনা
ছন্দোহীন পাষাণের বক্ষ- ' পরে ; আনিলে বেদনা
নিঃসাড় নিষ্ঠুর মরুস্থলে ।
সেদিন অম্বর-মাঝে
শ্যামে নীলে মিশ্রমন্ত্রে স্বর্গলোকে জ্যোতিষ্কসমাজে
মর্তের মাহাত্ম্যগান করিলে ঘোষণা । যে জীবন
মরণতোরণদ্বার বারংবার করি উত্তরণ
যাত্রা করে যুগে যুগে অনন্তকালের তীর্থপথে
নব নব পান্থশালে বিচিত্র নূতন দেহরথে ,
তাহারি বিজয়ধ্বজা উড়াইলে নিঃশঙ্ক গৌরবে
অজ্ঞাতের সম্মুখে দাঁড়ায়ে । তোমার নিঃশব্দ রবে
প্রথম ভেঙেছে স্বপ্ন ধরিত্রীর , চমকি উল্লসি
নিজেরে পড়েছে তার মনে — দেবকন্যা দুঃসাহসী
কবে যাত্রা করেছিল জ্যোতিঃস্বর্গ ছাড়ি দীনবেশে
পাংশুম্লান গৈরিকবসন-পরা , খণ্ড কালে দেশে
অমরার আনন্দেরে খণ্ড খণ্ড ভোগ করিবারে ,
দুঃখের সংঘাতে তারে বিদীর্ণ করিয়া বারে বারে
নিবিড় করিয়া পেতে ।
মৃত্তিকার হে বীর সন্তান ,
সংগ্রাম ঘোষিলে তুমি মৃত্তিকারে দিতে মুক্তিদান
মরুর দারুণ দুর্গ হতে ; যুদ্ধ চলে ফিরে ফিরে ;
সন্তরি সমুদ্র-ঊর্মি দুর্গম দ্বীপের শূন্য তীরে
শ্যামলের সিংহাসন প্রতিষ্ঠিলে অদম্য নিষ্ঠায় ,
দুস্তর শৈলের বক্ষে প্রস্তরের পৃষ্ঠায় পৃষ্ঠায়
বিজয়-আখ্যানলিপি লিখি দিলে পল্লব-অক্ষরে
ধূলিরে করিয়া মুগ্ধ , চিহ্নহীন প্রান্তরে প্রান্তরে
ব্যাপিলে আপন পন্থা ।
বাণীশূন্য ছিল একদিন
জলস্থল শূন্যতল , ঋতুর উৎসবমন্ত্রহীন —
শাখায় রচিলে তব সংগীতের আদিম আশ্রয় ,
যে গানে চঞ্চল বায়ু নিজের লভিল পরিচয় ,
সুরের বিচিত্র বর্ণে আপনার দৃশ্যহীন তনু
রঞ্জিত করিয়া নিল , অঙ্কিল গানের ইন্দ্রধনু
উত্তরীর প্রান্তে প্রান্তে । সুন্দরের প্রাণমূর্তিখানি
মৃত্তিকার মর্তপটে দিলে তুমি প্রথম বাখানি
টানিয়া আপন প্রাণে রূপশক্তি সূর্যলোক হতে ,
আলোকের গুপ্তধন বর্ণে বর্ণে বর্ণিলে আলোতে ।
ইন্দ্রের অপ্সরী আসি মেঘে হানিয়া কঙ্কণ
বাষ্পপাত্র চূর্ণ করি লীলানৃত্যে করেছে বর্ষণ
যৌবন - অমৃতরস , তুমি তাই নিলে ভরি ভরি
আপনার পুত্রপুষ্পপুটে , অনন্তযৌবনা করি
সাজাইলে বসুন্ধরা ।
হে নিস্তব্ধ , হে মহাগম্ভীর ,
বীর্যেরে বাঁধিয়া ধৈর্যে শান্তিরূপ দেখালে শক্তির ;
তাই আসি তোমার আশ্রয়ে শান্তিদীক্ষা লভিবারে ,
শুনিতে মৌনের মহাবানী ; দুশ্চিন্তার গুরুভারে
নতশীর্ষ বিলুণ্ঠিতে শ্যামসৌম্যচ্ছায়াতলে তব —
প্রাণের উদার রূপ , রসরূপ নিত্য নব নব ,
বিশ্বজয়ী বীররূপ ধরণীর , বাণীরূপ তার
লভিতে আপন প্রাণে । ধ্যানবলে তোমার মাঝার
গেছি আমি , জেনেছি , সূর্যের বক্ষে জ্বলে বহ্নিরূপে
সৃষ্টিযজ্ঞে যেই হোম , তোমার সত্তায় চুপে চুপে
ধরে তাই শ্যাম স্নিগ্ধরূপ ; ওগো সূর্যরশ্মিপায়ী ,
শত শত শতাব্দীর দিনধেনু দুহিয়া সদাই
যে তেজে ভরিলে মজ্জা , মানবেরে তাই করি দান
করেছ জগৎজয়ী ; দিলে তারে পরম সম্মান ;
হয়েছে সে দেবতার প্রতিস্পর্ধী — সে অগ্নিচ্ছটায়
প্রদীপ্ত তাহার শক্তি বিশ্বতলে বিস্ময় ঘটায়
ভেদিয়া দুঃসাধ্য বিঘ্নবাধা । তব প্রাণে প্রাণবান ,
তব স্নেহচ্ছায়ায় শীতল , তব তেজে তেজীয়ান ,
সজ্জিত তোমার মাল্যে যে মানব , তারি দূত হয়ে
ওগো মানবের বন্ধু , আজি এই কাব্য-অর্ঘ্য ল'য়ে
শ্যামের বাঁশির তানে মুগ্ধ কবি আমি
অর্পিলাম তোমায় প্রণামী ।
No comments:
Post a Comment