কেয়াফুল
অন্ধ বধূ
পায়ের তলায় নরম ঠেকল কি!
আস্তে একটু চল না ঠাকুর-ঝি---
ওমা, এযে ঝরা-বকুল! নয়?
তাইত বলি, বসে' দোরের পাশে,
রাত্তিরে কাল---মধুমদির বাসে
আকাশ-পাতাল কতই মনে হয় |
জ্যৈষ্ঠ আসতে কদিন দেরী ভাই---
আমের গায়ে বরণ দেখা যায়?
---অনেক দেরী? কেমন করে' হবে!
কোকিল-ডাকা শুনেছি সেই কবে,
দখিণ হাওয়া---বন্দ কবে ভাই ;
দীঘির ঘটে নতুন সিঁড়ি জাগে---
শেওলা-পিছল---এমনি শঙ্কা লাগে,
পা-পিছলিয়ে তলিয়ে যদি যাই!
মন্দ নেহাৎ হয় না কিন্তু তায়---
অন্ধ চোখের দ্বন্দ্ব চুকে' যায়!
দুঃখ নাইক সত্যি কথা শোন্,
অন্ধ গেলে কি আর হবে বোন?
বাঁচবি তোরা---দাদা ত তোর আগে ;
এই আষাঢ়েই আবার বিয়ে হবে,
বাড়ী আসার পথ খুঁজে' না পাবে---
দেখবি তখন প্রবাস কেমন লাগে?
---কি বল্লি ভাই, কাঁদবে সন্ধ্যা-সকাল?
হা অদৃষ্ট, হায়রে আমার কপাল!
কত লোকেই যায় ত পরবাসে---
কাল-বোশেখে কে না বাড়ী আসে?
চৈতালি কাজ, কবে যে সেই শেষ!
পাড়ার মানুষ ফিরল সবাই ঘর,
তোমার ভাইয়ের সবই স্বতন্তর---
ফিরে' আসার নাই কোন উদ্দেশ!
---ঐ য়ে হেথায় ঘরের কাঁটা আছে---
ফিরে' আসতে হবে ত তার কাছে!
এইখানেতে একটু ধরিস ভাই,
পিছল ভারি --- ফস্ কে যদি যাই---
এ অক্ষমার রক্ষা কি আর আছে!
আসুন ফিরে'---অনেক দিনের আশা,
থাকুন ঘরে, না থাক্ ভালবাসা---
তবু দুদিন অভাগিনীর কাছে!
জন্মশোধের বিদায় নিয়ে ফিরে'---
সেদিন তখন আসব দীঘির তীরে |
"চোখ গেল" ঐ চেঁচিয়ে হ'ল সারা!
আচ্ছা দিদি, কি করবে ভাই তারা---
জন্ম লাগি গিয়েছে যার চোখ!
কাঁদার সুখ যে বারণ তাহার---ছাই!
কাঁদতে পেলে বাঁচত সে যে ভাই,
কতক তবু কমত যে তার শোক!
"চোখ গেল" ---তার ভরসা তবু আছে---
চক্ষুহীনার কি কথা কার কাছে!
টানিস কেন? কিসের তাড়াতাডি---
সেই ত ফিরে' যাব আবার বাড়ী,
একলা থাকা সেই ত গৃহকোণ---
তার চেয়ে এই স্নিগ্ধ শীতল জলে
দুটো যেন প্রাণের কথা বলে---
দরদ-ভরা দুখের আলাপন ;
পরশ তাহার মায়ের স্নেহের মত
ভুলায় খানিক মনের ব্যথা যত!
এবার এলে, হাতটি দিয়ে গায়ে
অন্ধ আঁখি বুলিয়ে বারেক পায়ে---
বন্দ চোখের অশ্রু রুধি' পাতায়,
জন্ম-দুখীর দীর্ঘ আয়ু দিয়ে
চিরবিদায় ভিক্ষা যাব নিয়ে---
সকল বালাই বহি আপন মাথায়!
দেখিস তখন, কাণার জন্য আর
কষ্ট কিছু হয়না যেন তাঁর |
তার পরে---এই শেওলা-দীঘির ধার---
সঙ্গে আসতে বলবো নাক আর,
শেষের পথে কিসের বল' ভয়---
এইখানে এই বেতের বনের ধারে,
ডাহুক-ডাকা সন্ধ্যা-অন্ধকারে---
সবার সঙ্গে সাঙ্গ পরিচয়!
শেওলা-দীঘির শীতল অতল নীরে---
মায়ের কোলটি পাই যেন ভাই ফিরে'!
কলঙ্ক
বাতাবিকুঞ্জে সন্ধ্যার বায় পুষ্পপরাগচোর------
কলঙ্কী মন, চেয়ে দেখ্ আজি সঙ্গী মিলেছে তোর |
দিবা অবসান, রবি হ’ল রাঙা,
পশ্চিমাকাশে নট্ কনা -ভাঙা ;
সঙ্গহীনের যাহা কিছু কাজ সাঙ্গ করেছি মোর,
কুঞ্জদুয়ারে ব’সে আছি একা কুসুমগন্ধে ভোর !
আধফুটন্ত বাতাবিকুসুমে কানন ভরিয়া আছে,----
কি গোপন কথা গুঞ্জরি’ অলি ফিরিছে ফুলের কাছে !
ফুটনোন্মুখ ফুলদলগুলি
পুলক-পরশে উঠে দুলিদুলি
গন্ধভিখারী সন্ধ্যার বায় ফুলপরিমল যাচে-----
সঙ্কোচে নত পুষ্পবালিকা---অতিথি ফিরে বা পাছে !
বেলা বয়ে যায়, সন্ধ্যার বায় আসি’ কহে বার বার,
সন্ধ্যা হয় যে অন্ধ কুসুম-----খোলো অন্তর-দ্বার !
মুকুলগন্ধ অন্ধ ব্যথায়
কুঁড়ির বন্ধ টুটিবারে চায়,
লুটাইতে চায় সন্ধ্যার পায় রুদ্ধ আবেগভার,
বিকাইতে চায় চরণের পরে কৌমার সুকুমার |
মন্থরপদে সন্ধ্যা নামিছে কাজলতিমিরে আঁকা,
দুয়ারে অতিথি, অন্তরে ব্যথা--- সম্ভব সে কি থাকা ?
গন্ধে পাগল অন্তর যার,
আবরণ মাঝে থাকে সে কি আর,
খুলি’ দিল দ্বার, পরান তাহার পরাগে-শিশিরে মাখা ;
কুঞ্জ ঘিরিয়া আঁধারে ছাইল স্বপ্নপাখীর পাখা |
বাতাবিকুঞ্জে সন্ধ্যার বায় পুষ্পপরাগচোর----
হা রে কলঙ্কী হৃদয় আমার, সঙ্গী মিলেছে তোর |
দূরদিগন্তে দিবা হল সারা ;
অন্তর ভরি ফুটে’ উঠে তারা,
নব-ফুটন্ত নেবুর গন্ধে আসিল তন্দ্রাঘোর-----
কলঙ্কী প্রেম, মুগ্ধ হৃদয়-----একই পরিণাম তোর ||
নাগকেশর
চিত্ততলে যে নাগবালা ছড়িয়ে ছিঁড়ে কেশের কেশর কাঁদছে-----
অফুরন্ত অশ্রুধারা সহস্রবার নাসার বেশর বাঁধছে ;
মানিক-হারা পাগল-পারা যে বেদনা বাজছে তাহার বক্ষে,
পলে-পলে পলক বেয়ে অলক ছেয়ে ঝরছে যাহা চক্ষে ;
দুঃখে-ভাঙা বক্ষে যাহা নিশ্বসিয়া সকাল-সাঁঝে টুটছে----
মহাকালের সোপানতলে নাগকেশরের ফুল হয়ে তাই ফুটছে !
মন-পাতালে যে নাগবালা রতন-জ্বালা কক্ষে ব’সে হাসছে----
দীপ্তি যাহার নেত্রপথে শুভ্র-শুচি দৃষ্টি হয়ে আসছে ;
মুক্তামানিক সবার মাঝে বিলিয়ে দিয়ে উল্লাসে যে চঞ্চল,
উদ্বেলিত সিন্ধুসম দুলছে যাহার উচ্ছৃসিত অঞ্চল ;
বিশ্বভুবন পূর্ণ ক’রে যে আনন্দ শঙ্খস্বরে উঠছে-----
মহাকালের সোপানতলে নাগকেশরের ফুল হয়ে তাই ফুটছে |
হাফিজের স্বপ্ন
অমা-যামিনীর গহন আঁধারে চুপি চুপি এল প্রিয়া,
দ্বিগুণ-আঁধার খর্জ্জুর বীথি, তাহারি আড়াল দিয়া !
আঙুরের মত অলকগুচ্ছে গোলাপের মালা পরি’,
মৃদু উশীরের মদির গন্ধে নিশীথ আকাশ ভরি’
কাজল-উজল কালো কটাক্ষে হানিয়া বিজলী-হাসি,
ফেরোজা রঙের বসন পরিয়া শিথানে দাঁড়া’ল আসি’ !----
বীণানিন্দিত মধুরকন্ঠে কহিল ---রে অনুরাগী,
শূন্যশয়নে আমারে মাগিয়া জাগিয়া কিসের লাগি ?
