ধূমকেতু

কাজী নজরুল ইসলাম
["অগ্নিবীণা" থেকে নেওয়া]

আমি যুগে যুগে আসি, আসিয়াছি পুনঃ মহাবিপ্লব হেতু
এই স্রষ্টার শনি মহাকাল ধূমকেতু!
সাত— সাত শ’ নরক-জ্বালা জ্বলে মম ললাটে,
মম ধূম-কুণ্ডলী ক’রেছে শিবের ত্রিনয়ন ঘন ঘোলাটে!
আমি অশিব তিক্ত অভিশাপ,
আমি স্রষ্টার বুকে সৃষ্টি-পাপের অনুতাপ-তাপ-হাহাকার—
আর মর্ত্তে সাহারা-গোবী ছাপ,
আমি অশিব তিক্ত অভিশাপ!

আমি সর্ব্বনাশের ঝাণ্ডা উড়ায়ে বোঁও বোঁও ঘুরি শূণ্যে,
আমি বিষ-ধূম-বাণ হানি একা ঘিরে ভগবান-অভিমুন্যে |
শোঁও শন-নন-নন শন-নন-নন শাঁই শাঁই,
ঘুর্ পাক্ খাই, ধাই পাঁই পাঁই,
মম পুচ্ছে জড়ায়ে সৃষ্টি ;
করি’ উল্কা-অশনি-বৃষ্টি, —
আমি একটা বিশ্ব গ্রাসিয়াছি, পারি গ্রাসিতে এখনো ত্রিশটি |
আমি অপঘাত দুর্দ্দৈব রে আমি সৃষ্টির অনাসৃষ্টি!

আমি আপনার বিষ-জ্বালা মদ-পিয়া মোচড় খাইয়া খাইয়া
জোর বুঁদ হ’য়ে আমি চ’লেছি ধাইয়া ভাইয়া!
শুনি’ মম বিষাক্ত, “রিরিরিরি”-নাদ
শোনায় দ্বিরেফ-গুঞ্জন সম বিশ্ব ঘোরার প্রণব নিনাদ!
মম ধূর্জ্জটী-শিখ করাল পুচ্ছে
দশ অবতারে বেঁধে ঝ্যাটা ক’রে ঘোরাই উচ্চে, ঘুরাই—
আমি অগ্নি কেতন উড়াই! —
আমি যুগে যুগে আসি, আসিয়াছি পুনঃ মহাবিপ্লব হেতু
এই স্রষ্টার শনি মহাকাল ধূমকেতু!

ঐ বামন বিধি সে আমারে ধরিতে বাড়ায়েছিল রে হাত
মম অগ্নি-দাহনে জ্ব’লে পুড়ে তাই ঠুঁটো সে জগন্নাথ!
আমি জানি জানি ঐ স্রষ্টার ফাঁকি, সৃষ্টির ঐ চাতুরী,
তাই বিধি ও নিয়মে লাথি মেরে, ঠুকি বিধাতার বুকে হাতুড়ি |
আমি জানি জানি ঐ ভুয়ো ঈশ্বর দিয়ে যা’ হয়নি হবে তা’ও!
তাই বিপ্লব হানি বিদ্রোহ করি, নেচে নেচে দিই গোঁফে তা’ও!
তোর নিযুত নরকে ফুঁ দিয়ে নিবাই, মৃত্যুর মুখে থুতু দি’!
আর যে যত রাগে রে তারে তত কাল্-আগুনের কাতুকুতু দি’!
মম তুরীয় লোকের তির্যক-গতি তূর্য্য-গাজন বাজায়!
মম বিষ-নিঃশ্বাসে মারীভয় হানে অরাজক যত রাজায়!

কচি শিশু-রসনায় ধানী-লঙ্কার পোড়া ঝাল
আর বদ্ধ কারায় গন্ধক ঘোঁয়া, এসিড, পটাস, মোনছাল,
আর কাঁচা কলিজায় পচা ঘা’র সম সৃষ্টিরে আমি দাহ করি
আর স্রষ্টারে আমি চুষে খাই!
পেলে বাহান্ন-শও জাহান্নামেও আধা চুমুকে সে শুষে যাই!

আমি যুগে যুগে আসি, আসিয়াছি পুনঃ মহাবিপ্লব হেতু
এই স্রষ্টার শনি মহাকাল ধূমকেতু!

