এখন যে কবিতাটি লিখবো আমি

আবিদ আজাদ

এখন যে কবিতাটি লিখবো আমি
        এক্ষুণি সেই কবিতাটি বাজেয়াপ্ত করা হবে
এক্ষুনি বেআইনি বলে ঘোষিত হবে সেই কবিতার
        প্রতিটি শব্দ
        প্রতিটি দাঁড়িকমা
        প্রতিটি সেমিকোলন।
নিষিদ্ধ ঘোষনা করা হবে সেই কবিতার আপাদমস্তক চরণপুঞ্জ।

এখন যে কবিতাটি লিখবো আমি
        তার জন্যে মুহূর্তের মধ্যে সারাদেশ জুড়ে নেমে আসবে আরও
                একটি উত্থানের প্রাক-মুহূর্তের স্তব্ধতা
        নেমে আসবে রাইফেলের নলের মতো
                মৃত্যু -
আর সেই মৃত্যুর স্তব্ধতায় বাংলাদেশের আবহমান সবুজ রঙ
        অন্ধকারের মতো কালো হ’তে হ’তে ভয়াল গর্জনে ফেটে পড়বে
                সমুদ্রের মতো।

এখন যে কবিতাটি লিখবো আমি
        তার জন্যে হঠাৎ বোমাবাজির পর
        ভরদুপুরের ভৌতিক গলির মতো শান্ত হয়ে যাবে
        আমাদের প্রিয়তম এই রাজধানী, এই ঢাকা
        বাজতে থাকবে চারিদিকে বুটের আওয়াজ
                শুধু বুটের
                        আওয়াজ

এখন যে কবিতাটি লিখবো আমি
        তার জন্যে নিমিষের মধ্যে সারা শহর জুড়ে শুরু হয়ে যাবে
                খানাতল্লাশি
        তার জন্যে আর্মি-ইন্টেলিজেন্স রুম থেকে দিকে দিকে পাঠিয়ে দেওয়া হবে
                গোপন নির্দেশ।
        তার জন্যে বন্ধ করে দেওয়া হবে বিমানের সব নির্দিষ্ট ফ্লাইট
        তার জন্যে গ্রামে-গঞ্জে ছড়িয়ে দেয়া হবে নির্মম সন্ত্রাস
        তার জন্যে চব্বিশ ঘন্টার মধ্যে সারাদেশে জারি হয়ে যাবে জরুরি অবস্থা -

এখন যে কবিতাটি লিখবো আমি
        তার জন্যে এক্ষুণি রাস্তায় রাস্তায় বসে যাবে চেকপোষ্ট
        শাহবাগের মোড়ে
        টিকাটুলির তেমাথায়
        ফার্মগেটের সামনে থামিয়ে দেওয়া হবে
        সব চলন্ত বাস, কোচ আর কোস্টার
        লাইন করে দাঁড় করিয়ে দেয়া হবে সারি সারি রিকশা ও ঠেলাগাড়ি।
আর মুহূর্তের মধ্যে শুরু হয়ে যাবে জোর তদন্ত
        আবার সার্চলাইট ঝলসে উঠবে বাংলার খালে বিলে নদী নালায়
        চেক করা হবে সন্ত্রস্ত যাত্রীদের শরীর
        চেক করা হবে মহিলার চামড়ার ব্যাগ
        চেক করা হবে কিশোরের খেলার বল
        চেক করা হবে গাড়ির পাদানির নিচ থেকে কার্পেটের অতল অবধি
        চেক করা হবে সাইকেলচারী যুবকের প্লাস্টিকের থলি
        চেক করা হবে বেতার-ভবনের গেটে ঘোষিকার কণ্ঠ
        তরুণ কবির বুকপকেট,
        বলপেনের দাগভরা আঙুলের ভাঁজ
        কেরানির খাতা
        অধ্যাপকের উড়োচুল
        কৃষকের কোঁচড়
        শ্রমিকের চোখ
        পাড়াগাঁর স্কুল
        গঞ্জের ক্যানভাসারের গলা
        হকারের বগল
        গরু-পাইকারের খতি
        বেশ্যাপাড়ার দাগী-খুনির লুঙ্গির গাঁট
        সেন্ট্রাল জেলের কনডেমড সেল
        রেশনকার্ডের মলিন পরত
        এমনকি মুদ্দাফরাশের জবানবন্দির ভেতরেও চলবে তল্লাশি

এখন যে কবিতাটি লিখবো আমি
        তার গতি রোধ করতে গিয়ে সীমান্ত পুলিশের হাতে
                ধরা পড়বে কয়েক লক্ষ টাকার গুইসাপের চামড়া
        তার গতি রোধ করতে গিয়ে সীমান্তরক্ষীর হাতে
        আটকা পড়বে তিনজন চোরাচালানিসহ কয়েক লক্ষ টাকার
                বিদেশী শাড়ি