করুণা তাহার হৃদয়ে হানিল সুখের মতন ব্যথা,
যুড়ি’ যোড় পাণি বিগলিত-বাণী কন্ঠে কহিনু কথা,----
তব অঞ্চল বসন্তবায়ে হৃদয়ে যে ফুল ফুটে,
তব মঞ্জীরসঙ্গীতরবে হৃদয়ে যে ধ্বনি উঠে,-----
তাহারি গন্ধে, তাহারি ছন্দে রচিয়া গজল-গীতি
তোমারি কুঞ্জ-দুয়ারে গাহিয়া শুনাইব নিতি নিতি ;
নাহি চাই খ্যাতি, যশে কাজ নাই, চাহিনাক ধনমান,
তোমার স্তবের যোগ্য করিয়া শিখাইয়া দাও গান |
না কহিয়া কথা, না বলিয়া কিছু----- লীলায়িত হেলাভরে
সেতারটি শুধু লইল টানিয়া কোমল বুকের পরে ;
অঙ্গুলিঘাতে তারগুলি তা’র সঙ্গীতে ভরি’ দিয়া
আমার কোলের সঙ্গীটি মোরে ফিরাইয়া দিল প্রিয়া !
গোলাপের কুঁড়ি তখনো ভাবেনি ফুটিতে হইবে কিনা,
ডানার মাঝারে মাথাটি গুঁজিয়া চাতকী চেতনাহীনা ;
অমা যামিনীর গভীর আঁধারে মিলাইয়া গেল প্রিয়া-----
শিশির-শীতল খর্জ্জুর-বীথি, তাহারি ভিতর দিয়া !
তার পর হ’তে বাজিছে সাহানা সোহিনী সিন্ধু কাফি,
সাথে সাথে সেই পরম পরশ উঠিতেছে কাঁপি’ কাঁপি’ ;
তালে তালে উঠে দুলে , দুলে’ তারি হৃদয়েরি আকুলতা,
সুরে সুরে সদা ঘুরে’ ঘুরে’ ফিরে তাহারি গোপন কথা !
দ্বিপ্রহরে
বইয়ের পাতায় মন বসেনা, খোলা পাতা খোলাই পড়ে’ থাকে,
চোখের পাতায় ঘুম আসেনা---- দেহের ক্লান্তি বুঝাই বলো কা’কে ?
কাজের মাঝে হাত লাগাব, কোথাও কোন’ উত্সাহ নাই তার,
চেয়ে আছি চেয়েই আছি, চাওয়ার তবু নাইক কিছু আর !
বেলা বাড়ে, রোদ চড়ে’ যায়, প্রখর রবি দহে আকাশ তল,
ঝাঁঝাঁ করে ভিতর-বাহির, চোখের পথে শুকায় চোখের জল ;
মোহাচ্ছন্ন মৌন জগৎ, কোথাও যেন জীবনচেষ্টা নাহি,
ক্লিষ্ট আকাশ নির্ণিমেষে দিনের দাহ দেখছে শুধু চাহি’ !
ঘরে ঘরে আগল আঁটা, আমার ঘরেই মুক্ত শুধু দ্বার,
সেই যে খুলে’ চলে’ গেছে তেম্ নি আছে, কে দেয় উঠে’ আর !
পথের ধারে নিমের গাছে একটি কেবল তিক্ত মধুর শ্বাস
ক্ষণে ক্ষণে জানায় শুধু গোপন বুকের উদাসী উচ্ছ্বাস !
হাহা করে তপ্ত হাওয়া শষ্যহারা বসন্ত-শেষ মাঠে,
চোতের ফসল বিকিয়ে গেছে কবে কোথায় অজানা কোন্ হাটে !
উদার মলয় নিঃস্ব আজি, সাম্ নে শুধু ধূসর বালুচর
পঞ্চতপা দিক্-বিধবার বসন খানি লুট্ ছে নিরন্তর !
কোন্ পথে সে গেছে চলি’ মরু-বেলায় চিহ্নটি নাই তার,
লুপ্ত সকল শ্যামলিমা লয়ে তাহার মুগ্ধ উপাচার ;
জাগ্ ছে শুধু প্রখর দাহ তৃষ্ণাভরা বিশুষ্ক জিহ্বায়
দিনান্ত সে আস্ বে কখন ? দম্ কা বাতাস ধমক্ দিয়ে যায় !
সাধনা
নিন্দা হবে জানি-----
তবু রাণী, তোমার দ্বারেই সাধবো সেতার খানি |
আঙুল আমার বশ মানেনা, সুর ফোটে না তারে,
অধীর আবেগ আঘাত শুধু করে বুকের দ্বারে ;
তুমি তারে গুছিয়ে বেঁধে বশ মানিয়ে নিয়ে
সফল করে’ তোলো তোমার ভাবের আবেশ দিয়ে !
মর্ম্মরিয়া বাজুক সে তার মর্ম্মতারের মত
গুঞ্জরিয়া উঠুক বুকের গোপন ব্যথা যত ;
করুক লোকে কানাকানি, হাসুক যেবা হাসে----
তোমার চোখের দীপ্তিতে আজ দীক্ষা দেহ দাসে |
শঙ্কা তোমার নাই----
নিভৃত যে কুটীর খানি গ্রামের সীমানায় ;
উদার মাঠে নদী পারের পথটি গেছে বাঁকা,
শিয়রে তার নিঃশ্বসিছে বুনো-ঝাউয়ের শাখা |
এদিক বড় লোক চলেনা, ভাবে ---- যে জন যায়----
এমন সাঁঝে মাঠের মাঝে গজল কে বাজায় !
পথিক জানবে কেমন ক’রে কে লাগায় সে সুর ;
কাহার দেওয়া ব্যথায় হেথা সেতার ভরপুর !
না-হয় হেথায় নাইক প্রাসাদ, যন্ত্রী নাই বা আছে,
একটি ভক্ত জাগে তবু একটি দেবীর কাছে !
বিজন নদী তীর-----
ঝাউ শাখাতে ঘনায় ধীরে নিশীথ সুনিবিড় ;
দুয়ার না হয় খোলাই থাকুক, কিসের ক্ষতি তায় !
ভয় কোর’ না --- ভৃত্য দ্বারে রইল প্রতীক্ষায় !
দখিন বায়ে গৃহচ্ছায়ে কাঁপছে যে দীপ খানি,
সেই কাঁপনের সুরটি ধরে’ গমক যাবো টানি !
থরথরিয়ে কাঁপবে আঙুল , বক্ষ কাঁপবে সাথে,
অশ্রু কাঁপবে নয়ন-পাতে ব্যাকুল বেদনাতে |
মূর্চ্ছামগ্ন মৌন রাতি প্রহর বেড়ে যায়
ঝিঁঝির ঝুমুর সঙ্গে কাঁদে সেতার মূর্চ্ছনায় |
বাতাস যদি থামে,-----
ভোরের রাতে হঠাৎ ছাতে বাদল যদি নামে ;
দুয়ার ফাঁকে হাওয়ার হাঁকে প্রদীপ যদি নিবে !
ভক্ত তোমার বাহির দ্বারে, আগলটি কি দিবে !
দীপ নিবে যায়, কি ক্ষতি তায়---কি ফল বলো লাজে,
মল্লারেতে মীড় মিলিয়ে সেতার যে তার বাজে !
মেঘের পর্দ্দা ঘনায় যদি অন্ধ রাতের পরে,
কি প্রয়োজন, দুয়ার দেওয়া রইল কিনা ঘরে !
অশ্রু নামে বর্ষাসম ---- হায় গো রাণী হায়,
মুর্ত্তীমতী সিদ্ধি কি তার ফলবে সাধনায় |
ঐরে এল আলো-----
রক্ত ঊষা পরল ভূষা সাদার সাথে কালো |
বায়ুর কন্ঠে নাই গরজন, ভজন গাহে পাখী,
পূর্ব্বাচলের তোরণ দ্বারে অরুণ মেলে আঁখি ;
উদাস তব নয়ন-তারার পান্ডু করুণ ছবি----
এই বেলা তার সুর মিলিয়ে বাজারে ভৈরবী |
সাধক, তুমি সিদ্ধ আজি-----পূর্ণ মনোরথ,
ওই সুরে তোর যায় রে দেখা নূতন সুরের পথ |
যে যা বলে বলুক লোকে ভক্ত তোরই জয়,
বাণীর সাথে বীণার আজি নিবিড় পরিচয় !
দাসীপুত্র
পরের দুয়ারে দাসী বটে আজি, তবু সে মোদেরই মা,---
ভুলিবারে চাই সতত সে কথা ; ভুলিবারে পারি না |
কাঙালের ঘরে যাহা কিছু জোটে, সে যে ধূলিমাখা খুদ,
উপবাস ক্ষীণ শীর্ণ বক্ষে শুকায়ে গিয়াছে দুধ,---
তবু তাই খেয়ে বাঁচে এই প্রাণ, তাই দিয়ে এই দেহ,
ধূলামাটি মাখা তাহারই অঙ্কে বাঁধি দুদিনের গেহ,
হাঁটিতে শিখেছি যার হাঁটু ধরে, যে বুকে মেলিয়া পা,
হক ভিখারিনী---তবু সে জননী, কেমনে ভুলিব তা?
মাতা বিনতার দুখের দুলাল, মানুষ নয় সে, পাখি!
