জীবনানন্দ দাশ
কোনো এক অন্ধকারে আমি
যখন যাইব চলে — আরবার আসিব কি নামি
অনেক পিপাসা লয়ে এ মাটির তীরে
তোমাদের ভিড়ে!
কে আমারে ব্যথা দেছে — কে বা ভালোবাসে —
সব ভুলে, শুধু মোর দেহের তালাসে
শুধু মোর স্নায়ু শিরা রক্তের তরে
এ মাটির পরে
আসিব কি নেমে!
পথে পথে — থেমে — থেমে — থেমে
খুঁজিব কি তারে —
এখানের আলোয় আঁধারে
যেইজন বেঁধেছিল বাসা!
মাটির শরীরে তার ছিল যে পিপাসা
আর যেই ব্যথা ছিল — যেই ঠোট চুল
যেই চোখ, যেই হাত, আর যে আঙুল
রক্ত আর মাংসের স্পর্শসুখভরা
যেই দেহ একদিন পৃথিবীর ঘ্রাণের পসরা
পেয়েছিল — আর তার ধানী সুরা করেছিল পান,
একদিন শুনেছে যে জল আর ফসলের গান,
দেখেছে যে ঐ নীল আকাশের ছবি
মানুষ — নারীর মুখ — পুরুষ — স্ত্রীর দেহ সবই
যার হাত ছুয়ে আজও উষ্ণ হয়ে আছে —
ফিরিয়া আসিবে সে কি তাহাদের কাছে!
প্রণয়ীর মতো ভালোবেসে
খুঁজিবে কি এসে
একখানা দেহ শুধু!
হারায়ে গিয়েছে কবে কঙ্কালে কাঁকরে
এ মাটির পরে!
অন্ধাকারে সাগরের জল
ছেনেছে আমার দেহ, হয়েছে শীতল
চোখ — ঠোট — নাসিকা আঙুল
তাহার ছোয়াচে; ভিজে গেছে চুল
শাদা শাদা ফেনাফুলে;
কত বার দূর উপকূলে
তারাভরা আকাশের তলে
বালকের মতো এক — সমুদ্রের জলে
দেহ ধুয়ে নিয়া
জেনেছি দেহের স্বাদ — গেছে বুক — মুখ পরশিয়া
রাঙা রোদ — নারীর মতন
এ দেহ পেয়েছে যেন তাহার চুম্বন
ফসলের ক্ষেতে!
প্রথম প্রণয়ী সে যে, কার্তিকের ভোরবেলা দূরে যেতে যেতে
থেমে গেছে সে আমার তরে!
চোখ দুটো ফের ঘুমে ভরে
যেন তার চুমো খেয়ে!
এ দেহ — অলস মেয়ে
পুরুষের সোহাগে অবশ!
চুমে লয় রৌদ্রের রস
হেমন্ত বৈকালে
উড়ো পাখাপাখালির পালে
উঠানের; পেতে থাকে কান —
শোনো ঝরা শিশিরের গান
অঘ্রানের মাঝরাতে;
হিম হাওয়া যেন শাদা কঙ্কালের হাতে
এ দেহেরে এসে ধরে —
ব্যথা দেয়! নারীর অধরে —
চুলে — চোখে — জুঁয়ের নিশ্বাসে
ঝুমকো লতার মতো তার দেহ — ফাঁসে
ভরা ফসলের মতো পড়ে ছিঁড়ে
এই দেহ — ব্যথা পায় ফিরে!….
তবু এই শস্যক্ষেতে পিপাসার ভাষা
ফুরাবে না কে বা সেই চাষা —
কাস্তে হাতে — কঠিন, কামুক —
আমাদের সবটুকু ব্যথাভরা সুখ
উচ্ছেদ করিবে এসে একা!
কে বা সেই! জানি না তো হয় নাই দেখা
আজও তার সনে;
আজ শুধু দেহ — আর দেহের পীড়নে
সাধ মোর চোখে ঠোঁটে চুলে
শুধু পীড়া, শুধু পীড়া! — মুকুলে মুকুলে
শুধু কীট, আঘাত, দংশন —
চায় আজ মন!
নক্ষত্রের পানে যেতে যেতে
পথ ভুলে বারবার পৃথিবীর ক্ষেতে
জন্মিতেছি আমি এক সবুজ ফসল!
অন্ধকারে শিশিরের জল
কানে কানে গাহিয়াছে গান —
ঢালিয়াছে শীতল অঘ্রাণ;
মোর দেহ ছেনে গেছে অলস — আঢুল
কুমারী আঙুল
কুয়াশার; ঘ্রাণ আর পরশের সাধ
জাগায়েছে কাস্তের মতো বাঁকা চাঁদ
ঢালিয়াছে আলো —
প্রণয়ীর ঠোঁটের ধারালো
চুম্বনের মতো!
রেখে গেছে ক্ষত
সব্জির সবুজ রুধিরে!
শস্যের মতো মোর এ শরীর ছিঁড়ে
বারবার হয়েছে আহত
আগুনের মতো
দুপুরের রাঙা রোদ!
আমি তবু ব্যথা দেই —
ব্যথা পাই ফিরে! —
তবু চাই সবুজ শরীরে
এ ব্যথার সুখ!
লাল আলো — রৌদ্রের চুমুক,
অন্ধকার — কুয়াশার ছুরি
মোরে যেন কেটে লয়, যেন গুড়ি গুড়ি
ধুলো মোরে ধীরে লয় শুষে!
মাঠে মাঠে — আড়ষ্ট পউষে
ফসলের গন্ধ বুকে করে
বারবার পড়ি যেন ঝ’রে!
আবার পাব আমি ফিরে
এই দেহ! –এ মাটির নিঃসাড় শিশিরে
রক্তের তাপ ঢেলে আমি
আসিব কি নামি!
হেমন্তের রৌদ্রের মতন
ফসলের স্তন
আঙুলে নিঙাড়ি
এক ক্ষেত ছাড়ি
অন্য ক্ষেতে
চলিব কি ভেসে
এ সবুজ দেশে
আর এক বার!
শুনিব কি গান
ঢেউদের! –জলের আঘ্রাণ
লব বুকে তুলে
আমি পথ ভুলে
আসিব কি এ পথে আবার!
ধুলো — বিছানার
কীটদের মতো
হব কি আহত
ঘাসের আঘাতে!
বেদনার সাথে
সুখ পাব!
লতার মতন মোর চুল,
আমার আঙুল
পাপড়ির মতো —
হবে কি বিক্ষত
তোমার আঙুলে — চুলে!
লাগিবে কি ফুলে
ফুলের আঘাত
আরবার
আমার এ পিপাসার ধার
তোমাদের জাগাবে পিপাসা!
ক্ষুধিতের ভাষা
বুকে করে করে
ফলিব কি! — পড়িব কি ঝরে
পৃথিবীর শস্যের ক্ষেতে
আর একবার আমি —
নক্ষত্রের পানে যেতে যেতে।
No comments:
Post a Comment