রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
শুধু বিঘে দুই ছিল মোর ভুঁই আর সবই গেছে ঋণে ।
বাবু বলিলেন , ‘ বুঝেছ উপেন , এ জমি লইব কিনে । '
কহিলাম আমি , ‘ তুমি ভূস্বামী , ভূমির অন্ত নাই ।
চেয়ে দেখো মোর আছে বড়ো - জোর মরিবার মতো ঠাঁই । '
শুনি রাজা কহে , ‘ বাপু , জানো তো হে , করেছি বাগানখানা
পেলে দুই বিঘে প্রস্থ ও দিঘে সমান হইবে টানা —
ওটা দিতে হবে । ' কহিলাম তবে বক্ষে জুড়িয়া পাণি
সজল চক্ষে , ‘ করুণ রক্ষে গরিবের ভিটেখানি ।
সপ্ত পুরুষ যেথায় মানুষ সে মাটি সোনার বাড়া ,
দৈন্যের দায়ে বেচিব সে মায়ে এমনি লক্ষ্মীছাড়া ! '
আঁখি করি লাল রাজা ক্ষণকাল রহিল মৌনভাবে ,
কহিলেন শেষে ক্রূর হাসি হেসে , ‘ আচ্ছা , সে দেখা যাবে । '
পরে মাস দেড়ে ভিটে মাটি ছেড়ে বাহির হইনু পথে —
করিল ডিক্রি , সকলই বিক্রি মিথ্যা দেনার খতে ।
এ জগতে , হায় , সেই বেশি চায় আছে যার ভূরি ভূরি —
রাজার হস্ত করে সমস্ত কাঙালের ধন চুরি ।
মনে ভাবিলাম মোরে ভগবান রাখিবে না মোহগর্তে ,
তাই লিখি দিল বিশ্বনিখিল দু বিঘার পরিবর্তে ।
সন্ন্যাসীবেশে ফিরি দেশে দেশে হইয়া সাধুর শিষ্য
কত হেরিলাম মনোহর ধাম , কত মনোরম দৃশ্য !
ভূধরে সাগরে বিজনে নগরে যখন যেখানে ভ্রমি
তবু নিশিদিনে ভুলিতে পারি নে সেই দুই বিঘা জমি ।
হাটে মাঠে বাটে এই মতো কাটে বছর পনেরো - ষোলো —
একদিন শেষে ফিরিবারে দেশে বড়ই বাসনা হল ।
নমোনমো নম সুন্দরী মম জননী বঙ্গভূমি !
গঙ্গার তীর স্নিগ্ধ সমীর , জীবন জুড়ালে তুমি ।
অবারিত মাঠ , গগনললাট চুমে তব পদধূলি ,
ছায়াসুনিবিড় শান্তির নীড় ছোটো ছোটো গ্রামগুলি ।
পল্লবঘন আম্রকানন রাখালের খেলাগেহ ,
স্তব্ধ অতল দিঘি কালোজল — নিশীথশীতল স্নেহ ।
বুকভরা মধু বঙ্গের বধূ জল লয়ে যায় ঘরে —
মা বলিতে প্রাণ করে আনচান , চোখে আসে জল ভরে ।
দুই দিন পরে দ্বিতীয় প্রহরে প্রবেশিনু নিজগ্রামে —
কুমোরের বাড়ি দক্ষিণে ছাড়ি রথতলা করি বামে ,
রাখি হাটখোলা , নন্দীর গোলা , মন্দির করি পাছে
তৃষাতুর শেষে পঁহুছিনু এসে আমার বাড়ির কাছে ।
ধিক্ ধিক্ ওরে , শতধিক্ তোরে , নিলাজ কুলটা ভূমি !
যখনি যাহার তখনি তাহার , এই কি জননী তুমি !
সে কি মনে হবে একদিন যবে ছিলে দরিদ্রমাতা
আঁচল ভরিয়া রাখিতে ধরিয়া ফল ফুল শাক পাতা !
আজ কোন্ রীতে কারে ভুলাইতে ধরেছ বিলাসবেশ —
পাঁচরঙা পাতা অঞ্চলে গাঁথা , পুষ্পে খচিত কেশ !
আমি তোর লাগি ফিরেছি বিবাগি গৃহহারা সুখহীন —
তুই হেথা বসি ওরে রাক্ষসী , হাসিয়া কাটাস দিন !
ধনীর আদরে গরব না ধরে! এতই হয়েছ ভিন্ন
কোনোখানে লেশ নাহি অবশেষ সেদিনের কোনো চিহ্ন !
কল্যাণময়ী ছিলে তুমি অয়ি , ক্ষুধাহরা সুধারাশি !