মায়ের দুঃখ-ভরা দাসীত্ব ঘুচাইয়াছিল না কি?
যতই এ-হিয়া উঠে গুমরিয়া বিপদ-বেদনা-বিষে,
মানুষের ঘরে জন্ম লভিয়া সে-কথা ভুলিব কিসে?
কোথা প্রাণপণ প্রবল নিষ্ঠা, চিত্ত অকুতোভয়,
কই সে বেদনা, শক্তিসাধনা, পণ মৃত্যুঞ্জয়?
প্রচণ্ড তেজ চাই সে গরুড়---আমাদেরই মাঝে চাই,
অমৃতের লাগি সেই প্রাণপণ--- ভুলিবনা ভুলি নাই |
এস তপস্বী, উগ্রশক্তি, এস হে কর্মবীর,
কর দৃঢ় পণ মায়ের চক্ষে মুছাতে অশ্রুনীর ;
পায়ে-পায়ে যত বিভেদের বাধা ভুলায়ে পরস্পরে
ভায়ে ভায়ে আজি মিলাইতে হবে জননীর ভাঙা ঘরে ;
এস হে হিন্দু, এস খ্রীষ্টীয়, পারসী, মুসলমান
যে মায়ের বুকে জন্ম তোমার, রাখ আজি তার মান |
যে জননী আজ ভিখারিনী হয়ে ভুলেছে আপন বাণী,
অর্জিয়া তারি ধর্মরাজ্য কর তাঁরে রাজরাণী |
কর্ম
শক্তি মায়ের ভৃত্য মোরা- নিত্য খাটি নিত্য খাই,
শক্ত বাহু, শক্ত চরণ, চিত্তে সাহস সর্বদাই |
ক্ষুদ্র হউক, তুচ্ছ হউক, সর্ব সরম-শঙ্কাহীন---
কর্ম মোদের ধর্ম বলি কর্ম করি রাত্রি দিন |
চৌদ্দ পুরুষ নিঃস্ব মোদের - বিন্দু তাহে লজ্জা নাই,
কর্ম মোদের রক্ষা করে অর্ঘ্য সঁপি কর্মে তাই |
সাধ্য যেমন - শক্তি যেমন - তেমনি অটল চেষ্টাতে--
দুঃখে-সুখে হাস্যমুখে কর্ম করি নিষ্ঠাতে |
কর্মে ক্ষুধার অন্ন যোগায়, কর্মে দেহে স্বাস্থ্য পাই ;
দুর্ভাবনায় শান্তি আনে --- নির্ভাবনায় নিদ্রা যাই |
তুচ্ছ পরচর্চাগ্লানি--- মন্দ ভালো--- কোন্ টা কে---
নিন্দা হতে মুক্তি দিয়া হাল্কা রেখে মনটাকে |
পৃথ্বি-মাতার পুত্র মোরা, মৃত্তিকা তার শয্যা তাই ;
পুষ্পে-তৃণে বাসটি ছাওয়া, দীপ্তি-হাওয়া ভগ্নী-ভাই |
তৃপ্তি তাঁরি শস্যে-জলে ক্ষুত্ পিপাসা দুঃসহ |
মুক্ত মাঠে যুক্ত করে বন্দি তাঁরেই প্রত্যহ |
ক্ষুদ্র নহি - তুচ্ছ নহি - ব্যর্থ মোরা নই কভু |
অর্থ মোদের দাস্য করে - অর্থ মোদের নয় প্রভু |
স্বর্ণ বল, রৌপ্য বল, বিত্তে করি জন্মদান,
চিত্ত তবু রিক্ত মোদের নিত্য রহে শক্তিমান |
কীর্তি মোদের মৃত্তিকাতে প্রত্যহ রয় মুদ্রিত,
শুণ্য' পরে নিত্য হের স্তোত্র মোদের উদ্গীত |
সিন্ধুবারি পণ্য বহি' ধন্য করে তৃপ্তিতে,
বহ্নি' মোদের রুদ্র প্রতাপ ব্যক্ত করে দীপ্তিতে |
বিশ্ব জুড়ি' সৃষ্টি মোদের, হস্ত মোদের বিশ্বময়,
কাণ্ড মোদের, সর্বঘটে - কোন্ খানে তা দৃষ্য নয়?
বিশ্বনাথের যজ্ঞশালে কর্মযোগের অন্ত নাই,
কর্ম সে যে ধর্ম মোদের, -- কর্ম চাহি -- কর্ম চাই |
অপরাজিতা
পরাজিতা তুই সকল ফুলের কাছে,
তবু কেন তোর অপরাজিতা নাম?
গন্ধ কি তোর বিন্দুমাত্র আছে?
বর্ণ-সেও ত নয় নয়নাভিরাম |
ক্ষুদ্র সেফালি, তারও মধুর-সৌরভ ;
ক্ষুদ্র অতসী, তারো কাঞ্চন-ভাতি ;
গরবিণি, তোর কিসে তবে গৌরব!
রূপগুণহীন বিড়ম্বনার খ্যাতি!
কালো আঁখিপুটে শিশির-অশ্রু ঝরে---
ফুল কহে---মোর কিছু নাই কিছু নাই,
তোমরা যে নামে ডাকিয়াছ দয়া করে,
আমি শুধু ভাই, তাই---আমি শুধু তাই |
ফুলসজ্জায় লজ্জায় যাই নাক,
পুষ্পমালায় নাহিক আমার স্থান,
প্রিয় উপহারে ভুলেও কি মোরে ডাক?
বিবাহ-বাসরে থাকি আমি ম্রিয়মাণ |
মোর ঠাঁই শুধু দেবের চরণতলে,
পূজা-শুধু-পূজা জীবনের মোর ব্রত ;
তিনিও কি মোরে ফিরাবেন আঁখিজলে---
অন্তরযামী,---তিনিও তোমারি মত?
মাধবিকা
দখিন হাওয়া---রঙিন হাওয়া, নূতন রঙের ভাণ্ডারী,
জীবন-রসের রসিক বঁধু, যৌবনেরি কাণ্ডারী!
সিন্ধু থেকে সদ্দ বুঝি আসছ আজি স্নান করি'---
গাং-চিলেদের পক্ষধ্বনির শন্ শনানির গান্ ধরি' ;
মৌমাছিদের মনভুলানি গুনগুনানির সুর ধরে'---
চললে কোথায় মুগ্ধ পথিক, পথটি বেয়ে উত্তরে?
অনেক দিনের পরে দেখা, বছর-পারের সঙ্গী গো,
হোক্ না হাজার ছাড়াছাড়ি, রেখেছ সেই ভঙ্গি তো!
---তেমনি সরস ঠাণ্ডা পরশ, তেমনি গলার হাঁকটি , সেই
দেখতে পেলেই চিনতে পারি, কোনোখানেই ফাঁকটি নেই!
---কোথায় ছিলে বন্ধু আমার, কোন্ মলয়ের বন ঘিরে,'
নারিকেলের কুঞ্জে-বেড়া কোন্ সাগরের কোন্ তীরে!
লকলকে সেই বেতসবীথির বলো তো ভাই কোন্ গলি,
এলা-লতার কেয়াপাতার খবর তো সব মঙ্গলই?
---ভালো কথা, দেখলে পথে সবাই তোমায় বন্দে তো,---
বন্ধু বলে' চিনতে কারো হয়নি তো ভাই সন্দেহ?
নরনারী তোমার মোহে তেমনি তো সব ভুল করে---
তেমনিতর পরস্পরের মনের বনে ফুল ধরে!
আসতে যেতে দীঘির পথে তেমনি নারীর ছল করা ;
পথিকবধুর চোখের কোণে তেমনি তো সেই জলভরা?
* * * * * *
রঙ্গনে সেই রং তো আছে, অশোকে তাই ফুটছে তো,
শাখায় তারি দুলতে দোলায় তরুণীদল জুটছে তো?
তোমায় দেখে' তেমনি দেখে উঠছে তো সব বিহঙ্গ,
সবুজ ঘাসের শীষটি বেয়ে রয় তো চেয়ে পতঙ্গ?
তেমনি---সবই তেমনি আছে! --- হ'লাম শুনে' খুব খুশী,
প্রাণটা ওঠে চনচনিয়ে, মনটা ওঠে উসখুসি', ---
নূতন রসে রসল হৃদয়, রক্ত চলে চঞ্চলি', ---
বন্ধু তোমায় অর্ঘ্য দিলাম উচ্ছলিত অঞ্জলি |
গ্রহণ করো, গ্রহণ করো---বন্ধু আমার দণ্ডেকের---
জানিনাক আবার কবে দেখা তোমার সঙ্গে ফের ||
স্বপ্ন দেশ
আজ ফাল্গুনী চাঁদের জ্যোছনা-জুয়ারে ভুবন ভাসিয়া যায়,
ওরে স্বপন-দেশের পরী-বিহঙ্গী, পাখা মেলে উড়ে' যায়'!
এই শ্যামল কোমল ঘাসে এই বিকচ পুন্দরাশে
এই বন-মল্লিকাবাসে, এই ফুরফুরে মলয়ায়---
তোর তারালোক হ'তে কিরণ-সুতায় ধীরে ধীরে নেমে আয়ে |
দেখ্ ঘাসের ডাঁটায় ফড়িং ঘুমায় সবুজ-স্বপন-সুখে,
দেখ্ পদ্মকোরকে অচেতন অলি শেষ মধুকণা মুখে!