আমি শি শি শি প্রলয়-শিশ্ দিয়ে ঘুরি কৃতিঘ্নী
ঐ বিশ্বমাতার শোকাগ্নি,
আমি ত্রিভুবন তার পোড়ায়ে মারিয়া আমিই করিব মুখাগ্নি!
তাই আমি ঘোর তিক্ত সুখে রে, একপাক ঘু’রে বোঁও করে
ফের দু’পাক নি’!
কৃতিঘ্নী আমি কৃতিঘ্নী ঐ বিশ্বমাতার শোকাগ্নি!
পঞ্জর মম খর্পরে জ্বলে নিদারুণ যেই বৈশ্বানর—
শোন্ রো মর, শোন্ অমর! —
সে যে তোদের ঐ বিশ্বপিতার চিতা!
এ চিতাগ্নিতে জগদীশ্বর পুড়ে ছাই হবে, হে সৃষ্টি জান কি তা ?
কি বল ? কি বল ? ফের বল ভাই আমি শয়তান-মিতা!
হো হো ভগবানে আমি পোড়াব বলিয়া জ্বালিয়েছি বুকে চিতা!
ছোট শন শন শন ঘর ঘর ঘর সাঁই সাঁই!
ছোট পাঁই পাঁই |
তুই অভিশাপ তুই শয়তান তোর অনন্তকাল পরমাই!
ওরে ভয় নাই তোর মার নাই !!
তুই প্রলয়ঙ্কর ধূমকেতু!

আমি যুগে যুগে আসি, আসিয়াছি পুনঃ মহাবিপ্লব হেতু
এই স্রষ্টার শনি মহাকাল ধূমকেতু!

ঐ ঈশ্বর-শির উল্লঙ্ঘিতে আমি আগুনের সিড়ি,
আমি বসিব বলিয়া পেতেছি ভবানী ব্রহ্মার বুকে পিঁড়ি!
ক্ষ্যাপা মহেশের বিক্ষিপ্ত পিনাক, দেবরাজ-দম্ভোলি
লোকে বলে মোরে, শুনে হাসি আমি আর নাচি বব-বম্ বলি!
এই শিখায় আমার নিযুত ত্রিশূল বাশুলি বজ্র-ছড়ি
ওরে ছড়ানো র’য়েছে, কত যায় গড়াগড়ি!
মহা সিংহাসনে সে কাঁপিছে বিশ্ব-সম্রাট নিরবধি,
তার ললাটে তপ্ত অভিশাপ ছাপ এঁকে দিই আমি যদি!
তাই টিটকিরি দিয়ে হাহা হেসে উঠি,
সে হাসি গুমরি লুটায়ে পরে রে তুফান ঝঞ্ঝা সাইক্লোনে টুটি’ !

আমি বাজাই আকাশে তালি দিয়া “তাতা-উর্ তাক্” |
আর সোঁও সোঁও করে প্যাঁচ দিয়ে খাই চিলে-ঘুড়ি সম ঘুরপাক!
মম নিঃশ্বাস আভাসে অগ্নি-গিরির বুক ফেটে উঠে ঘুত্কারপ
আর পুচ্ছে আমার কোটি নাগ-শিশু উদ্গারে বিষ-ফুত্কার!
কাল বাঘিনী যেমন ধরিয়া শিকার
তখনি রক্ত শোষে না রে তার,
দৃষ্টি-সীমায় রাখিয়া তাহারে উগ্রচণ্ড সুখে
পুচ্ছ সাপটি’ খেলা করে আর শিকার মরে সে ধুঁকে!
তেমনি করিয়া ভগবানে আমি
দৃষ্টি-সীমায় রাখি দিবাযামী
ঘিরিয়া ঘিরিয়া খেলিতেছি খেলা, হাসি’ পিশাচের হাসি
এই অগ্নি-বাঘিনী আমি সে সর্ব্বনাশী!

আজ রক্ত মাতাল উল্লাসে মাতি রে—
মম পুচ্ছে ঠিকরে দশগুণ ভাতি,
রক্ত-রুদ্র উল্লাসে মাতি রে!
ভগবান্ ? সে ত হাতের শিকার!— মুখে ফেনা উঠে মরে!
ভয়ে কাঁপিছে, কখন পড়ি গিয়া তার আহত বুকের প’রে!
অথবা যেন রে অসহায় এক শিশুরে ঘিরিয়া

চায়, আর ঘোরে শন্ শন্ শন্,
ভয় বিহ্বল শিশু তার মাঝে কাঁপে রে যেমন—
তেমনি করিয়া ভগবানে ঘিরে
ধূমকেতু-কালনাগ অভিশাপ ছুটে চলেছি রে ;
আর সাপে-ঘেরা অসহায় শিশু সম
বিধাতা তোদের কাঁপিছে রুদ্র ঘুর্ণীর মাঝে মম!
আজিও ব্যথিত সৃষ্টির বুকে ভগবান কাঁদে ত্রাসে,
স্রষ্টার চেয়ে সৃষ্ট পাছে বা বড় হ’য়ে তারে গ্রাসে!

No comments:

Post a Comment