যত হাসো আজ যত করো সাজ ছিলে দেবী , হলে দাসী ।
বিদীর্ণ হিয়া ফিরিয়া ফিরিয়া চারি দিকে চেয়ে দেখি —
প্রাচীরের কাছে এখনো যে আছে , সেই আমগাছ একি !
বসি তার তলে নয়নের জলে শান্ত হইল ব্যথা ,
একে একে মনে উদিল স্মরণে বালক - কালের কথা ।
সেই মনে পড়ে জ্যৈষ্ঠের ঝড়ে রাত্রে নাহিকো ঘুম ,
অতি ভোরে উঠি তাড়াতাড়ি ছুটি আম কুড়াবার ধুম ।
সেই সুমধুর স্তব্ধ দুপুর , পাঠশালা - পলায়ন —
ভাবিলাম হায় আর কি কোথায় ফিরে পাব সে জীবন !
সহসা বাতাস ফেলি গেল শ্বাস শাখা দুলাইয়া গাছে ,
দুটি পাকা ফল লভিল ভূতল আমার কোলের কাছে ।
ভাবিলাম মনে বুঝি এতখনে আমারে চিনিল মাতা ,
স্নেহের সে দানে বহু সম্মানে বারেক ঠেকানু মাথা ।
হেনকালে হায় যমদূত - প্রায় কোথা হতে এল মালী ,
ঝুঁটি - বাঁধা উড়ে সপ্তম সুরে পাড়িতে লাগিল গালি ।
কহিলাম তবে , ‘ আমি তো নীরবে দিয়েছি আমার সব —
দুটি ফল তার করি অধিকার , এত তারি কলরব ! '
চিনিল না মোরে , নিয়ে গেল ধরে কাঁধে তুলি লাঠিগাছ —
বাবু ছিপ হাতে পারিষদ - সাথে ধরিতেছিলেন মাছ ।
শুনি বিবরণ ক্রোধে তিনি কন , ‘ মারিয়া করিব খুন ! '
বাবু যত বলে পারিষদ - দলে বলে তার শতগুণ ।
আমি কহিলাম , ‘ শুধু দুটি আম ভিখ মাগি মহাশয় ! '
বাবু কহে হেসে , ‘ বেটা সাধুবেশে পাকা চোর অতিশয় । '
আমি শুনে হাসি আঁখিজলে ভাসি , এই ছিল মোর ঘটে —
তুমি মহারাজ সাধু হলে আজ , আমি আজ চোর বটে !
[কাহিনী]
শুধু বিঘে দুই ছিল মোর ভুঁই আর সবই গেছে ঋণে ।
বাবু বলিলেন , ‘ বুঝেছ উপেন , এ জমি লইব কিনে । '
কহিলাম আমি , ‘ তুমি ভূস্বামী , ভূমির অন্ত নাই ।
চেয়ে দেখো মোর আছে বড়ো - জোর মরিবার মতো ঠাঁই । '
শুনি রাজা কহে , ‘ বাপু , জানো তো হে , করেছি বাগানখানা
পেলে দুই বিঘে প্রস্থ ও দিঘে সমান হইবে টানা —
ওটা দিতে হবে । ' কহিলাম তবে বক্ষে জুড়িয়া পাণি
সজল চক্ষে , ‘ করুণ রক্ষে গরিবের ভিটেখানি ।
সপ্ত পুরুষ যেথায় মানুষ সে মাটি সোনার বাড়া ,
দৈন্যের দায়ে বেচিব সে মায়ে এমনি লক্ষ্মীছাড়া ! '
আঁখি করি লাল রাজা ক্ষণকাল রহিল মৌনভাবে ,
কহিলেন শেষে ক্রূর হাসি হেসে , ‘ আচ্ছা , সে দেখা যাবে । '
পরে মাস দেড়ে ভিটে মাটি ছেড়ে বাহির হইনু পথে —
করিল ডিক্রি , সকলই বিক্রি মিথ্যা দেনার খতে ।
এ জগতে , হায় , সেই বেশি চায় আছে যার ভূরি ভূরি —
রাজার হস্ত করে সমস্ত কাঙালের ধন চুরি ।
মনে ভাবিলাম মোরে ভগবান রাখিবে না মোহগর্তে ,
তাই লিখি দিল বিশ্বনিখিল দু বিঘার পরিবর্তে ।
সন্ন্যাসীবেশে ফিরি দেশে দেশে হইয়া সাধুর শিষ্য
কত হেরিলাম মনোহর ধাম , কত মনোরম দৃশ্য !
ভূধরে সাগরে বিজনে নগরে যখন যেখানে ভ্রমি
তবু নিশিদিনে ভুলিতে পারি নে সেই দুই বিঘা জমি ।
হাটে মাঠে বাটে এই মতো কাটে বছর পনেরো - ষোলো —
একদিন শেষে ফিরিবারে দেশে বড়ই বাসনা হল ।
নমোনমো নম সুন্দরী মম জননী বঙ্গভূমি !