হেথা ঝিঁঝির ঝি ঝিট তান, দেখ নিশি শেষে অবসান,
ছোট টুনটুনিদের গান এবে বিরত ক্লান্ত বুকে ;---
দেখ্ মোহ-মুর্ছিত মুখর ধরণী, সব ধ্বনি গেছে চুকে' ||
তোরে শিরীষ-ফুলের পাপড়ি খসায়ে পরাগ করিব দান,
তোরে রজনীগন্ধা গেলাস ভরিয়া অমিয়া করাব পান ;
শেষে ঘুম যদি তোর পায় হোথা ঘুমাবি হিন্দোলায়,
মোরা মৃদু দোল দিব তায়, গাহি' মৃদু-গুঞ্জন গান,---
চারু ঊর্ণনাভের ঝিকিমিকি জালে কেশরের উপাধান |
শেষে জোনাকির আলো নিভাবে যখন ঊষার কুয়াশাসারে,
মোরা স্বপন-শয়ন ভাঙি' দিব তোর পাপিয়ার ঝংকারে!
যদি ফিরে' যেতে মন চায়, যাস্ ঝিরি ঝিরি ঊষা-বায়,
চড়ি' প্রজাপতির পাখায়--- হিম সিক্ত শিশিরধারে ;
সাথে নিয়ে যাস্ এই রজনীর স্মৃতি ধরণীর পরপারে ||
যৌবন-চাঞ্চল্য
ভুটিয়া যুবতি চলে পথ ;
আকাশ কালিমামাখা কুয়াশায় দিক ঢাকা |
চারিধারে কেবলই পর্বত ;
যুবতী একেলা চলে পথ |
এদিক-ওদিক চায় গুনগুনি গান গায়,
কভু বা চমকি চায় ফিরে ;
গতিতে ঝরে আনন্দ উথলে নৃত্যের ছন্দ
আঁকাবাঁকা গিরিপথ ঘিরে |
ভুটিয়া যুবতি চলে পথ |
টসটসে রসে ভরপুর---
আপেলের মত মুখ আপেলের মত বুক
পরিপূর্ণ প্রবল প্রচুর ;
যৌবনের রসে ভরপুর |
মেঘ ডাকে কড়-কড় বুঝিবা আসিবে ঝড়,
একটু নাহিকো ডর তাতে ;
উঘারি বুকের বাস, পুরায় বিচিত্র আশ
উরস পরশি নিজ হাতে!
অজানা ব্যাথায় সুমধুর---
সেথা বুঝি করে গুরুগুরু!
যুবতি একেলা পথ চলে ;
পাশের পলাশ-বনে কেন চায় অকারণে?
আবেশে চরণ দুটি টলে---
পায়ে-পায়ে বাধিয়া উপলে!
আপনার মনে যায় আপনার মনে গায়,
তবু কেন আনপানে টান?
করিতে রসের সৃষ্টি চাই কি দশের দৃষ্টি?
---স্বরূপ জানেন ভগবান!
সহজে নাচিয়া যেবা চলে
একাকিনী ঘন বনতলে---
জানি নাকো তারো কী ব্যাথায়
আঁখিজলে কাজল ভিজায়!
খোকার বিড়াল ছানা
[মুকুল, অগ্রহায়ণ, ১৩০২]
সোনার ছেলে খোকামণি, তিনটি বিড়াল তার,
একডণ্ড নাহি তাদের করবে চোখের আড় |
খেতে শুতে সকল সময় থাকবে তারা কাছে,
না হ'লে কি খোকামণির খাওয়া দাওয়া আছে?
এত আদর পেয়ে বিড়াছানাগুলি,
দাদা, দিদি, মাসি, পিসি সকল গেছে ভুলি |
সোনামুখী, সোহাগিনী, চাঁদের কণা ব'লে
ডাকে খোকা, ছানাগুলি যায় আদরে গলে |
"সোনামুখী" সবার বড় খোকার কোলে বসে,
"সোহাগিনী" ছোটো যেটি বসে মাথার পাশে |
মাঝখানেতে মানে মানে বসে' "চাঁদের কণা",
একে একে সবাই কোলে করবে আনাগোনা |
দাদার চিঠি
[মুকুল, কার্তিক, ১৩০২]
আয়রে মনা, ভুতো, বুলী আয়রে তাড়াতাড়ি,
দাদার চিঠি এসেছে আজ, শুনাই তোদের পড়ি |
"কলকাতাতে এসেছি ভাই কালকে সকাল বেলা,
হেথায় কত গাড়ি, ঘোড়া, কত লোকের মেলা |
পথের পাশে সারি সারি দু'কাতারে বাড়ি
দিন রাত্তির হুস্ হুস্ করে ছুটেছে রেল গাড়ি |
আমি কি ভাই গেছি বুলে তোদের মলিন মুখ,
মনে পড়লে এখনও যে কেঁপে ওঠে বুক |
সেই যে মায়ের জলে ভরা স্নেহের নয়ন দু'টি
সেই যে আমার হাতটি ছেড়ে দিতে চায় নি পুঁটি---
ভূতি মনার আবদারে ভাব, দাদা, কোথায় যাবে?
যদি তুমি যেতে চাও তো সঙ্গে মোদের নেবে |"
সেই যে বুলী ঠোঁট কাপায়ে চুলের গোছা ছেড়ে
"যেতে নাহি দিব" ব'লে দাঁড়িয়েছিল দোরে---
সেই যে নলিন ষ্টেশন ঘরে চোখে কাপড় দিয়ে
কাঁদছিলি তুই হাতখানি মোর তোর হাতেতে নিয়ে |
সে সব কথা মনে প'ড়ে চোখে আসছে জল
দিনে দিনে কমে যাচ্ছে ভরা বুকের বল |
এসব কথা মায়ের কাছে বলো নাক' ভাই,
আজকে আমি এখান হ'তে বিদায় হ'তে চাই |
আর এক কথা, নিয়মমত লিখো আমায় চিঠি
কেমন আছে ভূতি, মনা, বুলী, ছোট পুঁটি?
মা বাবাকে প্রণাম দিয়ে বলবে আমার কথা,
সিটি কলেজ খুললে আমি ভর্তি হব তথা |
দু'চার দিন আর আছে বাকি, ভাল আছি আমি
আমার হ'য়ে ভাইবোনদের চুমু দিও তুমি |
বিদেশ এলে বুঝতে পারবে কেমন করে প্রাণ,
বুঝেছি ভাই কাকে ব'লে এক রক্তের টান |
এখন আমার চোখের কাছে যেন জগত্খানা
ভাসছে নিয়ে ভূতো, পুঁটি, বুলী, ননী, মনা |'
বসন্তে
[ব্রহ্মবাদী, ফাল্গুন ও চৈত্র ১৩২৭]
উত্সব গান, মধুময় তান
আকাশ ধরণী-তলে
কুঞ্জে কুঞ্জে বিহগ কণ্ঠে
লতায় পাতায় ফুলে |
হৃদয়ে সবার দিয়েছে রে দোল
নাচিয়া উঠিছে প্রাণ,
(এ যে) নূতন দেশের মোহন ঝঙ্কার
নূতন দেশের গান |
এ বসন্ত কার, দিতেছে বাহার
চেতনার ঢেউ খুলি
কেবা আপনার, কেবা পর আর
ব্যবধান গেছে খুলি
আজ সে এসেছে দেবদূত হয়ে
জাগাতে সহস্র প্রাণ,
কে আসিবি আয়, ওই শোনা যায়
আনন্দময়ের গান |
কে বাঁচিবি আয়, বাতাসে বাতাসে
পরশে চেতনা জাগে ;
কে বাঁচিবি আয়, হৃদয়ে হৃদয়ে,
আজি নব অনুরাগে |
মায়ের প্রতি
[প্রবাসী, ৬ষ্ট ভাগ, ২য় সংখ্যা, জ্যৈষ্ঠ ১৩১৩]
তোমার বন্দিনী মূর্তি ফুটিল যখন,
দীপ্ত দিবালোকে,
সহস্র ভায়ের প্রাণ উঠিল শিহরি,
ঘৃণা, লজ্জা, শোকে |
পবিত্র বন্দনমন্ত্রে কম্পিত বাংলা
দূর আর্য ভূমি!
মুক্তকণ্ঠে যুক্তকরে ডাকিছে তোমায়,
হে লজ্জাবারিণী--- |
সাধনার ধন তুমি ভারতবাসীর,---
সহস্র পীড়নে,
উপবাসে, অনশনে ভোলে নাই তোমা |
দুর্বল সন্তানে
দিব্য মন্ত্রে দিব্য স্নেহে দাও স্থান আজি
মন্দিরে তোমার ;
যায় যাক্ থাক্ প্রাণ, সে মন্ত্র শুনিয়া
জাগিব আবার--- |
হিমাচল হবে দূর কুমারিকা পার
কাননে, প্রান্তরে,
নগরে-নগরে ক্ষুদ্র প্রল্লীতে-পল্লীতে,
প্রাসাদে কুটিরে,
কোটি কোটি মৃত প্রাণ, হোমাগ্নির প্রায়
উঠুক জ্বলিয়া,
মা তোর তাপসী-মূর্তি পূজিবে সন্তান
হিয়া রক্ত দিয়া |
বন্দনা
[ব্রহ্মবাদী, ভাদ্র ও আশ্বিন, ১৩০৮]
বিশ্ব আঁধার ভেদিয়া করে বন্দনা
নবীন রক্ত তপন মহান আলোকে |
গরজি গভীর স্বননে ধায় পারাবার
চুমিতে চরণতল অতুল পুলকে!
