দুরন্ত আশা

রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর

মর্মে যবে মত্ত আশা
       সর্পসম ফোঁসে,
অদৃষ্টের বন্ধনেতে
       দাপিয়া বৃথা রোষে,
তখনো ভালোমানুষ সেজে
বাঁধানো হুঁকা যতনে মেজে
মলিন তাস সজোরে ভেঁজে
       খেলিতে হবে কষে!
অন্নপায়ী বঙ্গবাসী
       স্তন্যপায়ী জীব
জন-দশেকে জটলা করি
       তক্তপোশে ব’সে।

ভদ্র মোরা, শান্ত বড়ো,
       পোষ-মানা এ প্রাণ
বোতাম-আঁটা জামার নীচে
       শান্তিতে শয়ান।
দেখা হলেই মিষ্ট অতি
মুখের ভাব শিষ্ট অতি,
অলস দেহ ক্লিষ্টগতি—
       গৃহের প্রতি টান।
তৈল-ঢালা স্নিগ্ধ তনু
       নিদ্রারসে ভরা,
মাথায় ছোটো বহরে বড়ো
       বাঙালি সন্তান।

ইহার চেয়ে হতেম যদি
       আরব বেদুয়িন!
চরণতলে বিশাল মরু
       দিগন্তে বিলীন।
ছুটেছে ঘোড়া, উড়েছে বালি,
জীবনস্রোত আকাশে ঢালি
হৃদয়তলে বহ্নি জ্বালি
       চলেছি নিশিদিন।
বর্শা হাতে, ভর্‌সা প্রাণে,
       সদাই নিরুদ্দেশ,
মরুর ঝড় যেমন বহে
       সকল বাধাহীন।

বিপদ-মাঝে ঝাঁপায়ে প’ড়ে
       শোণিত উঠে ফুটে,
সকল দেহে সকল মনে
       জীবন জেগে উঠে—

অন্ধকারে সূর্যালোতে
সন্তরিয়া মৃত্যুস্রোতে
নৃত্যময় চিত্ত হতে
       মত্ত হাসি টুটে।
বিশ্বমাঝে মহান যাহা
       সঙ্গী পরানের,
ঝঞ্ঝামাঝে ধায় সে প্রাণ
       সিন্ধুমাঝে লুটে।

নিমেষতরে ইচ্ছা করে
       বিকট উল্লাসে
সকল টুটে যাইতে ছুটে
       জীবন-উচ্ছ্বাসে—
শূন্য ব্যোম অপরিমাণ
মদ্যসম করিতে পান
মুক্ত করি রুদ্ধ প্রাণ
       ঊর্ধ্ব নীলাকাশে।
থাকিতে নারি ক্ষুদ্র কোণে
আম্রবনছায়ে
সুপ্ত হয়ে লুপ্ত হয়ে
       গুপ্ত গৃহবাসে।

No comments:

Post a Comment