গঙ্গার তীর স্নিগ্ধ সমীর , জীবন জুড়ালে তুমি ।
অবারিত মাঠ , গগনললাট চুমে তব পদধূলি ,
ছায়াসুনিবিড় শান্তির নীড় ছোটো ছোটো গ্রামগুলি ।
পল্লবঘন আম্রকানন রাখালের খেলাগেহ ,
স্তব্ধ অতল দিঘি কালোজল — নিশীথশীতল স্নেহ ।
বুকভরা মধু বঙ্গের বধূ জল লয়ে যায় ঘরে —
মা বলিতে প্রাণ করে আনচান , চোখে আসে জল ভরে ।
দুই দিন পরে দ্বিতীয় প্রহরে প্রবেশিনু নিজগ্রামে —
কুমোরের বাড়ি দক্ষিণে ছাড়ি রথতলা করি বামে ,
রাখি হাটখোলা , নন্দীর গোলা , মন্দির করি পাছে
তৃষাতুর শেষে পঁহুছিনু এসে আমার বাড়ির কাছে ।
ধিক্ ধিক্ ওরে , শতধিক্ তোরে , নিলাজ কুলটা ভূমি !
যখনি যাহার তখনি তাহার , এই কি জননী তুমি !
সে কি মনে হবে একদিন যবে ছিলে দরিদ্রমাতা
আঁচল ভরিয়া রাখিতে ধরিয়া ফল ফুল শাক পাতা !
আজ কোন্ রীতে কারে ভুলাইতে ধরেছ বিলাসবেশ —
পাঁচরঙা পাতা অঞ্চলে গাঁথা , পুষ্পে খচিত কেশ !
আমি তোর লাগি ফিরেছি বিবাগি গৃহহারা সুখহীন —
তুই হেথা বসি ওরে রাক্ষসী , হাসিয়া কাটাস দিন !
ধনীর আদরে গরব না ধরে! এতই হয়েছ ভিন্ন
কোনোখানে লেশ নাহি অবশেষ সেদিনের কোনো চিহ্ন !
কল্যাণময়ী ছিলে তুমি অয়ি , ক্ষুধাহরা সুধারাশি !
যত হাসো আজ যত করো সাজ ছিলে দেবী , হলে দাসী ।
বিদীর্ণ হিয়া ফিরিয়া ফিরিয়া চারি দিকে চেয়ে দেখি —
প্রাচীরের কাছে এখনো যে আছে , সেই আমগাছ একি !
বসি তার তলে নয়নের জলে শান্ত হইল ব্যথা ,
একে একে মনে উদিল স্মরণে বালক - কালের কথা ।
সেই মনে পড়ে জ্যৈষ্ঠের ঝড়ে রাত্রে নাহিকো ঘুম ,
অতি ভোরে উঠি তাড়াতাড়ি ছুটি আম কুড়াবার ধুম ।
সেই সুমধুর স্তব্ধ দুপুর , পাঠশালা - পলায়ন —
ভাবিলাম হায় আর কি কোথায় ফিরে পাব সে জীবন !
সহসা বাতাস ফেলি গেল শ্বাস শাখা দুলাইয়া গাছে ,
দুটি পাকা ফল লভিল ভূতল আমার কোলের কাছে ।
ভাবিলাম মনে বুঝি এতখনে আমারে চিনিল মাতা ,
স্নেহের সে দানে বহু সম্মানে বারেক ঠেকানু মাথা ।
হেনকালে হায় যমদূত - প্রায় কোথা হতে এল মালী ,
ঝুঁটি - বাঁধা উড়ে সপ্তম সুরে পাড়িতে লাগিল গালি ।
কহিলাম তবে , ‘ আমি তো নীরবে দিয়েছি আমার সব —
দুটি ফল তার করি অধিকার , এত তারি কলরব ! '
চিনিল না মোরে , নিয়ে গেল ধরে কাঁধে তুলি লাঠিগাছ —
বাবু ছিপ হাতে পারিষদ - সাথে ধরিতেছিলেন মাছ ।
শুনি বিবরণ ক্রোধে তিনি কন , ‘ মারিয়া করিব খুন ! '
বাবু যত বলে পারিষদ - দলে বলে তার শতগুণ ।
আমি কহিলাম , ‘ শুধু দুটি আম ভিখ মাগি মহাশয় ! '
বাবু কহে হেসে , ‘ বেটা সাধুবেশে পাকা চোর অতিশয় । '
আমি শুনে হাসি আঁখিজলে ভাসি , এই ছিল মোর ঘটে —
তুমি মহারাজ সাধু হলে আজ , আমি আজ চোর বটে !
[কাহিনী]
No comments:
Post a Comment