বনে উপবনে ফোটে কত ফুল
শিশিরসিক্ত নব-লাবণ্যে ভরিয়া
পরিমল শোভা সকলি বিকশি উঠে
তব মধুর পরশ লাগিয়া
দিগ্ দিগন্তে চুমিয়া বহে সমীরণ
কাহারে খুঁজিছে সে দিশেহারা ?
শান্ত উদার গগনে, অযুত অযুত তারকা
কৌতুকভরে নেহারে কাহারে তারা ?
কুলকুলু নাদে তটিনী ছুটিছে
তার বক্ষে বিপুল বাসনা
প্রেম-পাগল হিয়াখানি আজি
ওই চরণে করিবে লগনা |
গীতগন্ধ ছন্দোময় বিশ্ব
কত বন্দন পাঠায় তোমারি কাছে |
ওগো গম্ভীর, ওগো সুন্দর, ভূবনবাঞ্ছিত
কি দিবে দীন, শুধু করুণা যাচে |
উদ্বোধন
[মুকুল, ১৩০২ ~ ১৩১১]
বঙ্গের ছেলে-মেয়ে জাগো, জাগো, জাগো,
পরের করুণা কেন শুধু মাগো---
আপনারে বলে নির্ভর রাখো
হবে জয় নিশ্চয়---
চারিদিকে হেরো কী দুঃখ-দুর্দিন,
কত ভাই বোন অন্ন-বস্ত্র-হীন,
সোনার বাংলা হয়েছে মলিন
কী দীরুণ বেদনায়---
তোমরা জাগিয়া দুঃখ ঘুচালে,
সকলের ব্যথা সকলে বুঝিলে
ত্যাগ, একতায় জাগিয়া উঠিলে,
তবে বঙ্গ রক্ষা পায় |
পৃথিবী জুড়িয়ে যত অভিযান
সকলেই চায় দেশের কল্যাণ (সম্মান)
জননী জন্মভূমির উত্থান,
মানুষ যে সে-ই চায় |
সাধন পথে
[ব্রহ্মবাদী, ভাদ্র, ১৩৪৩]
এক বিন্দু অমৃতের লাগি
কি আকুল পিপাসিত হিয়া,
এক বিন্দু শান্তির লাগিয়া
কর্মক্লান্ত দুটি বাহু দিয়া---
কাজ শুধু করে যায়
অন্তরেতে দুরন্ত সাধনা,
তুমি তার দীর্ঘ পথে
হবে সাথী একান্ত ভাবনা |
সে জানে এ আরাধনা
কবে তার হইবে সফল ;
তব বাণী যেই দিন তারি
ভাষা হয়ে ঘুচাবে সকল
অন্তরের অহঙ্কার,
স্তুতি, নিন্দা, ভয়
সেদিন লভিবে শান্তি,
সংগ্রামে বিজয় |
তোমার স্বরূপে তার রূপ হবে লীন!
সেই তার সাধনার পরম সুদিন |
অরূপের রূপ
[ব্রহ্মবাদী, শ্রাবণ, ১৩৪৩]
রূপসিন্ধু মাঝে হেরি অরূপ তোমায়,
হৃদয় ভরিয়া গেল সুধার ধারায়!
কোন্ মৃত্তিকায় খুঁজি কোন তীর্থ-নীরে,
স্ব-প্রকাশ বিরাজিত বিশ্বের মন্দিরে---
উদার আকাশ তল, সিন্ধুর সুনীল জল,
ওই গিরি নির্ঝরিনী অশ্রান্ত উচ্ছল |
প্রান্তর দিগন্ত-লীন শ্যামা মধুরিমা,
প্রকৃতির অঙ্গে অঙ্গে কার এ সুষমা?
হায়রে সম্বলহীন, কুণ্ঠা ছিল মনে---
তাঁর দেখা পাবি তুই কবে কোনখানে?
শত হস্ত বাড়ায়ে যে ধরিবারে চায়,
"পাই নাই" বলে তারে দিবি কি বিদায়?
অন্তরে বাহিরে হের অপূর্ব্ব আলোকে
তাঁরি জ্যোতির্ময় রূপ, দ্য়ুলোকে ভূলোকে!
আমাদের মা
আমাদের মাকে আমরা বলতাম তুমি, বাবাকে আপনি।
আমাদের মা গরিব প্রজার মত দাঁড়াতো বাবার সামনে,
কথা বলতে গিয়ে কখনোই কথা শেষ ক’রে উঠতে পারতোনা।
আমাদের মাকে বাবার সামনে এমন তুচ্ছ দেখাতো যে
মাকে আপনি বলার কথা আমাদের কোনোদিন মনেই হয়নি।
আমাদের মা আমাদের থেকে বড় ছিলো, কিন্তু ছিলো আমাদের সমান।
আমাদের মা ছিলো আমাদের শ্রেনীর, আমাদের বর্ণের, আমাদের গোত্রের।
বাবা ছিলেন অনেকটা আল্লার মতো, তার জ্যোতি দেখলে আমরা সেজদা দিতাম
বাবা ছিলেন অনেকটা সিংহের মতো, তার গর্জনে আমরা কাঁপতে থাকতাম
বাবা ছিলেন অনেকটা আড়িয়াল বিলের প্রচন্ড চিলের মতো, তার ছায়া দেখলেই
মুরগির বাচ্চার মতো আমরা মায়ের ডানার নিচে লুকিয়ে পড়তাম।
ছায়া সরে গেলে আবার বের হয়ে আকাশ দেখতাম।
আমাদের মা ছিলো অশ্রুবিন্দু-দিনরাত টলমল করতো
আমাদের মা ছিলো বনফুলের পাপড়ি;-সারাদিন ঝরে ঝরে পড়তো,
আমাদের মা ছিলো ধানখেত-সোনা হয়ে দিকে দিকে বিছিয়ে থাকতো।
আমাদের মা ছিলো দুধভাত-তিন বেলা আমাদের পাতে ঘন হয়ে থাকতো।
আমাদের মা ছিলো ছোট্ট পুকুর-আমরা তাতে দিনরাত সাঁতার কাটতাম।
আমাদের মার কোনো ব্যক্তিগত জীবন ছিলো কিনা আমরা জানি না।
আমাদের মাকে আমি কখনো বাবার বাহুতে দেখি নি।
আমি জানি না মাকে জড়িয়ে ধরে বাবা কখনো চুমু খেয়েছেন কি না
চুমু খেলে মার ঠোঁট ওরকম শুকনো থাকতো না।
আমরা ছোট ছিলাম, কিন্তু বছর বছর আমরা বড় হতে থাকি,
আমাদের মা বড় ছিলো, কিন্তু বছর বছর মা ছোটো হতে থাকে।
ষষ্ঠ শ্রেনীতে পড়ার সময়ও আমি ভয় পেয়ে মাকে জড়িয়ে ধরতাম।
সপ্তম শ্রেনীতে ওঠার পর ভয় পেয়ে মা একদিন আমাকে জড়িয়ে ধরে।
আমাদের মা দিন দিন ছোটো হতে থাকে
আমাদের মা দিন দিন ভয় পেতে থাকে।
আমাদের মা আর বনফুলের পাপড়ি নয়, সারাদিন ঝরে ঝরে পড়েনা
আমাদের মা আর ধানখেত নয়, সোনা হয়ে বিছিয়ে থাকে না
আমাদের মা আর দুধভাত নয়, আমরা আর দুধভাত পছন্দ করিনা
আমাদের মা আর ছোট্ট পুকুর নয়, পুকুরে সাঁতার কাটতে আমরা কবে ভুলে গেছি।
কিন্তু আমাদের মা আজো অশ্রুবিন্দু, গ্রাম থেকে নগর পর্যন্ত
আমাদের মা আজো টলমল করে।
গোলামের গর্ভধারিণী
আপনাকে দেখিনি আমি; তবে আপনি
আমার অচেনা
নন পুরোপুরি, কারণ বাঙলার
মায়েদের আমি
মোটামুটি চিনি, জানি। হয়তো
গরিব পিতার ঘরে
বেড়ে উঠেছেন দুঃক্ষিণী
বালিকারূপে ধীরেধীরে;
দুঃক্ষের সংসারে কুমড়ো ফুলের
মতো ফুটেছেন
ঢলঢল, এবং সন্ত্রস্ত ক’রে
তুলেছেন মাতা
ও পিতাকে। গরিবের ঘরে ফুল
ভয়েরই কারণ।
তারপর একদিন ভাঙা পালকিতে চেপে
দিয়েছেন
পাড়ি, আর এসে উঠেছেন আরেক গরিব
ঘরে;
স্বামীর আদর হয়তো ভাগ্যে
জুটেছে কখনো, তবে
অনাদর জুটেছে অনেক। দারিদ্র্য,
পীড়ন, খণ্ড
প্রেম, ঘৃণা, মধ্যযুগীয়
স্বামীর জন্যে প্রথাসিদ্ধ
ভক্তিতে আপনার কেটেছে জীবন।
বঙ্গীয় নারীর
আবেগে আপনিও চেয়েছেন বুক জুড়ে
পুত্রকন্যা,
আপনার মরদ বছরে একটা নতুন
ঢাকাই
শাড়ি দিতে না পারলেও বছরে বছরে
উপহার
দিয়েছেন আপনাকে একের পর এক
কৃশকায়
রুগ্ন সন্তান, এবং তাতেই আপনার
শুষ্ক বুক
ভাসিয়ে জেগেছে তিতাসের তীব্র
জলের উচ্ছ্বাস।
চাঁদের সৌন্দর্য নয়, আমি জানি
আপনাকে মুগ্ধ
আলোড়িত বিহ্বল করেছে সন্তানের
স্নিগ্ধ মুখ,
আর দেহের জ্যোৎস্না। আপনিও
চেয়েছেন জানি
আপনার পুত্র হবে সৎ, প্রকৃত
মানুষ। তাকে
দারিদ্র্যের কঠোর কামড় টলাবে
না সততার
পথ থেকে, তার মেরুদণ্ড হবে দৃঢ়,
পীড়নে বা
প্রলোভনে সে কখনো বুটদের সেজদা
করবে না।
আপনার উচ্চাভিলাষ থাকার তো কথা
নয়, আপনি
আনন্দিত হতেন খুবই আপনার পুত্র
যদি হতো
সৎ কৃষিজীবী, মেরুদণ্ডসম্পন্ন
শ্রমিক, কিংবা
তিতাসের অপরাজেয় ধীবর। আপনি
উপযুক্ত
শিক্ষা দিতে পারেন নি
সন্তানকে;- এই পুঁজিবাদী
ব্যবস্থায় এটাই তো স্বাভাবিক,
এখানে মোহর
ছাড়া কিছুই মেলে না, শিক্ষাও
জোটে না। তবে এতে
আপনার কোনো ক্ষতি নেই জানি;
কারণ আপনি
পুত্রের জন্যে কোনো রাজপদ, বা ও
রকম কিছুই
চান নি, কেবল চেয়েছেন আপনার
পুত্র হোক
সৎ, মেরুদণ্ডী, প্রকৃত মানুষ।
আপনার সমস্ত
পবিত্র প্রার্থনা ব্যর্থ ক’রে
বিশশতকের এই
এলোমেলো অন্ধকারে আপনার পুত্র
কী হয়েছে
আপনি কি তা জানেন তা, হে অদেখা
দরিদ্র জননী?