এখন যে কবিতাটি লিখবো আমি
        তার জন্যে মুহূর্তের মধ্যে ছদ্মবেশে টহল দিতে শুরু করবে পুলিশভ্যান
        তার জন্যে তছনছ হয়ে যাবে ইউনিভার্সিটির হল
        তার জন্যে প্রচন্ড সন্ধ্যাবেলা মেডিকেল কলেজের হোস্টেলের
        টিভি রুমের ভিতর থেকে সন্দেহবশত ধরে নিয়ে যাবে দুজন ছাত্রকে
        তার জন্যে বস্তিতে বস্তিতে আগুনের মতো
        লেলিয়ে দেয়া হবে গুন্ডাপান্ডা -

এখন যে কবিতাটি লিখবো আমি
        সেই কবিতাটি যখন পড়বে কোনো এক পঙ্গু মুক্তিযোদ্ধা
আমি জানি তার ব্যর্থ কাঁধের পাশে দাঁড়িয়ে অসমাপ্ত মুক্তিযুদ্ধ
                তখন ফেলবে দীর্ঘশ্বাস
        সেই কবিতাটি যখন পড়বেন চশমার-কাচ-ফাটা গ্রামের কোনো এক
                প্রৌঢ় ইস্কুল মাস্টার
আমি জানি তার শূন্য চোখের সামনে তখন ভেসে উঠবে
        এক শীতের ভোরে শিমুলগাছের নিচে উদ্ধার-করা তার হঠাৎ
                নিখোঁজ হয়ে-যাওয়া ছেলের লাশ -
        সেই কবিতাটি যখন পড়বে কোনো এক কলেজছাত্রী
আমি জানি তখন তার মনে পড়বে প্রেমিকের উষ্ণ চুম্বনের ভিতরে
                আবিস্কার করা
        প্রথম পৃথিবী প্রদক্ষিণের আলোড়ন নয়
        তার মনে পড়বে পলায়নপর এক যুবকের প্রতিশ্রুতি ভঙ্গের কথা -
        সেই কবিতাটি যখন পড়বেন কোনো এক চল্লিশোত্তীর্ণা মহিলা
আমি জানি তার বিগত দিনের পশমকাঁটায় তখন জেগে উঠবে শুধু
                আকণ্ঠ পরিতাপ
        সেই কবিতাটি যখন পড়বেন কোন এক বজ্জাত অধ্যাপক
আমি জানি তখন তার মনে পড়বে তার হওয়ার কথা ছিল পুলিশ
        কিন্তু তিনি হয়ে গেছেন অধ্যাপক -
        সেই কবিতাটি যখন পড়বেন কোনো এক পত্রিকার সম্পাদক
আমি জানি তখন ঘুমের মধ্যে তার মাথার ভিতর থেকে বেরিয়ে আসবে
                একটি ছায়ামূর্তি
        আর তার মনে পড়বে – তার হওয়ার কথা ছিল সওদাগরি
                অফিসের অ্যাকাউন্টেন্ট
        কিন্তু তিনি হয়ে গেছেন সম্পাদক

এখন যে কবিতাটি লিখব আমি
        তার জন্যে দৈনিক পত্রিকাগুলোর নাইট শিফটের টেবিলে টেবিলে
        গুঞ্জরিত হয়ে ফিরবে ফিসফিসে চাপাগুঞ্জন
        তার জন্যে চাকরি যাবে তথ্য সচিবের
        তার জন্যে বিনিদ্র পায়চারী শুরু হবে স্বরাষ্ট্র সচিবের
        তার জন্যে রাত তিনটেয় টেলিফোনের রিসিভার হাতে কাঁপতে
                থাকবেন পুলিশের আই জি
        তার জন্যে আপন পদে ইস্তফা দেবেন তথ্যমন্ত্রী

এখন যে কবিতাটি লিখব আমি
        তার জন্যে অপেক্ষা করছে
                দুটো লোহার ঠান্ডা হাতকড়া
        তার জন্যে অপেক্ষা করছে
                একটি চকচকে ঘাতক ছুরি
        তার জন্যে অপেক্ষা করছে
                ভাড়া করা মাস্তানদের একটি কালো গাড়ি।
        তার জন্যে অপেক্ষা করছে
                ক্যান্টনমেন্টের একটি রক্তপায়ী বাড়ি
        তার জন্যে অপেক্ষা করছে
                কনসেন্ট্রেশন ক্যাম্পের একটি হিংস্র চেয়ার
        তার জন্যে অপেক্ষা করছে
                উচ্চাভিলাষী কয়েকজন জেনারেলের ষড়যন্ত্রের একটি
                        নির্মম নির্জন মধ্যরাত-

এখন যে কবিতাটি লিখব আমি
        তার জন্যে আমার সন্তানের জন্মের যন্ত্রণা মুখে নিয়ে
                আমার প্রিয়তমা নারীর মতো
                        অপেক্ষা করছে আমার বাংলাদেশ।

No comments:

Post a Comment