কেনো আপনি পুত্রকে
পাঠিয়েছিলেন মুঘলদের
এই ক্ষয়িষ্ণু শহরে, যেখানে
কৃষক এসে লিপ্ত
হয় পতিতার দালালিতে, মাঠের
রাখাল তার
নদী আর মাঠ হ’য়ে ওঠে হাবশি
গোলাম?
আপনি কি জানেন, মাতা, আপনার
পুত্র শহরের
অন্যতম প্রসিদ্ধ গোলাম আজ?
আপনি এখন
তাকে চিনতেও ব্যর্থ হবেন,
আপনার পুত্রের দিকে
তাকালে এখন কোনো মস্তক পড়ে না
চোখে, শুধু
একটা বিশাল কুঁজ চোখে পড়ে।
দশকে দশকে
যতো স্বঘোষিত প্রভু দেখা
দিয়েছেন মুঘলদের
এ-নষ্ট শহরে, আপনার পুত্র তাদের
প্রত্যেকের
পদতলে মাথা ঠেকিয়ে ঠেকিয়ে
পৃষ্ঠদেশ জুড়ে
জন্মিয়েছে কুঁজ আর কুঁজ; আজ তার
পৃষ্ঠদেশ
একগুচ্ছ কুঁজের সমষ্টি;-
মরুভূমিতে কিম্ভুত
বহুকুঁজ উটের মতোই এখন দেখায়
তাকে।
সে এখন শহরের বিখ্যাত গোলাম
মজলিশের
বিখ্যাত সদস্য, গোলামিতে সে ও
তার ইয়ারেরা
এতোই দক্ষ যে প্রাচীন,
ঐতিহাসিক গোলামদের
গৌরব হরণ ক’রে তারা আজ মশহুর
গোলাম
পৃথিবীর। এখন সে মাথা তার
তুলতে পারে না,
এমনকি ভুলেও গেছে যে একদা তারও
একটি
মাথা ছিলো, এখন সে বহুশীর্ষ
কুঁজটিকেই মাথা
ব’লে ভাবে। খাদ্যগ্রহণের পর
স্বাভাবিক পদ্ধতিও
বিস্মৃত হয়েছে সে, প্রভুদের
পাদুকার তলে
প’ড়ে থাকা অন্ন চেটে খাওয়া ছাড়া
আর কিছুতেই
পরিতৃপ্তি পায় না আপনার পুত্র,
একদা আপনার
স্তন থেকে মধুদুগ্ধ শুষে নিয়ে
জীবন ধারণ
করতো যে বালক বয়সে। এখন সে
শত্রু পাখি
ও নদীর, শত্রু মানুষের, এমন কি
সে আপনার
স্তন্যেরও শত্রু। তার জন্য
দুঃক্ষ করি না, কতোই
তো গোলাম দেখলাম এ-বদ্বীপে
শতকে শতকে।
কিন্তু আপনার জন্যে, হে গরিব
কৃষক-কন্যা, দুঃক্ষী
মাতা, গরিব-গৃহিণী, আপনার জন্যে
বড় বেশি
দুঃখ পাই;- আপনার পুত্রের
গোলামির বার্তা আজ
রাষ্ট্র দিকে দিকে, নিশ্চয়ই তা
পৌঁছে গেছে তিতাসের
জলের গভীরে আর কুমড়োর খেতে,
লাউয়ের
মাঁচায়, পাখির বাসা আর চাষীদের
উঠানের কোণে।
তিতাসের জল আপনাকে দেখলে ছলছল
ক’রে
ওঠে, ‘ওই দ্যাখো গোলামের
গর্ভধারিণীকে’; মাঠে
পাখি ডেকে ওঠে, ‘দ্যাখো গোলামের
গর্ভধারিণীকে’;
আপনার পালিত বেড়াল দুধের বাটি
থেকে
দু-চোখ ফিরিয়ে বলে, ‘গোলামের
গর্ভধারিণীর
হাতের দুগ্ধ রোচে না আমার জিভে’,
প্রতিবেশী
পুরুষ-নারীরা অঙ্গুলি সংকেত
ক’রে কলকণ্ঠে
বলে, ‘দ্যাখো গোলামের
গর্ভধারিণীকে।’ এমন কি
প্রার্থনার সময়ও আপনি হয়তো বা
শুনতে পান
‘গোলামের গর্ভধারিণী, ধারিণী’
স্বর ঘিরে ফেলছে
চারদিক থেকে। আপনি যখন অন্তিম
বিশ্রাম
নেবেন মাটির তলে তখনো হয়তো
মাটি ফুঁড়ে
মাথা তুলবে ঘাসফুল, বাতাসের
কানে কানে ব’লে
যাবে, ‘এখানে ঘুমিয়ে আছেন এক
গর্ভধারিণী
গোলামের।’ ভিজে উঠবে মাটি
ঠাণ্ডা কোমল অশ্রুতে।
কী দোষ আপনার? মা কি কখনোও জানে
দশমাস
ধ’রে যাকে সে ধারণ করছে সে মানুষ
না গোলাম?
কখনো আমি
কখনো আমি স্বপ্ন দেখি যদি
স্বপ্ন দেখবো একটি বিশাল নদী।
নদীর ওপর আকাশ ঘন নীল
নীলের ভেতর উড়ছে গাঙচিল।
আকাশ ছুঁয়ে উঠছে কেবল ঢেউ
আমি ছাড়া চারদিকে নেই কেউ।
কখনো আমি কাউকে যদি ডাকি
ডাকবো একটি কোমল সুদূর পাখি।
পাখির ডানায় আঁকা বনের ছবি
চোখের তারায় জ্বলে ভোরের রবি।
আকাশ কাঁপে পাখির গলার সুরে
বৃষ্টি নামে সব পৃথিবী জুড়ে।
সিংহ গাধা ও অন্যান্য
১.
মানুষ সিংহের প্রশংসা করে,
তবে গাধাকেই আসলে পছন্দ করে।
আমার প্রতিভাকে প্রশংসা করলেও
ওই পুঁজিপতি গাধাটাকেই
আসলে পছন্দ কর তুমি।
২.
তোমাকে নিয়ে এতোগুলো কবিতা লিখেছি।
তার গোটাচারি শিল্পোত্তীর্ণ
আর অন্তত একটি কালোত্তীর্ণ।
এতেই সবাই বুঝবে তোমাকে আমি পাই নি কখনো।
৩.
প্রাক্তন দ্রোহীরা যখন অর্ঘ্য পায়
তাদের কবরে যখন স্মৃতিস্তম্ভ মাথা তোলে
নতুন বিদ্রোহীরা কারাগারে ঢোকে
আর ফাঁসিকাঠে ঝোলে।
৪.
মেয়ে, তোমার সুন্দর মনের থেকে
অনেক আকর্ষণীয়
তোমার সুন্দর শরীর।
৫.
যখন তোমার রিকশা উড়ে আসে
সামনের দিক থেকে প্রজাপতির মতো
তখন পেছন দিক থেকে দানবের মতো ছুটে আসে
একটা লকলকে জিভের ট্রাক
প্রজাপতি আর দানবের মধ্যে আমি পিষ্ঠ চিরকাল।
আমার কুঁড়েঘরে
আমার কুঁড়েঘরে নেমেছে শীতকাল
তুষার জ’মে আছে ঘরের মেঝে জুড়ে বরফ প’ড়ে আছে
গভীর ঘন হয়ে পাশের নদী ভ’রে
বরফ ঠেলে আর তুষার ভেঙে আর দু-ঠোঁটে রোদ নিয়ে
আমার কুঁড়েঘরে এ-ঘন শীতে কেউ আসুক
আমার গ্রহ জুড়ে বিশাল মরুভূমি
সবুজ পাতা নেই সোনালি লতা নেই শিশির কণা নেই
ঘাসের শিখা নেই জলের রেখা নেই
আমার মরুভূর গোপন কোনো কোণে একটু নীল হয়ে
বাতাসে কেঁপে কেঁপে একটি শীষ আজ উঠুক
আমার গাছে গাছে আজ একটি কুঁড়ি নেই
একটি পাতা নেই শুকনো ডালে ডালে বায়ুর ঘষা লেগে
আগুন জ্ব’লে ওঠে তীব্র লেলিহান
বাকল ছিঁড়েফেড়ে দুপুর ভেঙেচুরে আকাশ লাল ক’রে
আমার গাছে আজ একটা ছোট ফুল ফুটুক
আমার এ-আকাশ ছড়িয়ে আছে ওই
পাতটিনের মতো ধাতুর চোখ জ্বলে প্রখর জ্বালাময়
সে-তাপে গ’লে পড়ে আমার দশদিক
জল ও বায়ুহীন আমার আকাশের অদেখা দূর কোণে
বৃষ্টিসকাতর একটু মেঘ আজ জমুক
আমার কুঁড়েঘরে নেমেছে শীতকাল
তুষার জ’মে আছে ঘরের মেঝে জুড়ে বরফ প’ড়ে আছে
গভীর ঘন হয়ে পাশের নদী ভ’রে
বরফ ঠেলে আর তুষার ভেঙে আজ দু-ঠোঁটে রোদ নিয়ে
আমার কুঁড়েঘরে এ-ঘন শীতে কেউ আসুক
গরীবের সৌন্দর্য
গরিবেরা সাধারণত সুন্দর হয় না।
গরিবদের কথা মনে হ’লে সৌন্দর্যের কথা মনে পড়ে না কখনো।
গরিবদের ঘরবাড়ি খুবই নোংরা, অনেকের আবার ঘরবাড়িই নেই।
গরিবদের কাপড়চোপড় খুবই নোংরা, অনেকের আবার কাপড়চোপড়ই নেই।
গরিবেরা যখন হাঁটে তখন তাদের খুব কিম্ভুত দেখায়।
যখন গরিবেরা মাটি কাটে ইট ভাঙে খড় ঘাঁটে গাড়ি ঠেলে পিচ ঢালে তখন তাদের
সারা দেহে ঘাম জবজব করে, তখন তাদের খুব নোংরা আর কুৎসিত দেখায়।
গরিবদের খাওয়ার ভঙ্গি শিম্পাঞ্জির ভঙ্গির চেয়েও খারাপ।
অশ্লীল হাঁ ক’রে পাঁচ আঙ্গুলে মুঠো ভ’রে সব কিছু গিলে ফেলে তারা।
থুতু ফেলার সময় গরিবেরা এমনভাবে মুখ বিকৃত করে
যেনো মুখে সাতদিন ধ’রে পচছিলো একটা নোংরা ইঁদুর।
গরিবদের ঘুমোনোর ভঙ্গি খুবই বিশ্রী।
গরিবেরা হাসতে গিয়ে হাসিটাকেই মাটি ক’রে ফেলে।
গান গাওয়ার সময়ও গরিবদের একটুও সুন্দর দেখায় না।
গরিবেরা চুমো খেতেই জানে না, এমনকি শিশুদের চুমো খাওয়ার সময়ও
থকথকে থুতুতে তারা নোংরা করে দেয় ঠোঁট নাক গাল।
গরিবদের আলিঙ্গন খুবই বেঢপ।
গরিবদের সঙ্গমও অত্যন্ত নোংরা, মনে হয় নোংরা মেঝের ওপর
সাংঘাতিকভাবে ধ্বস্তাধ্বস্তি করছে দু’টি উলঙ্গ অশ্লীল জন্তু।
গরিবদের চুলে উকুন আর জট ছাড়া কোনো সৌন্দর্য নেই।
গরিবদের বগলের তলে থকথকে ময়লা আর বিচ্ছিরি লোম সব জড়াজড়ি করে।
গরিবদের চোখের চাউনিতে কোনো সৌন্দর্য নেই,
চোখ ঢ্যাবঢ্যাব ক’রে তারা চারদিকে তাকায়।
মেয়েদের স্তন খুব বিখ্যাত, কিন্তু গরিব মেয়েদের স্তন শুকিয়ে শুকিয়ে
বুকের দু-পাশে দুটি ফোড়ার মতো দেখায়।
অর্থাৎ জীবনযাপনের কোনো মুহূর্তেই গরিবদের সুন্দর দেখায় না।
শুধু যখন তারা রুখে ওঠে কেবল তখনি তাদের সুন্দর দেখায়
বাঙলা ভাষা
শেকলে বাঁধা শ্যামল রূপসী, তুমি-আমি, দুর্বিনীত দাসদাসী-
একই শেকলে বাঁধা প’ড়ে আছি শতাব্দীর পর শতাব্দী।
আমাদের ঘিরে শাঁইশাঁই চাবুকের শব্দ, স্তরে স্তরে শেকলের ঝংকার।
তুমি আর আমি সে-গোত্রের যারা চিরদিন উৎপীড়নের মধ্যে গান গায়-
হাহাকার রূপান্তরিত হয় সঙ্গীতে-শোভায়।
লকলকে চাবুকের আক্রোশ আর অজগরের মতো অন্ধ শেকলের
মুখোমুখি আমরা তুলে ধরি আমাদের উদ্ধত দর্পিত সৌন্দর্য:
আদিম ঝরনার মতো অজস্র ধারায় ফিনকি দেয়া টকটকে লাল রক্ত,
চাবুকের থাবায় সুর্যের টুকরোর মতো ছেঁড়া মাংস
আর আকাশের দিকে হাতুড়ির মতো উদ্যত মুষ্টি।
শাঁইশাঁই চাবুকে আমার মিশ্র মাংসপেশি পাথরের চেয়ে শক্ত হয়ে ওঠে
তুমি হয়ে ওঠো তপ্ত কাঞ্চনের চেয়েও সুন্দর।
সভ্যতার সমস্ত শিল্পকলার চেয়ে রহস্যময় তোমার দু-চোখ
যেখানে তাকাও সেখানেই ফুটে ওঠে কুমুদকহ্লার
হরিণের দ্রুত ধাবমান গতির চেয়ে সুন্দর ওই ভ্রূযুগল
তোমার পিঠে চাবুকের দাগ চুনির জড়োয়ার চেয়েও দামি আর রঙিন
তোমার দুই স্তন ঘিরে ঘাতকের কামড়ের দাগ মুক্তোমালার চেয়েও ঝলোমলো
তোমার ‘অ, আ’ –চিৎকার সমস্ত আর্যশ্লোকের চেয়েও পবিত্র অজর
তোমার দীর্ঘশ্বাসের নাম চন্ডীদাস
শতাব্দী কাঁপানো উল্লাসের নাম মধুসূদন
তোমার থরোথরো প্রেমের নাম রবীন্দ্রনাথ
বিজন অশ্রুবিন্দুর নাম জীবনানন্দ
তোমার বিদ্রোহের নাম নজরুল ইসলাম
শাঁইশাঁই চাবুকের আক্রোশে যখন তুমি আর আমি
আকাশের দিকে ছুঁড়ি আমাদের উদ্ধত সুন্দর বাহু, রক্তাক্ত আঙুল,
তখনি সৃষ্টি হয় নাচের নতুন মুদ্রা;
ফিনকি দেয়া লাল রক্ত সমস্ত শরীরে মেখে যখন আমরা গড়িয়ে পড়ি
ধূসর মাটিতে এবং আবার দাঁড়াই পৃথিবীর সমস্ত চাবুকের মুখোমুখি,
তখনি জন্ম নেয় অভাবিত সৌন্দর্যমন্ডিত বিশুদ্ধ নাচ;
এবং যখন শেকলের পর শেকল চুরমার ক’রে ঝনঝন ক’রে বেজে উঠি
আমরা দুজন, তখনি প্রথম জন্মে গভীর-ব্যাপক-শিল্পসম্মত ঐকতান-
আমাদের আদিগন্ত আর্তনাদ বিশশতকের দ্বিতীয়ার্ধের
একমাত্র গান।
বড়োবাবুর কাছে নিবেদন
তালিকা প্রস্তুত
কী কী কেড়ে নিতে পারবে না-
হই না নির্বাসিত-কেরানি।
বাস্তুভিটে পৃথিবীটার সাধারণ অস্তিত্ব।
যার এক খন্ড এই ক্ষুদ্র চাকরের আমিত্ব।
যতদিন বাঁচি, ভোরের আকাশে চোখ জাগানো,
হাওয়া উঠলে হাওয়া মুখে লাগানো।
কুয়োর ঠান্ডা জল, গানের কান, বইয়ের দৃষ্টি
গ্রীষ্মের দুপুরে বৃষ্টি।
আপন জনকে ভালোবাসা,
বাংলার স্মৃতিদীর্ণ বাড়ি-ফেরার আশা।
তাড়াও সংসার, রাখলাম,
বুকে ঢাকলাম
জন্মজন্মান্তরের তৃপ্তি যার যোগ প্রাচীন গাছের ছায়ায়
তুলসী-মন্ডপে, নদীর পোড়ো দেউলে, আপন ভাষার কন্ঠের মায়ায়।
থার্ডক্লাসের ট্রেনে যেতে জানলায় চাওয়া,
ধানের মাড়াই, কলা গাছ, কুকুর, খিড়কি-পথ ঘাসে ছাওয়া।
মেঘ করেছে, দু-পাশে ডোবা, সবুজ পানার ডোবা,
সুন্দরফুল কচুরিপানার শঙ্কিত শোভা,
গঙ্গার ভরা জল; ছোটো নদী; গাঁয়ের নিমছায়াতীর-
হায়, এও তো ফেরা-ট্রেনের কথা।
শত শতাব্দীর
তরু বনশ্রী
নির্জন মনশ্রী :
তোমায় শোনাই, উপস্থিত ফর্দে আরো আছে-
দূর-সংসারে এলো কাছে
বাঁচবার সার্থকতা।।
তুই কি আমার দুঃখ হবি?
তুই কি আমার দুঃখ হবি?
এই আমি এক উড়নচন্ডী আউলা বাউল
রুখো চুলে পথের ধুলো
চোখের নীচে কালো ছায়া
সেইখানে তুই রাত বিরেতে স্পর্শ দিবি।
তুই কি আমার দুঃখ হবি?
তুই কি আমার শুষ্ক চোখে অশ্রু হবি?
মধ্যরাতে বেজে ওঠা টেলিফোনের ধ্বনি হবি?
তুই কি আমার খাঁ খাঁ দুপুর
নির্জনতা ভেঙে দিয়ে
ডাকপিয়নের নিষ্ঠ হাতে
ক্রমাগত নড়তে থাকা দরজাময় কড়া হবি?
একটি নীলাভ এনভেলাপে পুরে রাখা
কেমন যেন বিষাদ হবি?
তুই কি আমার শুন্য বুকে
দীর্ঘশ্বাসের বকুল হবি?
নরম হাতের ছোঁয়া হবি?
একটুখানি কষ্ট দিবি,
নীচের ঠোট কামড়ে ধরা রোদন হবি?
একটুখানি কষ্ট দিবি
প্রতীক্ষার এই দীর্ঘ হলুদ বিকেল বেলায়
কথা দিয়েও না রাখা এক কথা হবি?
একটুখানি কষ্ট দিবি
তুই কি একা আমার হবি?
তুই কি আমার একান্ত এক দুঃখ হবি?
রৌদ্রের গান
দুহাতে তীব্র সোনার মতন মদ,
যে সোনার মদ পান ক’রে ধন ক্ষেত
দিকে দিকে তার গড়ে তোলে জনপদ।
ভারতী! তোমার লাবণ্য দেহ ঢাকে
রৌদ্র তোমায় পরায় সোনার হার,
সূর্য তোমার শুকায় সবুজ চুল
প্রেয়সী, তোমার কত না অহংকার।
সারাটা বছর সূর্য এখানে বাঁধা
রোদে ঝলসায় মৌন পাহাড় কোনো,
অবাধ রোদ্রে তীব্র দহন ভরা
রৌদ্রে জ্বলুক তোমার আমার মনও।
বিদেশকে আজ ডাকো রৌদ্রের ভোজে
মুঠো মুঠো দাও কোষাগার-ভরা সোনা,
প্রান্তর বন ঝলমল করে রোদে,
কী মধুর আহা রৌদ্রে প্রহর গোনা!
রৌদ্রে কঠিন ইস্পাত উজ্জ্বল
ঝকমক করে ইশারা যে তার বুকে
শূন্য নীরব মাঠে রৌদ্রের প্রজা
স্তব করে জানি সূর্যের সম্মুখে।
পথিক-বিরল রাজপথে সূর্যের
প্রতিনিধি হাঁকে আসন্ন কলরব,
মধ্যাহ্নের কঠোর ধ্যানের শেষে
জানি আছে এক নির্ভয় উৎসব।
তাইতো এখানে সূর্য তাড়ায় রাত
প্রেয়সী, তুমি কি মেঘভয়ে আজ ভীত?
কৌতুকছলে এ মেঘ দেখায় ভয়,
এ ক্ষণিক মেঘ কেটে যাবে নিশ্চিত।
সূর্য, তোমায় আজকে এখানে ডাকি-
দুর্বল মন, দুর্বলতর কায়া,
আমি যে পুরনো অচল দীঘির জল
আমার এ বুকে জাগাও প্রতিচ্ছায়া।।
যে কথা বলতেই হবে
গুন্টার গ্রাস
অনুবাদ: সাজ্জাদ শরিফ
কেন আমি নিশ্চুপ, কেন চুপ করে আছি এতগুলি দিন
যুদ্ধ যুদ্ধ খেলায় প্রকাশ্যে যা চলছে তা নিয়ে,
যার শেষে আমরা কেউ কেউ টিকে থাকব
বড় জোর পাদটীকা হয়ে।
ইরানিদের মুছে দেওয়ার মতো
‘আগাম যুদ্ধের’ এটি কোন অধিকার?
ইরানের শক্তিবলয়ে পরমাণু বোমা আছে এই অনুমানে
যা তারা আদায় করেছে হুংকারের বশ্যতায়,
জড়ো করা হুল্লোড়ের তোড়ায়।
বছরে বছরে যারা গোপনে স্তূপ করছে পরমাণু বোমা
নিন্দা নেই, নিয়ন্ত্রণ নেই, তদন্ত নেই,
কেন আমি সে দেশের নাম নিতে এত দ্বিধান্বিত?
এ নিয়ে সবার যে মান্য নীরবতা,
যার নিচে আমারও নৈঃশব্দ মাথা নিচু,
সে তো এক অস্বস্তিকর মিথ্যা
তা আমাকে ছুড়ে দেয় অনুমেয় শাস্তির দিকে,
ছুটে আসে সহজেই ‘ইহুদিবিদ্বেষ’-এর গালাগাল।
নিজের তুলনাহীন গভীর অপরাধে
বারে বারে যার চলেছে জবাবদিহি,
আমার সে নিজের দেশের নাকি নিষ্ক্রান্তির কাল
(দিব্যি খেসারতের ছলে যা স্রেফ ব্যবসা)
আণবিক অস্ত্র নিয়ে আরেকটি ডুবোজাহাজ চলেছে ইসরায়েলে
কেবলই আতঙ্ক ছাড়া যার পরমাণু বোমার
কোনো প্রমাণ মেলেনি। আমি বলব, যে কথা বলতেই হবে।
কিন্তু কেন আমি এত দিন নীরব থেকেছি?
আমি তো ভেবেই নিয়েছিলাম আমার নিজের অতীত
যে কালিমায় নোংরা তা তো কখনোই মুছে যাবে না।
যে ইসরায়েলের সাথে আমি এতটা নিবিড় কিংবা থাকব আগামীতে,
খোলামেলা সত্যের ঘোষণা সে যে মেনে নেবে, সে আশাও নেই।
কেন এখন, এই বুড়ো বয়সে,
দোয়াতের অবশিষ্ট কালি দিয়ে বলতে হবে:
ইসরায়েলের পরমাণুশক্তি বিপন্ন করে তুলবে
এরই মধ্যে ভঙ্গুর বিশ্বশান্তিকে?
কারণ যে কথা বলতেই হবে, কাল সেটা দেরি হয়ে যাবে।
কারণ জর্মন হিসেবে আজ কাঁধে এই বোঝা—
দৃশ্যমান ভবিষ্যৎ পাপের অস্ত্র আমাদেরই দেওয়া
কোনো উপায়েই আর মুছবে না দুষ্কর্মের এই দায়ভার।
মানি, আমি নৈঃশব্দ ভেঙেছি
কারণ পশ্চিমের ভণ্ডামিতে আমি ক্লান্তপ্রাণ;
এও আশা করি হয়তো অনেকেই নীরবতা থেকে মুক্তি পাবে
হয়তো তারা দাবি তুলবে খোলামেলা বিপদের জন্য যারা দায়ী
সেই সহিংসতা বর্জনের মুখোমুখি আমরা দাঁড়াই,
ইসরায়েল ও ইরানের সরকারকে বারবার এ কথা বোঝাবে হয়তো তারা
কোনো এক বিশ্বকর্তৃপক্ষকে তারা অনুমতি দিক
দুজনের পারমাণবিক সামর্থ্য ও সম্ভাবনা খোলামেলা তদন্ত করার।
বিভ্রমশাসিত এই এলাকায় শত্রুতায় পাশাপাশি বসবাস করা
ইহুদি ও ফিলিস্তিনিদের সাহায্যের অন্য আর পথ খোলা নেই,
শেষমেশ, আমাদের কারোরই তা নেই।
প্রথম আলো ১৩-০৪-২০১২